শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদা রক্ষার দাবি ও রাষ্ট্রের দায়

শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদা রক্ষার দাবি ও রাষ্ট্রের দায়

সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হলো বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সুশঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক নজিরবিহীন আন্দোলন। শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টির পরে কোনো যৌক্তিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এটাই বাংলাদেশে শিক্ষা ক্যাডারের সর্ববৃহৎ আন্দোলন। এই আন্দোলন কিছুদিন আগ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর সভা-সেমিনারে বন্দি ছিল। কিন্তু ২৪ নভেম্বর, ২০১৭ তারিখে ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজিত মহাসমাবেশ সারাদেশে আলোচনার ঝড় তুলে দিয়েছে। সেই আলোচনা শহিদ মিনার থেকে ছড়িয়ে পড়ছে টেকনাফে, গড়িয়ে যাচ্ছে তেঁতুলিয়ায়। যতই দিন যাচ্ছে ততই এই আন্দোলন বেগবান হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেও শিক্ষা ক্যাডারের আন্দোলন সর্বস্তরের মানুষের কাছে খুব একটা আমলযোগ্য ছিল না। মিডিয়া ইদানীং এমনভাবে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরছে যে, দেশের সকল শ্রেণির জনগণ শিক্ষা ক্যাডারের যৌক্তিক দাবি বুঝতে পেরে তাদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠছে।

একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাই নির্দেশ করে সেই দেশ কোনদিকে যাবে। তাই শিক্ষাকে ‘জাতির মেরুদ-’ বলে আর শিক্ষকদের বলে ‘জাতি গড়ার কারিগর’। সমাজে একজন শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। ধরা যাক একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের কথা। ওই শিক্ষক শুধু বিদ্যালয়ে শিক্ষা দানই করেন না। আদম শুমারি, ভোটার তালিকা প্রস্তুত, ভোট গ্রহণসহ রাষ্ট্রের আরো অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজগুলো আরো ব্যাপক পরিসরের। মোট কথা রাষ্ট্রের সকল শিক্ষকই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অন্যান্য কাজে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ভূমিকা শুধু দেশীয় বৃত্তেই সীমাবদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রসংশনীয়। এখন যারা শিক্ষা ক্যাডারে প্রবেশ করছেন, তাদের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা ক্যাডারের নবীন সদস্যরা তাদের দক্ষতা যোগ্যতা দিয়ে দারুণ একটা প্রাণ এনেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা  সমিতিতে, সেই সঙ্গে প্রবীণ শিক্ষকদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমিতির কার্যক্রম। এক দশক আগেও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতিতে এত তারুণ্য, এত গতি, এত শক্তি ছিল না। নবীন-প্রবীণের আন্তরিক প্রচেষ্টায়ই গতি লাভ করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার।

অন্যদিকে আগামী দিনে যারা বিসিএস পরীক্ষা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তারাও ভীষণভাবে সমর্থন দিচ্ছেন শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকগণ তাদের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, শিক্ষা ক্যাডারের দাবি শুধু শিক্ষকদের দাবিই নয়, ২৮৩টি বেসরকারি কলেজের শিক্ষকগণ ক্যাডারে প্রবেশ করলে আগামীতে এই ক্যাডার লোকভারে নুয়ে পড়বে। এই ক্যাডারে নিয়োগ তখন সীমিত হয়ে পড়বে। ঘটবেও তাই। এ ছাড়া ক্যাডারে জ্যেষ্ঠতা নিয়েও সংঘাত দেখা দিবে। সীমাহীন বঞ্চনা গ্রাস করবে পুরো শিক্ষা ক্যাডার। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছুটা বিপাকে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব মহোদয়ের বক্তব্য পড়ে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। শিক্ষা ক্যাডারের মতো একটি বৃহৎ ক্যাডার রাজপথে নামার ফলে পুরো দেশই নড়েচড়ে বসেছে, সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো ছোট্ট একটি মন্ত্রণালয়ের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিইবা করার থাকতে পারে?

একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির আন্দোলন যখন সামাজিক স্বীকৃতি পায়, তখন সেই আন্দোলন বিপদজনক হয়ে ওঠে। শিক্ষা ক্যাডারের আন্দোলনের গতি প্রকৃতি এখন বিপদজনক দিকেই মোড় নিচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। সূচনা পর্বে শিক্ষা ক্যাডারের আন্দোলন যে জায়গায় ছিল এখন সেটা সেই জায়গা থেকে সরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ক্যাডার আন্দোলন অগ্রসর হওয়ার কারণ হিসেবে ৪টি বিষয়কে সনাক্ত করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। (১)  শিক্ষা ক্যাডারের দাবিটি সর্বাংশে যৌক্তিক, (২) মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, (৩) শিক্ষা ক্যাডারের পক্ষে দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের সহৃদয় সমর্থন, (৪) সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের একাত্মতা প্রকাশ। একটি আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে উপরিউক্ত চারটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অতীতের ইতিহাস বলে, যে আন্দোলন যৌক্তিক ও সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনপুষ্ট সে আন্দোলন কখনোই ব্যর্থ হতে পারে না। তাই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরাও মনে করছেন তাদের আন্দোলন সফল হবে। কোনো ষড়যন্ত্রই তাদের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না।

দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও চিন্তক এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, পিএসসি-র সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদাত হোসাইন প্রমুখ বার বার বলছেন, বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের স্বতন্ত্র সম্মান থাকা রাষ্ট্রের জন্যই জরুরি। আজ যদি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষক-কর্মকর্তা আর জাতীয়করণকৃত বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের সমান মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তাহলে ক্যাডারের শৃঙ্খলা চরমভাবে বিঘিœত হবে। সম্ভবত এই জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের লক্ষ্যে একটি অনুশাসন জারি করেছেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন লঙ্ঘন করে কেন জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের ক্যাডার মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে তা কারোরই বোধগম্য হচ্ছে না। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি একবারও বলেনি, বেসরকারি কলেজ সরকারি করা যাবে না, সমিতি শুধু বলেছে, তাদের ক্যাডারভুক্ত করা যাবে না। এহেন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের উপর দায়িত্ব পড়েছে এই উদ্ভূত পরিস্থিতি নতুন ভাবে বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণ করার। কোনো রকম বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণ ছাড়া তাড়াহুড়া করে যদি এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে সেটা হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্ত জাতির গতিশীল শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সর্বনাশ ডেকে আনবে বলেই মনে হয়।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবেই এ মুহূর্তে কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে। গত ২৬ ও ২৭ নভেম্বর পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করেছে। ডিসেম্বর মাস যেহেতু বাঙালি জাতির আবেগের সঙ্গে জড়িত তাই এ মাসে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচার-প্রচারণা ছাড়া তারা রাজপথে বা কর্মস্থলে কোনো কর্মসূচি দেননি। ডিসেম্বর মাসে যদি তাদের দাবির পক্ষে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত না দেন তাহলে জানুয়ারি মাসে কঠোর কর্মসূচি দিবে সমিতি। কোনো প্রকার ঔদ্ধত্য প্রদর্শন না করে, মার্জিত আচরণের মাধ্যমে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি যেভাবে তাদের লক্ষ্যে আগাচ্ছে, এটা বাংলাদেশের যে কোনো আন্দোলনের জন্যই একটি শিক্ষণীয় দিক।  এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন যত দীর্ঘ হবে সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য ততই সংকট তৈরি হবে। এই মুহূর্তে একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক-কর্মকর্তাবৃন্দ রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পায়ে ঠেলে রাজপথে আন্দোলন করছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর একটি বাক্যেই দেওয়া সম্ভব। তাহলো, শিক্ষা ক্যাডার রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব অবহেলা করেনি বরং রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে তাদের যে অধিকার দিয়েছে, সে অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বলেই আজ তারা রাষ্ট্রের কাছে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিতভাবে আবেদন জানিয়েছে। এই আবেদন যখন অফিসিয়ালি জানানো হয়, তখন তা খুব একটা গুরুত্ব পায়নি বলে আজ আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তারা আন্দোলন নয়, তারা শিক্ষাকার্যক্রমকেই পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। শ্রেণিকক্ষ থেকে যখন তাদের বের করে আনা হয় তখন শুধু একজন শিক্ষকই বের হয়ে আসেন না, জাতির ভবিষ্যৎও তার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি তলিয়ে না দেখে শুধু খামখেয়ালি মন্তব্য করলে ভুল করা হবে।

বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ ইস্যুতে শিক্ষা ক্যাডারের মাথা ঘামানোর কোনো দরকারই ছিল না অথচ জীবন-জীবিকা ও মর্যাদার প্রয়োজনে সেই কাজটিই আজ তাদের করতে হচ্ছে। এবং তাদের উপর দোষ চাপানোর অপকৌশল আঁটা হচ্ছে। কোনোভাবেই এমন পরিস্থিতি জাতির জন্য কাম্য নয়। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ সরকারের কাছে কোনো বিশেষ সুবিধা চাননি, এমন কি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণেরও কোনো বিরোধিতা করেননি। তারা শুধু বলেছেন, প্রচলিত আইন মেনে জাতীয়করণের নীতি অনুসরণ করতে এবং তাদের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে। শিক্ষা ক্যাডারের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষা না করে সরকারের উচিত তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করা। এই কাজটি যত দ্রুত করা হবে, ততই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মঙ্গল হবে। কালক্ষেপণ করলেই তৈরি হবে জটিলতা। সরকারের উচিত হবে শিক্ষা ক্যাডারের দাবি মেনে নিয়ে তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নেওয়া। আশা করি বর্তমান দেশবান্ধব ও শিক্ষাবান্ধব সরকার শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং শিক্ষা ক্যাডারের যথার্থ মর্যাদা ফিরিয়ে দিবেন। 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

syedjahidhasan29@gmail.com

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.