নতুন প্রজন্মকে বাঁচান

নতুন প্রজন্মকে বাঁচান

medical_coaching_center_bd

সাফাত জামিল শুভ: রাজনীতি,অর্থনীতি,হত্যা,নির্বাচন,আকাশ সংস্কৃতি এসব নিয়ে দেশের মানুষ যখন ব্যস্ত, কেউ খেয়ালই করছে না, দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন একটি প্রজন্ম যাদের নৈতিক মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ প্রায় শূণ্যের কোঠায়। শিক্ষাব্যবস্থার সৃজনশীলতার মোড়কে যারা প্রকৃতপক্ষে অন্তঃসারশূন্য। বলছিলাম ২০০০ পরবর্তী প্রজন্মের কথা।তাদের এরূপ দুঃখজনক অবস্থানের জন্য আসলে কাকে দায়ী করা যায়,প্রকৃত অবস্থা আসলে কি? তা-ই অনুসন্ধান করা হয়েছে এ লেখায়।

শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন করার মহান দায়িত্ব যে শিক্ষকদের, তাদের নিজেদের চরিত্রই এখন বিচিত্র। শিক্ষকরা নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষায় বলে থাকেন “জীবন নিয়মের সুতায় বোনা”। কিন্তু, তাদের মধ্যে কিছু নামধারী অর্থলোভী শিক্ষক সরকারী নিয়ম-নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে খুলে বসেছেন কালের জনপ্রিয়,অধিক লাভজনক “কোচিং বা প্রাইভেট টিওশন” বাণিজ্য।এদের কারণে প্রকৃত শিক্ষকরা তাদের সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছেন।সমাজের জন্য ক্ষতিকর এসব শিক্ষকদের মনোযোগ এখন আর শিক্ষাদানের দিকে নয়, স্বচ্ছল অভিভাবকের সন্তানদের প্রাইভেট কোচিং পড়ানোর দিকে তাদের দৃষ্টি।বিগত বছরগুলোতে প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে নিজ কোচিং এর শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে রীতিমত বেহায়াপনার পরিচয় দিয়ে পরোক্ষভাবে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছেন অনেক শিক্ষক।

বাবা-মা তাদের সন্তানদের পড়ালেখা শেখার জন্য স্কুলে পাঠান। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠে আগ্রহী, কৌতূহলী ও মনোযোগী করে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকদের। কিন্তু, চিত্রটা এখন পুরোপুরি বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থলোভী শিক্ষকগণ ভাল করে না পড়িয়ে দায়সারা ক্লাস নিয়ে পরোক্ষ প্রতারণা করছেন। ঠকাচ্ছেন অভিভাবক ও জাতির ভবিষ্যৎ -শিক্ষার্থীদের। প্রাইভেট কোচিং এর কুপ্রভাব দিনের পর দিন বাড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা গ্রহণের বদলে সহ্য করতে হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নৈতিকতা ভুলে গিয়ে এসব শিক্ষক বৈষম্য-নৈরাজ্য করছেন অস্বচ্ছল, সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে। যে সব শিক্ষার্থী প্রাইভেট কোচিং করে তাদের প্রতি এসব শিক্ষকদের এক ধরণের আচরণ এবং আদুরে আদুরে ব্যবহার। অন্যদিকে, যে সব শিক্ষার্থী স্কুলের কোন শিক্ষকের নিকট প্রাইভেট কোচিং করে না ওই সব বাচ্চার প্রতি শিক্ষকদের অমনোযোগিতা, তাদের এড়িয়ে চলা এবং অস্বাভাবিক আচরণ করা হয়।মূলত এখন স্কুলে পড়া-লেখা শিখতে নয়, কোন বইতে কি পড়া দেয়া হয় তা আনতেই স্কুলে যায় শিক্ষার্থীরা।

প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং-বাণিজ্য শিক্ষার্থী ও অবিভাবকমহলে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। মফস্বলের স্কুল পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীকে একাধিক বিষয় শিক্ষকের নিকট প্রাইভেট পড়তে হয়। শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীকে করতে হয় কোচিং। তবে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাই যাঁরা প্রাইভেট ও কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাঁরা শিক্ষার্থীদের তাদের নিকট পড়তে বাধ্য করেন কিংবা চাপ দেন। এতে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের স্বাভাবিক সম্পর্কের অবনতির পাশাপাশি পাঠদান ও পাঠগ্রহণেও ধারাবাহিকতার বিঘ্ন ঘটে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র অভিভাবকের সন্তানেরা পিছিয়ে পড়ছে কতিপয় অর্থপিশাচ শিক্ষকদের নোংরামির কারণে। এ ধরনের শিক্ষকেরা প্রাইভেট ব্যবসাকে পোক্ত করার জন্য শ্রেণীতে ঠিকমত পাঠদান করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।জনৈক শিক্ষকগণ রীতিমতো ফ্ল্যাট বাসা-বাড়ি ভাড়া নেন শুধুমাত্র প্রাইভেট পড়ানোর জন্য।মফস্বল অঞ্চলসহ শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শিক্ষকেরাই এরূপ শিক্ষা ব্যবসার সাথে জড়িত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। নীতিমালা বাস্তবায়নে কোন কার্যকর উদ্যোগও নেই।

কয়েক দশক আগে যখন নোটবই পড়া নিষিদ্ধ করা হয়, তখন ওই ব্যবস্থা গ্রহণের পেছনে যুক্তি ছিল একটাই, সংক্ষিপ্ত পথে অর্থাৎ নোট বইয়ের সাহায্যে পরীক্ষায় পাস চলে, কিন্তু জ্ঞানার্জন হয় না। তাই টেক্সট বই পড়ার দিকে ছাত্রদের টেনে আনতে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নোট বই নিষিদ্ধ, মনোযোগ দিয়ে টেক্সট বই পড়ো। অথচ এখন চলছে নোট বইয়ের চেয়ে কোচিং।

একটি কলামে পড়েছিলাম, “প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য করেন তাদের মায়েরা (বাবারা নন)।” মায়েরা নাকি সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন। মূলত তারা প্রাইভেট শিক্ষক নির্ভর হয়ে পড়ায় নিজের অজান্তেই সন্তানের সাথে দিনের পর দিন বাড়ছে নিজেদের দূরত্ব। আজ থেকে ১০ বছর আগেও সন্ধ্যার পর পরই সন্তানদের নিয়ে বসতেন মায়েরা।আজ তাদের সেসময় দখল করেছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর বিভিন্ন সিরিয়াল।  কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য করে নিজ সন্তানের সৃজনশীলতা ধ্বংস করছেন প্রতিনিয়ত।

এক যুগ আগেও মফস্বলের স্কুলগুলোতে শিক্ষকেরা তাদের সাধ্যমত ক্লাশ নেওয়ার চেষ্টা করতেন। তারা এতদিন নিরামিষ ভোজী ছিলেন বলে সকলের জানা। কিন্তু বর্তমান যুগে ‘প্রাথমিক আর জুনিয়র শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা’ তাদের প্রাইভেট টিওশন আর কোচিং ব্যবসার উড়ন্ত সূচনা করেছে। সচ্ছল অভিভাবকদের উপর মোটা অংকের ফি চাপিয়ে মাসে আয় করছে লাখ লাখ টাকা, যার ফলাফলে তারা অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন করেছেন ঠিকই, কিন্তু হারিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে প্রাপ্য মহামূল্যবান মর্যাদা।

কয়েক দশক আগে যখন নোটবই পড়া নিষিদ্ধ করা হয়, তখন ওই ব্যবস্থা গ্রহণের পেছনে যুক্তি ছিল একটাই, সংক্ষিপ্ত পথে অর্থাৎ নোট বইয়ের সাহায্যে পরীক্ষায় পাস চলে, কিন্তু জ্ঞানার্জন হয় না। তাই টেক্সট বই পড়ার দিকে ছাত্রদের টেনে আনতে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নোট বই নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ এখন চলছে নোট বইয়ের চেয়ে ক্ষতিকর “কোচিং”, কথাটি আজ বহুল প্রচলিত। এতে অভিভাবকদের পকেটে টান পড়ছে আর শিশু নিজের অজান্তেই চিত্তবিনোদন বলে আর কিছু নেই। সেই সাত সকালে চোখ মুছতে মুছতে স্কুলের কোচিং তারপর ক্লাশ তারপর আবার কোচিং তারপর বাড়ি তারপর…………..।

২০১২ সালের ২০ জুন মাসে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওই বছরের ২৫ জুন নীতিমালায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে সব বিষয়ের জন্য স্কুলভিত্তিক কোচিং ফি সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে তারা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানের অনুমতিসাপেক্ষে অন্য স্কুল, কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠানে দিনে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। কোনো কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নিয়েও কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা যাবে না।

তবে নীতিমালা বাস্তবায়ন নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোচিং বন্ধে নীতিমালা ঘোষণা করলেও তা বাস্তয়নে যেভাবে পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল তা নিতে পারেনি শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

অভিভাবকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, লোক দেখানো এই নীতিমালা রেখে লাভ কার? এখন ৫ম ও ৮ম  শ্রেণিতে নিয়মিত কোনো ক্লাস নেই, যা হচ্ছে তার পুরোটাই কোচিং। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ভালো ফলের অজুহাতে বাধ্যতামূলক কোচিং করানো হচ্ছে। কোচিং ফি নির্ধারণ হচ্ছে ইচ্ছেমতো। এই কোচিং থেকে যা আসে তার পুরোটাই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও জড়িত শিক্ষকরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। আর নিয়মিত টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে শুধু অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন।

এক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে শহরে মাসিক সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা, জেলা শহরে ২০০ টাকা ও উপজেলা বা স্থানীয় পর্যায়ে ১৫০ টাকা করে রসিদের মাধ্যমে ফি গ্রহণ করা যাবে, যা সর্বোচ্চ ১২০০ টাকার বেশি হবে না। একটি বিষয়ে মাসে সর্বনিম্ম ১২টি ক্লাস অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি ক্লাসে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারবে।

সংগৃহীত ফি প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়ন্ত্রণে একটি আলাদা তহবিলে জমা থাকবে। প্রতিষ্ঠানের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সহায়ক কর্মচারীদের ব্যয় বাবদ ১০ শতাংশ অর্থ রেখে বাকি টাকা নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। কিন্তু নীতিমালার এ অংশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কোচিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুই থেকে ৩ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সবাইকে কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে।

আবার অনেক শিক্ষক স্কুল ক্যাম্পাসের মধ্যে ব্যক্তিগত কোচিং ব্যবসা খুলেছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা তুলে পুরো টাকা নিজেই আত্মসাৎ করছেন। আবার একটি অংশ প্রতিষ্ঠান প্রধানকে দিয়ে খুশি রাখছেন।

বর্তমান ছাত্ররা মেধাবী নয়, এ কথা ঠিক নয়। তাদের মেধার মান উন্নত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে, সার্বিক পরিবেশের কারণে তা তারা করতে পারে না। এটি সম্ভব স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক আর সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হোক সব কোচিং সেন্টার । স্কুলে ভালো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দেওয়া হোক, পড়ালেখার পরিবেশ উন্নত করা হোক। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচানো হোক।

-সাফাত জামিল শুভ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.