মোনায়েম সরকার: ২৭ জানুয়ারি, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মৃতুবার্ষিকী এক যুগ পার হলো। ২০০৫ সালের এই দিনে নিজের নির্বাচনী এলাকায় এক বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় তিনি নিহত হয়েছিলেন। বহু বছর অতিক্রান্ত হলেও কিবরিয়া হত্যা-রহস্য উন্মোচিত হয়নি, বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি মূল অপরাধীদের। তৎকালীন সরকারের ভূমিকা শুরু থেকেই ছিল রহস্যাবৃত। একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার জন্য যেমন প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তেমনি গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত কিবরিয়া সাহেবকে হেলিকপ্টার দিয়ে ঢাকায় এনে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। গ্রেনেড হামলার রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সরকারের ছিল অনীহা। প্রকৃত ঘাতকদের আড়াল করার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ শুধু কিবরিয়া পরিবার থেকে নয়, সচেতন সব মহল থেকেই তোলা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ছিল নির্বিকার। তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে, মানুষের চোখে ধুলা দেয়ার জন্য, বিভ্রান্ত করার জন্য নানা বাহানা করা হয়েছে, সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিরোধী দলের ওপরই দায় চাপাতে চেয়েছে। এসব কারণে অনুমান করা হচ্ছিলো যে, তৎকালীন সরকার ওই হামলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদদাতা।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে তার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক শক্তিকে নির্মূল করার এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই জোট সরকারের আমলে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মতো নির্বিরোধ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই সময় দেশে যে রাজনৈতিক হিংস্রতার বিস্তার ঘটেছিল তারই করুণ শিকার হয়েছিলেন কিবরিয়া সাহেব। তিনি প্রথাগত রাজনীতিক ছিলেন না, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব ছিল না, হিংসাশ্রয়ী রাজনীতিকে ঘৃণা করতেন তিনি। অথচ হিংসা ও ঘৃণার অপরাজনীতির শিকার হলেন তিনি। কিবরিয়ার ঘাতকদের বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া না হলে আমাদের রাজনীতি কলঙ্কমুক্ত হতে পারবে না। আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার প্রিয় দল আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তাই বর্তমান সরকার কিবরিয়া হত্যার নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করবে বলেই এখন দেশবাসী মনে করে।
শাহ এ এম এস কিবরিয়ার প্রতিভা, যোগ্যতা ও সততা ছিল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তার মতো বড় মাপের মানুষ আমাদের দেশের রাজনীতিতে খুব বেশি নেই। ছাত্রজীবনে তিনি বরাবরই ছিলেন কৃতিত্বের অধিকারী। কোনো পরীক্ষাতেই তিনি দ্বিতীয় হননি, প্রথম স্থানটি ছিলো তার জন্য নির্ধারিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন, পরে কূটনীতিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার পর ধাপে ধাপে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়েছেন। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। দীর্ঘ প্রায় এক দশক জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেলের মর্যাদা-সম্পন্ন নির্বাহী সচিব এবং এসকাপের মহাসচিবের গুরুদায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। ১৯৮৬ সালে কাম্পুচিয়ায় জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধির অতিরিক্ত দায়িত্বও তিনি পালন করেছিলেন।
চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়ে ১৯৯১ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দলের সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। নিজের মেধা ও প্রজ্ঞার গুণেই তিনি এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির তিনি ছিলেন প্রধান সমন্বয়কারী। তার দক্ষ ও সৃজনশীল পরিকল্পনা ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সম্ভব করে তুলেছিলেন। দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে সফল ছিলেন সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। ২০০১ সালের নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যয় হলেও তিনি হবিগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তার কারণেই হবিগঞ্জ জেলার চারটি আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।
জীবনের দীর্ঘ সময় কূটনীতিক হিসেবে পাকিস্তান আমলে কলকাতা, কায়রো, নিউইয়র্ক জাতিসংঘ মিশন, তেহরান আরসিডি মিশন, ইসলামাবাদ পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ওয়াশিংটন ডিসি-তে পাকিস্তান দূতাবাসে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিভাগে মহাপরিচালক হিসেবে ও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার, জেনেভায় জাতিসংঘের ইউরোপীয় অফিসে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিরূপে দেশের বাইরে কাটালেও দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি শামস কিবরিয়ার ছিলো গভীর মমত্ববোধ।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ একজন আধুনিক মানুষ। তিনি ধর্ম ও রাজনীতিকে একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। দেশে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাইতে মাদ্রাসার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মাদ্রাসা শিক্ষায় দ্রুত সংস্কার না আনলে তার পরিণতি ভালো হবে না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, উগ্র সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশকে একটি তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়ে সংগঠিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে। এই গোষ্ঠীটি যে ক্রমেই দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এ ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি সংবাদপত্রে একাধিক কলাম লিখেছেন। তার আশঙ্কা যে অমূলক ছিলো না সেটা দেশের নানা ঘটনা থেকে আমরা এখন নিশ্চয় হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া যেমন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তেমনি বহুধরনের কর্মকা-ে নিজেকে জড়িত রাখতেও তিনি পছন্দ করতেন। বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর) এবং সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ তার প্রতিষ্ঠিত দু’টি সংগঠন। বিএফডিআর এবং মৃদুভাষণের জন্য তিনি যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, শ্রম দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এই দুই সংগঠনের প্রাণপুরুষ। তার অবর্তমানে বিএফডিআর নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। বিএফডিআর এখনো চালু আছে তিন হাজার পাঁচশ’ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বাড়িতে। বিএফডিআর এ বছর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অমর একুশের গ্রন্থমেলায় ১০ হাজার কপি ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র ইতিহাস’ ও ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালপঞ্জি’ বিনামূল্যে বিতরণ করবে।
বইমেলা ২০০৪ এ প্রকাশিত তার বই ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য’ উপহার দেওয়ার সময় লিখেছিলেন, ‘পরম সুহৃদ বন্ধুবর মোনায়েম সরকারকে’। শেষ বারের মতো হবিগঞ্জ যাওয়ার আগের রাতেও ফোনে আমাদের কথা হয়। আমি কিছুটা অনুযোগ করে বলেছিলাম, অসুস্থ শরীরে এতো দৌড়-ঝাঁপ না করলে হতো না! তিনি বললেন, ‘এই তো যাবো আর আসবো।’
২৭ জানুয়ারি রাত ৮টায় যখন সেই দুঃসংবাদ এলো, বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। তার তো হবিগঞ্জ থেকে ফিরে শুক্রবার সকালে আমাকে নিয়ে অফিসে বসে ‘মৃদুভাষণে’র কভার ডিজাইন ফাইনাল করার কথা। ৩১ জানুয়ারি সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ আয়োজিত সেমিনারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে সেখানে তার মূল প্রবন্ধ পাঠ করার কথা। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি এ নিয়ে সিরিয়াস লেখালেখি করছিলেন চির প্রয়াণের শেষের দিনগুলিতে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানও চেয়ে নিয়ে এ বিষয়ে তার একটি লেখা ছাপালেন শেষ যাত্রার আগের দিন। আমি প্রস্তাব করেছিলাম এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটা সেমিনারও করি। তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেমিনার পেপার তৈরি করলেন। মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় ছিলো। ওই বয়সেও দ্রুত লিখতে পারতেন কিবরিয়া ভাই। তার ইংরেজি লেখাও ছিলো চমৎকার। সারাজীবন ইংরেজি ভাষায় লিখতেন দেশে বিদেশে। চির অভ্যাস মতো তিনি সেমিনার পেপার ইংরেজিতেও তৈরি করে দিয়ে গেলেন। ফোনে তার সঙ্গে সেমিনারের প্রস্তুতি নিয়েও কথা হলো। কিন্তু সিরডাপ মিলনায়তনে ৩১ জানুয়ারি সেমিনার আর করা হলো না। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও কিবরিয়া সাহেবের মতো এমন অসামান্য মেধা, দক্ষ ও যোগ্য অর্থমন্ত্রী বাংলার ইতিহাসে আর হবে কিনা এ নিয়ে আমার মনে এখনও সংশয়।
জ্ঞান ও যোগ্যতার শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন বলেই কিবরিয়া সাহেবকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য মাস্তান বা ক্যাডার বাহিনী ওপর নির্ভর করতে হয়নি। সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তার সব প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, গোষ্ঠীগত রাজনীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুস্থ ধারার রাজনীতির পক্ষে দেশের মানুষের চেতনাকে শাণিত করার জন্য নতুন প্রজন্ম শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জীবন থেকে পাঠ গ্রহণ করবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।
২৫ জানুয়ারি ২০১৭