বাইরে অসৎ সঙ্গ, ঘরে ব্লু হোয়েল

বাইরে অসৎ সঙ্গ, ঘরে ব্লু হোয়েল

সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাংলা ভাষায় ‘উভয় সংকট’ শব্দের অনেকগুলো বাগধারা আছে। তাদের একটি হলো ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’। যে মানুষটি স্থলে বাঁচতে পারছে না, হিংস্র বাঘের তাড়ায়, আবার জলের মাঝেও ঝাঁপ দিতে পারছে না কুমিরের পেটে যাওয়ার ভয়ে। তার মতো অসহায় আর দুর্ভাগা পৃথিবীতে কেউ হতে পারে না। আজ আমরা সকলেই উভয় সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করছি। এই উভয় সংকট হলো, ‘বাইরে অসৎ সঙ্গ, ঘরে ব্লু হোয়েল’।

একটি সুন্দর জীবন প্রতিটি মানুষই মনে মনে আকাক্সক্ষা করে। জন্মের সময় সব মানুষই নিরপরাধ হয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু সমাজ-সংসারে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে সে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। একজন মানুষ এমনিতেই অপরাধে জড়ায় না। এর পেছনে অনেক রকম কারণ থাকে। অপরাধবিজ্ঞানীরা নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে অপরাধের পেছনের কারণগুলো উদ্ঘাটন করে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। সেই অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ থেকে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি তাহলে অনেক অপরাধ থেকেই আমরা নিজেকে ও সমাজদেহকে মুক্ত রাখতে পারি।

আমরা যারা নাগরিক জীবনযাপন করি তারা আজ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি যে, নাগরিক শিশু-যুবদের জন্য বিনোদনের তেমন কোনো সুব্যবস্থা নেই। নগরের বেশিরভাগ স্কুল কলেজেই খেলার মাঠ নেই, নির্মল বিনোদনের সুযোগ নেই। উপরন্তু লেখাপড়ার চাপে শিশু  ও যুব মন বিকারগ্রস্ত হবার দশা। এ রকম উদ্ভট পরিস্থিতিতে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া, পরিত্যক্ত বা নির্মাণাধীন দালানে ড্রাগ নেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো পথ থাকে না।

একটি শিশু বা যুবক যখন যথার্থ সুযোগ না পেয়ে চোরাপথে পা বাড়িয়ে ধ্বংসের শেষ সীমায়  গিয়ে পৌঁছায় তখন তার আশ্রয় হয় ‘মানসিক হাসপাতালে’। কয়েকদিন চিকিৎসার পরে সে যদি সুস্থ হয়, তখন পরিবারের লোকজন তাকে গৃহবন্দি করে ফেলে। তারা তখন ভাবে ঘরে থাকলেই ওই বিপদগামী সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, কিন্তু তারা জানে না ঘরের কোণেও ওৎ পেতে থাকতে পারে যমরূপী ব্লু হোয়েল তথা নীল তিমির থাবা। মৃত্যু সর্বত্র বিরাজমান এ কথা সত্য বটে, তবে আমরা কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুকে মেনে নিতে চাই না। স্বচ্ছ-সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনযাপন করে আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর হাতেই নিজেদের সমর্পণ করতে চাই।

সম্প্রতি ‘ব্লু হোয়েল গেমস’ নামে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধকারী একটি গেমস ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সহজলভ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই ভয়ঙ্কর গেমস ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। ইতোমধ্যে যারা এই জীবনবিনাশী খেলা খেলেছে তারা বেশিরভাগই আত্মহত্যা করেছে। কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে বরণ করেছে পঙ্গুত্বের জীবন। যেই মানুষটি এই ‘ব্লু হোয়েল গেমস’ তৈরি করেছে তার একটি সাক্ষাৎকার পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, যারা হতাশাগ্রস্ত তাদের জীবনে মৃত্যু এনে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। তার সেই কুৎসিত উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধু কি হতাশাগ্রস্ত কিশোর-যুবকরাই ব্লু হোয়েল গেমস খেলে আত্মহত্যায় পা বাড়াচ্ছে? নাকি চ্যালেন্স গ্রহণ করতে গিয়ে অনেক সহজ-স্বাভাবিক-সাহসী কিশোর-যুবকও বেছে নিচ্ছে অসঙ্গত মৃত্যুপথ? প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষের জীবনের যে মূল্য, একজন স্বাভাবিক মানুষের জীবনেরও ঠিক একই মূল্য। তাহলে হতাশাগ্রস্থকে মৃত্যুর দ্বারে ঠেলে দেওয়া কেন? আমি যদি একজন দুর্বলচিত্তের বিকারগ্রস্ত মানুষকে সুন্দর জীবনের সন্ধান দিতে না পারি, তাহলে তাকে প্ররোচনা দিয়ে হত্যা করার অধিকার কি আমার আছে? নাকি থাকতে পারে?

শিশুকালে আদর্শলিপিতে পড়েছিলম, ‘অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো’,  কিন্তু আজ দেখছি ইচ্ছে করলেই অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা যাচ্ছে না। আজ আমাদের চারপাশেই নানাবিধ ‘অসৎ সঙ্গ’ ছড়িয়ে আছে। হোক তা বন্ধু-বান্ধবের আড্ডার আসর অথবা ব্যক্তিগত গৃহকোণ। এমন এক বিপদজনক মুহূর্তে কেমন করে সুস্থ ও সুন্দর থাকবে আমাদের আগামী প্রজন্ম সে কথা ভাবতে গেলেই চিন্তারাজ্যে ভিড় করে অসীম অন্ধকার।

‘চৈতালি’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রভাত’ নামে অসম্ভব সুন্দর একটি কবিতা আছে। প্রভাত বেলার গ্রামীণ প্রকৃতির কাব্যিক বিবরণ দিয়ে তিনি এই কবিতাটি আরম্ভ করেছেন, শেষ করেছেন ব্যক্তিজীবনের আত্মতৃপ্তি দিয়ে। কবি বলেছেন, ‘ধন্য আমি হেরিতেছি আকাশের আলো / ধন্য আমি জগতেরে বাসিয়াছি ভালো।’ পৃথিবীর সব মানুষই কি আকাশের জ্যোতির্ময় আলো দেখতে পায়? সব মানুষই কি জগৎকে, জীবনকে ভালোবাসতে পারে?

আমরা সকলেই আজ এমন এক যন্ত্রযুগ অতিক্রম করছি যে যুগে গোপনে-প্রকাশ্যে অনেক অনাকাক্সিক্ষত বিষয় এসে আমাদের সামনে অবলীলায় হাজির হচ্ছে। এসব অপ্রত্যাশিত যান্ত্রিক ও প্রযুক্তি প্রভাবিত দুর্যোগ থেকে নিজেকে এবং পরিজনকে নিরাপদ রাখাই এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সুন্দর কোনো বিকল্প পথ অবশ্যই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের কথায় আবারও বলতে চাই, ‘সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা / উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা’, আমরা নবসভ্যতার ভেসে আসা কালকূট পান করতে চাই না, আমরা কণ্ঠ ভরে অমৃত সুূধা পান করে অমর হতে চাই। অসৎ সঙ্গ বা ব্লু হোয়েলের খপ্পরে পড়ে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার পথে না গিয়ে এখন সময় অমরত্বের পথে এগিয়ে যাওয়া। হে আগামী দিনের শিশু, কিশোর, যুবক, তোমরা অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে সৎ সঙ্গের স্বর্গে বাস করো। ব্লু হোয়েল তোমার জীবনকে মুছে দেওয়ার আগেই তুমি তোমার ইলেকট্রিক ডিভাইস থেকে ব্লু হোয়েল মুছে দাও। অন্ধকারের হাতছানিতে নিজেকে নিঃশেষ না করে আলোকপিয়াসী হও। মূঢ়-চিত্তকে কঠিন কর্মের শাসনে বেঁধে কীর্তিমান হও। জীবন সার্থক হয় সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকায়, পঙ্কিল মহাপ্রস্থান পরাজয়েরই স্মারক।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

syedjahidhasan29@gmail.com

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.