মাতালের কাছে রাজপথও হয়ে ওঠে বন্ধুর

মাতালের কাছে রাজপথও হয়ে ওঠে বন্ধুর

M_Id_361494_Crimeসৈয়দ জাহিদ হাসান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) লেখায় পড়েছিলাম ‘যাহাতে মনুষ্যত্বের অপমান হয় তাহা কখনোই উন্নতির পথ হইতে পারে না’। চারদিকের অবস্থা দেখে আজ বার বার এই কথাটিই ঘুরেফিরে মনে পড়ছে। পত্র-পত্রিকার পরিসংখানে দেখা যাচ্ছে বা দেখানো হচ্ছে বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছেটা কোথায়? ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরীতে? বিচারহীন অন্ধকারে? প্রতিকারহীন স্বেচ্ছাচারিতার দিকে? নাকি গুপ্তহত্যার ও প্রকাশ্য হত্যার নির্দয় ভূমিতে? কিছু কিছু বিষয়ে বর্তমান সরকারের সাফল্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু একটা বিষয় সরকারকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবেÑ সরকারের সব উন্নয়ন প্রচেষ্টাই জনসাধারণের সুখ-শান্তি আর নিরাপত্তার প্রয়োজনে। জনসাধারণ যদি সুখে-শান্তিতে না থাকে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে এবং এক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে ভুগতে মানুষকে যদি বাড়ির গেইটের সামনে থেকে চাপাতির কোপে প্রাণ দিতে হয়, বেডরুমে ঘুমন্ত অবস্থায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে থাকতে হয়, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়-মোল্লা, পুরোহিত পাদ্রিকে প্রার্থনারত অবস্থায় ঘাতকের ছুরিকাঘাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়, তাহলে সেই দেশের উন্নয়নকে ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কি ভাবা যায়? উন্নয়ন বলি আর অগ্রগতিই বলিÑ সবই করা হয় জনসাধারণের মঙ্গলার্থে, জনসাধারণই যদি একের পর এক মরতে থাকে, তাহলে এই উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে কে? তারচেয়ে কি এটাই ভালো নয় যে, উন্নয়ন চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে জনগণের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করা?

আমাদের দেশে কয়েকদিন আগে ছিল ভূমিকম্পের আতঙ্ক। সবার ভেতরেই ভূমিকম্পের বিভীষিকা দারুণ এক উত্তেজনা ও আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। ভূমিকম্পের আতঙ্কে অনেককেই দেখেছি পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে। ভূমিকম্পের ভয়াল রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে ‘চাপাতির আতঙ্ক’। এই চাপাতির আতঙ্ক থেকে বাঁচতে হলে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। কিন্তু তা কি সবার পক্ষে সম্ভব? চাপাতির ধার যাকে দিয়ে প্রথম পরীক্ষা করা হয় তার নাম প্রথাবিরোধী লেখক ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ূন আজাদ। হুমায়ুন আজাদ মরতে মরতেও বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন মৌলবাদীরাই তাকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছিল। সেদিন তার কথা আমরা অনেকেই বিশ্বাস করিনি। তারপর একে একে খুন হলোÑ রাজিব, নীলাদ্রি, সুমন, অভিজিৎ, দীপন থেকে শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীসহ পরমানন্দ রায়, জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়।

দিনে দিনে এই মৃত্যুর মিছিল আরো কত দীর্ঘ হবে কেউ বলতে পারছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে মৌলবাদী ও উগ্রপন্থী ছাড়া আর কেউ-ই চাপাতির আক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। যে দেশে বসবাস করতে হলে দিন-রাত চাপাতির ভয়ে থাকতে হয়, যে দেশে লেখালেখি কিংবা সংস্কৃতি চর্চা করলেই উগ্রপন্থীদের শিকারে পরিণত হতে হয়, বিদেশি নাগরিককে বিনা কারণে হত্যা ও ধর্মীয় গুরুদের ধর্মালয়ে মেরে ফেলা হয়, সে দেশে বাস করা রীতিমতো নরকে বাস করাই বটে। নরকে কে বাস করতে চায়? আমরাও চাই না। আজ মানুষ জানতে চায় ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা কি মাতাল? তাহলে তাদের আচার-আচরণ মাতালের মতো কেন? বাংলাদেশ মূলত বিচারহীনতার দেশ। এ দেশের মানুষের মধ্যে বিচার প্রতিষ্ঠার প্রবণতা সাংঘাতিকভাবে কম। এদেশে জাতির পিতার হত্যার বিচার হয়েছে ৪০ বছর পরে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবস্থাও তাই। জাতীয় চারনেতা হত্যার বিচার অন্ধকারে, দুই খুন, তিন খুন, সাত খুন পর্যন্ত বরফ হয়ে জমে থাকে অভিনব বিচার কক্ষে। দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আজ আমরা প্রত্যেকেই মাতাল হয়ে গেছি। মাতাল মানুষের কাছে কোনো কিছুই সুস্থ-স্বাভাবিক ঠেকে না। সব কিছুকেই সে এলোমেলো আর অস্বাভাবিক দেখে। আমরা এখন পার করছি মাতাল সময়।

আজ বাংলাদেশে কবি-সাহিত্যিক-অধ্যাপক, উকিল, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ব্যাংকার, বিচারক নিরাপদ নয়, শিশু-কিশোর, তরুণ নিরাপদ নয়, যুবতী, মধ্যবয়স্কা, বৃদ্ধাও নিরাপদ নয়। সমাজের উপরতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত আজ শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক। মনোবিজ্ঞান বলে, যে মানুষ সব সময় আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটায় তার মানসিক বিকাশ বিঘিœত হয়। তাহলে কি আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি মানসিক বৈকল্যের দিকে? দিনরাত মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে ভুগে আমরা সবাই হয়ে উঠছি ‘ মানসিকভাবে মাতাল জাতি’। আমাদের এই মাতলামি পরিহার করা দরকার। সংঘাত নয়, আমরা সংহতি চাই, মৃত্যু নয় আমরা মিতালি চাই, পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডগুলোর সুষ্ঠু বিচার হলে পরবর্তী হত্যাকাণ্ডগুলো হয়তো সংঘটিত হতো না। বিচারহীনতা এক অর্থে বিচারকে অস্বীকার করাই। স্বাভাবিক মানুষ সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে থাকে, মাতাল মানুষ এগুলো এড়িয়ে চলে। স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে মাতাল মানুষের সংস্পর্শ শুধু সংঘাতকেই উস্কে দিবে। তাই দেশ-জাতির স্বার্থে মাতালকে দণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। কোনো ভয়ে বা কারো নির্দেশে এই ধর্মান্ধ মাতালদের করুণা করলে দেশকে এরা কঠিন করে তুলবে।

২৬ এপ্রিল, ২০১৬
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.