সাফাত জামিল শুভ: সাম্প্রতিক সময়ে একটি তথ্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে, প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পরবর্তী স্বীকার হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এদেশের পার্শ্ববর্তী ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা শুধু শোনা আর দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি, কিন্তু এর ভয়াবহতা সম্পর্কে উপলব্ধি করছি না কেউই। বরাবরের মতোই প্রতীয়মান হয়েছে, এদেশের মানুষ তাগিদ ‘অনুভব’ করার আগ পর্যন্ত কিছু করে না।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে, মারাত্নক একটি ভূমিকম্পের ব্যপারে অনেক দিন ধরেই সতর্কবাণী দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।১৮৬৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভয়াবহ বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে ৬ থেকে ৬ মাত্রার বেশী তিনটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল দেশের ভেতরেই।আবহাওয়া অধিদফতরের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ১৮৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতে (কেন্দ্র) ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এরপর ১৮৮৫ সালে সিরাজগঞ্জে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।১৮৯৭ সালের ১২ জুন ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ ভারতবর্ষে আঘাত হানে। এটা আজও পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর।
২০০৫ সালে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটনে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তাতে বলা হয়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ৮ বা তারও বেশি তীব্রতার ভূমিকম্প হতে পারে। তাও আবার একটি-দুটি নয়, এ ধরনের অন্তত সাতটি ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ওই তারবার্তাটি পাঠান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ চামাস। সম্প্রতি বিকল্পধারার গণমাধ্যম “উইকিলিকস” অন্য অনেক তারবার্তার সঙ্গে এটিও ফাঁস করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বছর দেড়েক আগে আমাদের একটি গবেষণা শেষ হয়েছে। সেখানে আমরা দেখিয়েছি রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৯ মাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে শুধু রাজধানীতেই আড়াই লাখ লোক মারা যেতে পারে। ৪ শতাধিক ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। নেপালে যেটা ঘটেছে আমাদের অবস্থা হতে পারে তার চেয়েও ভয়াবহ।’
আমরা জানি, পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দু’টি প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল, দু’টি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়।আমাদের পৃথিবী ৭টি প্লেটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের আশেপাশেই অবস্থান করছে ৩টি প্লেট। এইসব প্লেটের সংঘর্ষের কারনেই সৃষ্টি হয় ছোট, বড় অথবা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের।বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মায়ানমারের টেকটনিকপ্লেটের মধ্যে। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ভারতীয় ও ইউরোপীয় প্লেট দুটি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরনের নড়াচড়া বা ভূমিকম্পের। বিশেষ করে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকের ফল্ট লাইন (ভূচ্যুতি, টেকটোনিক প্লেটের সচলতার কারণে এই ফল্ট লাইন তৈরি হয়) সক্রিয় থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে পুরো উপমহাদেশীয় এলাকা।সাম্প্রতিককালের ভূমিকম্প প্লেট দুটির সেই বড় ধরনের নড়াচড়ার প্রমাণ। এর আগে একই ফল্ট লাইনের উত্তরপ্রান্তে পাকিস্তান ও পূর্বপ্রান্তে আন্দামান সাগরে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ায় এখন মধ্যাঞ্চলের বাংলাদেশ সীমান্তে যে কোন সময় শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে।
আমাদের চারপাশের পৃথিবীর ধারক প্লেটগুলোর অবস্থান আজ এমন হয়ে গেছে যে প্রতিদিন বৈশ্বিক উষ্ণতা, আবহাওয়া পরিবর্তন সহ বিভিন্ন কারনে পরস্পরের দিকে বছরে ২মিমি করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। খুব অচিরেই আমরা নেপালের বর্তমান পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। নেপালে যা ঘটেছে, তা আমাদের জন্য সতর্কবাণী। এখন কথা হল কিসের সতর্কবাণী? আমরা কি এখন ভূমিকম্প ঠেকাবো? নাকি ভূমিকম্প মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহন করব ?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নেপালের প্রলয়ংকারী ভূমিকম্প সেদেশের মানুষের কাছে অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। কারণ ভূমিকম্প হবে এটা তাদের ৮০ বছরের লালিত চিন্তা। এজন্য সেদেশে ভূমিকম্প প্রতিরোধে ২.৫ তালার বেশি উঁচু স্থাপনা করা সরকারীভাবে নিষেধ ছিল আর তাদের মানসিক প্রস্তুতিও ছিল অন্যরকম। তবুও নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু ও পোখারার মাঝখানে লামজুং এলাকায় ৭.৯ মাত্রার এই উৎপন্ন ভুমিকম্পে মারা গেছেন প্রায় ৮৫০০জন মানুষ আর আহত হয়ে হাসপাতালে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন প্রায় ১৫০০০জন। নেপালে এখন আর এমন কোন স্থাপত্য নেই যা ক্ষতির মুখ দেখেনি। পাশাপাশি হিমালয়ে তুষারধ্বস, মাটিতে ফাটল ইত্যাদিতো রয়েছেই। নেপালে বর্তমান ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ৫০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মানুষের থাকার জায়গা নেই, খাবার পানি নেই, বিনা ঔষধে তারা এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। নেপাল এখন আর নেপাল নেই। হিমালয় কন্যা পরিনত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। চারিদিকে শুধু পোড়া মাংসের গন্ধ। সবাই যেন তার আত্মীয়ের মৃতদেহটাকে পোড়াতে পেরেই কর্তব্য যথাযথ হয়েছে বলে মনে করছে। ইতোমধ্যে অনেক দেশ তাদের ত্রান নিয়ে পৌঁছেছে। তারাও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। এটি ছিল বর্তমান নেপালের উপরিচিত্র।
কিন্তু আজ ঢাকা শহরের আকাশচুম্বী শত শত স্থাপনার ভীড়ে আমাদের মনের অজান্তেই হারিয়ে গেছে সেরকম বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করার মানসিকতা। নির্মম হলেও সত্য বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা যেমন আবেগপ্রবন তেমনি এরকম মহাদুর্যোগে, মানসিকভাবেও ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনাও প্রবল।
বাংলাদেশ নেপালের তুলনায় অনেক বড় রাষ্ট্র। তাই আগে জানতে হবে ভূমিকম্পকালীন সময়ে নেপাল কিরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে আর তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে কি করতে হবে।যদিও বাংলাদেশে তেমন ক্ষতি হয়নি, তবে এগুলো আমাদের জন্য অনেক বড় পূর্বাভাস। এটা সহজেই অনুমান করা যায়, সেরকম বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকায় ভয়ানক মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। কারণ ব্যস্ততম এ নগরীর অনেক স্থাপনাই “বিল্ডিং কোড” অমান্য করে অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত।জাতিসংঘের এক জরিপে বিশ্বের ২০টি ভূ-তাত্তিক ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে অন্যতম হল আমাদের ঢাকা। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অধীনে ‘রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনস্ট সিসমিক ডিজাস্টার (রেডিয়াস)’ এই জরিপ পরিচালিত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় নেপালের মত ভূমিকম্প হলে ৮০% ভবন মাটির সাথে মিশে যাবে। নেপালে অসংখ্য ফাঁকা জায়গা ছিল আশ্রয় নেয়ার মত, কিন্তু ঢাকায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আশেপাশে বহুতল ভবন ছাড়া ফাঁকা স্থান আছে কি?
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের স্থাপনাগুলোর অবস্থা এমন কেন? তার কারনও স্পষ্ট-আমরা উচ্চভিলাষী মনাকাংখা পূরণ করতে যেয়ে স্থাপনা তৈরির বিধি-বিধান না মেনে ৫ তলার স্থাপনাকে ৮ তলা অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে তারও বেশি বানিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেছি। আজ হয়ত ব্যবসা অথবা বেশি বাড়ি ভাড়া পাবার আশায় এই নিয়মটি ভেঙ্গে কাজ করলাম কিন্তু মৃত্যু হচ্ছে কার?
সচেতন নাগরিকের মাথায় অবশ্যই প্রশ্ন আসতে পারে,স্থাপনার কি পুনরায় নতুন করে সংস্কার সম্ভব?
হ্যাঁ, বুয়েট দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অধিকাংশ স্থাপনাই পুনঃসংস্করন করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব, আর ধারনা করা হচ্ছে, প্রায় ৫৫০০টি স্থাপনা সম্পূর্ণ নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। স্থাপনা তৈরী করার সময় সমস্ত বিধিবিধান মানার জন্য প্রশাসনের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।নিজেদের অবহেলার কারনে আমরা কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মৃত্যুর মুখে রেখে যাব?
ভূমিকম্পের সময় আরেকটি আতংক চুলার আগুন।নেপালে চুলার জন্য গ্যাস সরবরাহ করা হত সিলিন্ডারের মাধ্যমে।কিন্তু আমাদের দেশে অসচেতনভাবে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা অথবা তাতে কাপড় শুকানো মানুষের নিয়মিত অভ্যাস।ভূমিকম্পের সময় দৌড়ে জীবন বাঁচানোর মুহূর্তে চুলা নেভানোর কথা কি মাথায় থাকবে? কোন কারনে যদি আপনার ঘর থেকে বিল্ডিংয়ে আগুন ছড়িয়ে যায়, তখন আশেপাশের কয়টি বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় তখন আপনার আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস কি আসতে পারবে? নেপাল ছেড়ে এবার আমাদের পুরান ঢাকা নিয়ে ভাবুন। দৃশ্যটি চোখের সামনে চিন্তা করতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। সেখানে নেপালের থেকেও খারাপ অবস্থা অপেক্ষারত।
আমাদের দেশে রানা প্লাজার ঘটনায় উদ্ধার কাজ শেষ হতে লাগল ৪২টি দিন। ঢাকায় যদি নেপালের মত ধবংসপুরী হয় সেটা কি আমরা ৫ বছরেও কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারব? ঢাকা শহরে অধিকাংশ স্থাপনা ৫-৭তলার বেশি। ভূমিকম্পের সময় যদি কেউ অফিস কিংবা বাসা থেকে রাস্তায়ও নেমে আসে, তখন অন্য আরেকটি বহুতল ভবন নিজের উপর ধসে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কি?
বাংলাদেশের জনসংখ্যা নেপালের তুলনায় অনেক বেশি আর জনসংখ্যার ঘনত্বও বেশি। আমাদের ঢাকা শহরে বাস করে ১.৫ কোটিরও বেশি লোক। নেপালের মত ভূমিকম্পে ঢাকায় মৃত মানুষের সংখ্যা গুনতে হবে প্রায় ১৫ লক্ষ।
শুধু ঢাকার চিত্রই যদি এমন হয় তবে একবার ভাবুন পুরো বাংলাদেশের চিত্র কেমন হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হবে সিলেট অঞ্চল কিন্তু এর গভীরতা বা ব্যাপ্তি কতখানি হবে সে সম্পর্কে বলতে গেলে শুধু জানা যায় যে এটি অনেক ভয়াবহ আকার নিবে।
অনেক স্টাডি বলছে, ঢাকা শহরে একটি ছয় মাত্রার ভূমিকম্প হলেই হাজার হাজার মানুষ মারা যাবে।মানহীন হাই-রাইজ এবং লো-রাইজ বিল্ডিং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প তো অনেক দুরের ৬ মাত্রার উপরে ভূমিকম্পে ঢাকা বা সিলেট শহরের অনেক ভবন তলিয়ে পরবে। ৭ মাত্রা হলে ঢাকার ৭০% ভবন ধ্বসে পরবে। আর ডওকি ফল্ট যদি একটা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প পাঠায় তবে, হয়তো এই বাংলাদেশের বাঙালি সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে কিনা তাই চিন্তার বিষয়। নেপালের মত ছোট রাষ্ট্রের যদি ক্ষতির পরিমান ৫ মিলিয়ন ডলার হয় তবে বাংলাদেশের তা কত হতে পারে? আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে তা কি কাটিয়ে উঠা সম্ভব? তাই আসুন সময় থাকতে সচেতন হই। আমাদের দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাই।
-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়