চিরবিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রোর প্রয়াণ ও ইতিহাসের শাপমোচন

চিরবিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রোর প্রয়াণ ও ইতিহাসের শাপমোচন

মোনায়েম সরকার: ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে নব্বই বছর বয়সে বর্ণাঢ্য বিপ্লবী জীবনের ইতি টেনে চিরবিদায় নেন কিউবান বিপ্লবী নেতা ফিদেল আলেজান্দ্রো ক্যাস্ট্রো রুজ। অবশ্য পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি ফিদেল ক্যাস্ট্রো নামেই পরিচিত ছিলেন। এক ভূস্বামী পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। পিতা ছিলেন আখের খামারী। মা ছিলেন একেবারে আটপৌরে নারী। ভূস্বামী পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি আজীবন লড়াই করেছেন নিরন্ন-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। প্রতিক্রিয়াশীল পরিবেশে বেড়ে উঠেও তিনি হয়েছেন প্রগতিশীল চেতনার মুক্ত মনের মানুষ। সারা জীবন লড়াই জারি রেখেছেন সর্বহারা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। কিভাবে এটা সম্ভব হলো? সম্ভব হলো এই কারণে যে, যৌবনেই তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন মার্কসবাদে। মার্কসবাদই তাঁকে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লড়াই করার মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছে।

শৈশব থেকেই ফিদেল লক্ষ্য করেছেন সমাজে একদল মানুষ আছে যারা কোনোদিনই মানুষের অধিকার নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এরা কম খায়, জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে, কিন্তু কাজ করে সবার চেয়ে বেশি। এই অল্পে তুষ্ট শ্রমজীবী মানুষগুলো নিজের গায়ে ধূলি লাগিয়ে, কাদা-জলে জীবন কাটিয়ে সমাজের উঁচু তলার মানুষগুলোকে সেবা দিয়ে যায় কিন্তু তাদের ভাগ্যে কখনোই এতটুকু সম্মান বা সমাদর জোটে না। এই ধূলিমলিন মানুষগুলোই সভ্যতার নির্মাতা, এদের বুকে পা ফেলেই আসে নব উত্থান। এই অবহেলিত মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীর খাতায় নাম লেখেন ফিদেল। পরবর্তীতে তিনিই হয়ে ওঠেন অবিনাশী বিপ্লবী বীর।

পঁচাত্তর পরবর্তী কালপর্বে আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে কলকাতা চলে যাই। সেসময় আমার হাতে দিল্লীতে একটা অনুবাদ সংকলন আসে যে বইটির নাম ছিল হিস্ট্রি উইল অ্যাবসোলভ মি। এই বইটির বাংলা নামকরণ করা হয়, ‘ইতিহাস আমার শাপমোচন করবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ভারতের বেশ কয়েকটি ভাষার সংকলন ছিল বইটিতে।

১৯৫৩ সালে ফিদেল তাঁর গেরিলা বাহিনী নিয়ে মনকাডা আর্মি ক্যাম্পে হামলা চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। তখন একনায়ক বাতিস্তা সরকার তাঁর বিচার শুরু করেন। মনকাডা হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিদেল যে জবানবন্দী দিয়েছিলেন সেই জবানবন্দীই হিস্ট্রি উইল অ্যাবসোলভ মিনামে খ্যাত। ফিদেল আজ শুধু একজন বিপ্লবী ব্যক্তিত্বই নন, তিনি একটি আদর্শিক ইতিহাস ও কিংবদন্তি নায়ক। তাঁকে জানতে বা বুঝতে হলে আমাদের একটু অতীতে ফিরে যাওয়া দরকার। দরকার ইতিহাস ও মার্কসবাদকে বিশ্লেষণ করা। আমি সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই দুই-একটি কথা লেখার চেষ্টা করব।   

১৮৪৮ সালে যখন কাল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলের মতো দুই স্বাপ্নিক যুবক কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোপ্রণয়ন করেন তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি আর এখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি এক নয়। মার্কসও জানতেন পৃথিবী পরিবর্তিনশীল। তাই তিনি নিজেই বলেছিলেন- “Marxism is not a dogma, its a creative science”. কিন্তু তথাকথিত কমিউনিস্টরা এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। তারা গায়ের জোরেই যেন সব কিছু বদলে ফেলতে চায়। কিন্তু গায়ের জোরে আর যা কিছুই হোক বিপ্লব হয় না। আর হলেও সেই বিপ্লব স্থায়ী হয় না। ফিদেল মাত্র ৩৩ বছর বয়সে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে পরাজিত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। ৫০ বছরের অধিককাল তিনি ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ আর থাইল্যান্ডের রাজার পর তিনিই বিশ্বের তৃতীয় রাষ্ট্রনায়ক, যিনি দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন ফিদেল সুনাম-দুর্নাম দুটোই কুড়িয়েছেন। পৃথিবীতে যে সকল দেশে বিপ্লবীরা বিপ্লব করে ক্ষমতায় গিয়েছেন সে সকল দেশেই বিপ্লবীরা কিছু দুর্নামের ভাগি হয়েছেন। এর পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আঙুলি ইশারা তো থাকেই, ব্যক্তিগত লোভ-লালসাও পরবর্তীকালে বিপ্লবীকে পথ ভ্রষ্ট করে ফেলে। এক সময় কমিউনিস্টরা পৃথিবীর মানুষকে নতুন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ত্যাগী ও আদর্শবান প্রচুর নেতা ছিলেন। এসব নেতাদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিপ্লবের মাধ্যমে দখল করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধবাদীদের হয় গুলি করে হত্যা করেছেন, নয়তো কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ, সবখানেই দেখা গেছে একই ঘটনা।

এক সময় পৃথিবীতে দাসপ্রথা ছিল। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে সামন্ততন্ত্র এসে সেই জায়গা দখল করে নেয়। সামন্ততন্ত্রও একদিন পরাজিত হয় পুঁজিবাদের অভিনব কৌশলের কাছে। পুঁজিবাদ পুঁজির বিকাশের জন্য বাজার খুঁজতে থাকে। শুরু হয় একের পর এক দেশ দখল। ব্রিটিশ আমলে দেখা গেছে, ব্রিটিশ সূর্য অস্ত যায়নি। কেন যায়নি? যায়নি এই কারণে যে সারা পৃথিবীব্যাপীই ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল, এমনকি আমেরিকাও। ব্রিটিশের উপনিবেশ থেকে একেকটি দেশ যখন স্বাধীন হতে শুরু করে তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। আমেরিকা সরাসরি দেশ দখল না করে তারা দেশে দেশে তাদের অনুগত দালালগোষ্ঠী তৈরি করতে শুরু করে। এই দালালগোষ্ঠী দিয়ে তারা স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে বশংবদ সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় বসায় নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার ইন্ধনে সারা পৃথিবীতে প্রায় সত্তরটির মতো রাষ্ট্রে সামরিক শাসন ছিল। সেই সংখ্যা কমতে কমতে এখন অঙ্গুলিমেয় হয়ে পড়েছে। এখন তারা নিয়েছেন আরো ঘৃণ্য পথ। এই ঘৃণ্য পথে তারা তৈরি করছে বিপথগামী, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি। তালেবান, আল কায়দা, বোকোহারাম, আইএসের মতো সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করে এখন তারা দেশে দেশে সৃষ্টি করেছে ভীতিকর পরিস্থিতি। দেশে দেশে অনাসৃষ্টি করে তারা অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা করতে চায়। অস্ত্র ব্যবসা আমেরিকার সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এই অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ হলে আমেরিকারও বারোটা বাজবে। তাই অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে রাখা ছাড়া আজ আর কোনো গতি নেই।  

আমেরিকা তেল সম্পদের জন্য সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে হত্যা করেছে। তথাকথিত আরব বসন্তের নামে সিরিয়ায়ও চলছে আক্রমণ। মার্কিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা যে আগুন লাগিয়েছে সে আগুনের উত্তাপ এখন ইউরোপের গায়েও লেগেছে। আমেরিকার কোনো আদর্শিক চরিত্র নেই, তার চরিত্র হচ্ছে টাকা, টাকা…। আমেরিকা অনেক কিছু করতে পারে কিন্তু সবকিছু করতে পারে না। তারা হয়তো মনে করে পৃথিবীর সবদেশ তাদের কথায় উঠবে-বসবে, কিন্তু বাস্তবতা মোটেই সে রকম নয়, বরং ইহিাসে তার উল্টোটাই দেখি। আমেরিকার সাথে যারা হাত মিলিয়েছিল তারা বেশিরভাগই আজ শেষ হয়ে গেছে বা শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যেমন ইরান ও পাকিস্তান তারা সেল্টো সিয়েটোতে যুক্ত ছিল। আর যারা বুক ফুলিয়ে আমেরিকাকে রুখে দাঁড়িয়েছে তারাই বিজয়ী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হো চে মিনের ভিয়েতনাম, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবা, হুগো শ্যাভেজের ভেনিজুয়েলা ও ইভো মোরালেসের বলিভিয়ার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। আমেরিকার নানামুখী ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে এই সব বিপ্লবী নেতারা যেভাবে আমেরিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে তা এক নতুন ইতিহাসই বটে।

আমেরিকা, ও.আই.সি, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে যুদ্ধ পরিস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আমেরিকা আজ যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খোলার চেষ্টা করছে। ইউক্রেন, ক্রিমিয়াতে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছে। সে সব দেশের ষড়যন্ত্রকারীদের মদদ দিচ্ছে। আমেরিকার আচার-আচরণ থেকে মনে হয়, ন্যাটোর মাধ্যমে শীতল যুদ্ধ বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর পাঁয়তারা করছে।

পৃথিবী এখন আর এক নায়কের শাসন চায় না, চায় না এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাও। যে নামেই হোক না কেন একনায়ক অবশ্যই ভয়ঙ্কর। এক সময় সেও ক্ষমতার মোহে যা ইচ্ছে তাই করে বসে, যেমন করে এক কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা। পৃথিবীর সব মানুষই আজ ক্ষমতার ভারসাম্য দেখতে চায়। আমেরিকার অপ্রতিরোধ্য গতি কিছুটা হলেও এ মুহূর্তে মন্থর মনে হচ্ছে। নবনির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি উল্টা-পাল্টা কিছু করেই বসে, তাহলে ভাবতেই হবে আমেরিকার রক্ত দিয়ে হোলি খেলার যুগ শেষ হতে চলেছে বা পুনরায় শুরু করবে।

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমান বিশ্ব একটা নতুন আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কেন বিশ্ববাস্তবতা নতুন আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা চায় তারও একটা যৌক্তিক কারণ আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতা। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিমানুষকে যে পরিমাণ নির্লোভ আর পরার্থপর হওয়া দরকার তা কি একবিংশ শতাব্দীর অতৃপ্ত, লোভী মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব? ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, যা হয়েছে সমাজ প্রগতির ধারাতেই হয়েছে, যা হবে তাও সমাজ প্রগতির স্বাভাবিক ধারাতেই হবে। সমাজ প্রগতির ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে মানুষ শুধু নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেবে না। সঙ্গে সঙ্গে মানব সভ্যতার পতনও ডেকে আনবে। প্রকৃতি ও ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে চলে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির এই সত্য কথাটা উপলব্ধি করা একান্ত জরুরি। সারা বিশ্বের মানুষ আজ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা (Humane world order) কামনা করছে। মানুষকে তার কাক্সিক্ষত সমাজ ব্যবস্থা অবশ্যই দিতে হবে।

ইউরোপের দেশগুলোকে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র বলা হয়। এসব দেশে নাগরিক অধিকার অনেকাংশেই সুরক্ষিত। কল্যাণ রাষ্ট্রের উদ্ভব সমাজতন্ত্রকে সামাল দিয়ে সমাজ বির্বতনের সঙ্গে তাল মিলানোর চেষ্টা। তাই যদি হয়, তাহলে বলবো, এটাও একটি বড় মাপের ঐতিহাসিক পরিবর্তন। এমন পজেটিভ পরিবর্তন দেখে কার্ল মার্ক্স কী বলতেন জানি না, কিন্তু এই পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই লেলিন, মাও, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো লড়াকু মানুষের প্রয়োজন ছিল।

ফিদেল ক্যাস্ত্রের জীবনীকার গেওর্গি এন গোয়ার ফিদেলকে বলেছিলেন, ‘সত্যিকার অর্থে শেষ কমিউনিস্ট।ফিদেল শেষ কমিউনিস্ট কিনা জানি না, তবে আধুনিক কিউবা তার কাছে অনেক কারণেই ঋণী। দীর্ঘজীবী এই প্রয়াত চিরবিপ্লবীর প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। 

৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.