পাঠকের চোখে বইমেলার প্রথম সাত দিন

পাঠকের চোখে বইমেলার প্রথম সাত দিন

সৈয়দ জাহিদ হাসান: আনন্দহীন বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারির বইমেলা বৃহত্তর সাংস্কৃতিক উৎসব হয়ে উঠেছে। তবে এখনও এটা জাতীয় উৎসবের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। নাগরিক জীবনের গ-িবদ্ধ এ উৎসব যেদিন জাতীয় উৎসবের রূপ নিবে সেদিন বাংলাদেশে একটি নীরব বিপ্লব ঘটে যাবে। জেগে উঠবে পুরো বাংলাদেশ। জ্ঞানের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠবে। মানুষ হয়ে উঠবেÑ সদাচারী, সত্যবাদী, আনন্দপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে দারুণ একটি পরিবর্তন এনে দিতে পারে, যদি আমরা বইমেলার চেতনাকে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগাতে পারি। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আর ‘বইমেলা’, এ দুটো শব্দের ভেতর মর্যাদাগত ও দায়বদ্ধতার পার্থক্য আছে। আমি অন্তত তাই মনে করি। গ্রন্থমেলার পূর্বে ‘অমর একুশে’ শব্দদ্বয় যুক্ত হলে ওই গ্রন্থমেলার উপর একটি দায় চলে আসে। সে দায় শহিদের রক্তের ঋণের দায়, সে দায় দেশপ্রেমের দায়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একাংশে) ফেব্রুয়ারি মাসে যে বইমেলা শুরু হয়ে পৃথিবীর কোনো দেশের বইমেলাই এর সঙ্গে তুল্য নয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুধু গ্রন্থমেলাই নয়, এটা আমাদের বীরত্বপূর্ণ চেতনার স্মারক। ভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেম উদ্রেককারক। অমর একুশে গ্রন্থমেলার আবেগকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়া আমাদের জন্য মোটেই অসম্ভব কাজ নয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বছর জুড়েই বইমেলার আসর বসে। লন্ডন বইমেলা, ওয়াশিংটন ডিসির জাতীয় বইমেলা, টোকিও বইমেলা, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট বইমেলা বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে, নান্দনিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। এসব বইমেলায় যে শুধু বই বিপণন হয় তা-ই নয়। এখানে পাঠচক্র, সাহিত্য আলোচনা, থিয়েটার প্রদর্শন, লেখকদের সঙ্গে প্রকাশকদের চুক্তি স্বাক্ষরসহ নানারকম আয়োজন চোখে পড়ে। একটি বইমেলাকে ফলপ্রসূ করার জন্য, বইকে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি তা সবই এসব বইমেলায় গ্রহণ করা হয়।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে। গণমাধ্যমের বিনামূল্য প্রচারণায় দেশব্যাপী সাড়া জাগাবার চেষ্টা করছে। এটা একটি ভালো দিক। সেই সঙ্গে এই কথাও ভাবতে হবে যে বইয়ের শুদ্ধতার কথাও বিবেচনা করা দরকার। শুদ্ধতার কথা বলতে আমি আর্টের সবশর্ত পূরণের নিপুণতার কথাই বুঝিয়েছি।

যতই দিন যাচ্ছে ততই নতুন বই মেলায় এসে নিজেকে পাঠকের সামনে মেলে ধরছে। আজ আমি মেলায় আসা এমন কিছু নতুন বইয়ের কথা বলতে চাই, যেগুলো আমার ভালো লেগেছে। এই ভালো লাগা বইগুলোর তালিকা বেশ লম্বা। প্রতিটা বই ধরে ধরে আলোচনা করার জায়গা এটা নয়। আমি শুধু আমার ভালো লাগার বইগুলো সম্পর্কে দুই একটি তথ্য উৎসাহী পাঠকদের জন্য স্মরণে আনতে চাই।

বাংলাদেশে প্রতি বছরই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ উপলক্ষে উল্লেখ সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। প্রতিবারই পুরাতন বইয়ের সংখ্যার রেকর্ড ভেঙে নতুন বইমেলা নতুন রেকর্ড গড়ে। ২০১৭ সালের বইয়ের রেকর্ড ভেঙে এবার ২০১৮ সালের বইমেলা যে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। চলতি বইমেলার তৃতীয় দিনে ১২০টি বই, চতুর্থ দিনে ১২০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে মর্মে তথ্য দিয়েছে একটি দৈনিক পত্রিকা। মেলার পঞ্চম দিনে এসেছে বিভিন্ন বিষয়ের ১১৬টি গ্রন্থ। আমরা যদি এই তিনটি মধ্যবর্তী সময়ে প্রকাশিত বইয়ের গড় হিসাব একটু মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখবো এ সপ্তাহে অন্তত কমবেশি ৮২৬টি বই প্রকাশিত হবে। কোনো দেশে যখন এক সপ্তাহে আটশ’র অধিক বই উৎপন্ন হয়, সেই দেশের সাহিত্য-শিল্প কতটা সমৃদ্ধ তা না বললেও কিছুটা অনুমান করা যায়।

 

এ সপ্তাহের প্রবন্ধ : অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রথম সপ্তাহেই দেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকগণ তাদের প্রবন্ধ গ্রন্থ বইমেলায় এনে পাঠকদের উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। এরই মধ্যে মেলায় এসেছে আহমেদ রফিকের কবিতার বিভিন্ন ভাষা, হাসনাত আবদুল হাইয়ের সময়-অসময়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পিতার হুকুম, হাসান আজিজুল হকের আমার ইলিয়াস, আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাহিত্য চিন্তা, বুলবুল সারওয়ারের মহাভারতের পথে। সন্দেহ নেই দেশের প্রথম সারির প্রাবন্ধিক বলে যাদের আমরা চিনি ও জানি ইতোমধ্যেই তাদের নতুন গ্রন্থের স্বাদ পেতে শুরু করেছেন পাঠকগণ। সামনের দিনগুলোতে নিশ্চয়ই আমরা আরো অনেক সমৃদ্ধ প্রবন্ধগ্রন্থ পাবো, কিন্তু প্রথম সপ্তাহেও আমরা যে কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ পেয়েছি তার মূল্যও একেবারে কম নয়। বিশেষ করে মোনায়েম সকারের ‘শেখ মুজিব : মৃত্যুঞ্জয় ছায়াবৃক্ষ’ গ্রন্থটি আমার কাছে এতই ভালো লেগেছে যে সেই বইটির কথা বিশেষভাবে না বললেই নয়। এই গ্রন্থটিতে প্রাবন্ধিক শেখ মুজিব ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যেসব বিশ্লেষণ করেছেন তা নতুন চিন্তা উদ্রেক করতে সক্ষম। বাংলাদেশের প্রবন্ধ আজ এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যা নিয়ে এখন আমরা গর্ব করতেই পারি। আমাদের প্রবন্ধগুলো এখন বেশ প্রাণবন্ধ আর সুখ পাঠ্য বলেই আমি মনে করি। একটি দেশের প্রবন্ধ সাহিত্য যখন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তখন সাহিত্যের অন্যান্য শাখাও খুঁজে পায় পথের দিশা।

গল্প গ্রন্থের কথা : প্রতি বছরই বইমেলায় প্রচুর গল্পের বই প্রকাশিত হয়। এবারও গল্পের নতুন বই এসেছে বইমেলায়। বাংলাদেশে এ সময়ে যারা গল্প লিখছেন এবং ভালো গল্প লিখছেন তাদের বেশির ভাগের বই-ই বইমেলায় এসে গেছে। যাদের একাধিক গল্পগ্রন্থ আসবে, তাদের একটি বই অন্তত প্রথম সপ্তাহে মেলায় এসেছে এটা পাঠকদের জন্য নিশ্চয়ই মন ভালো করা সংবাদ। বাংলা গল্প এখন বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। বাংলা গল্পের মেরুদ- এখন এতটাই শক্ত যে যেকোনো আবেগের ভারই এখন সে বহন করতে সক্ষম। বইমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে যেসব গল্পের গ্রন্থের দেখা পাওয়া গেল সেগুলোর প্রচ্ছদ যেমন আকর্ষণীয়, মুদ্রণও নির্ভুল। আমাদের প্রকাশনা শিল্প এখন যে একটা সম্মানজনক অবস্থায় চলে এসেছে সেটা গল্পগ্রন্থের আঙ্গিকসজ্জা ও পাঠকপ্রিয়তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এই যান্ত্রিক যুগে এসেও যে আমাদের গল্পের বইগুলো টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটাই সবচেয়ে আশার কথা। এ সময় যারা খ্যাতিমান গল্পকার, তাদের সবার বই-ই মেলার প্রথম সপ্তাহে একটি দুটি করে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সেই বইগুলোর ফ্ল্যাপের লেখা ও সূচিপত্র দেখে মনে হলো আসলেই বইগুলো সুখপাঠ্য।

কবিতার শব্দে মুখর গ্রন্থমেলা : কবিতা সাহিত্যের সবচেয়ে জটিল শিল্পমাধ্যম। এই মাধ্যমে সোনালি শস্য ফলানো খুবই কঠিন কাজ। যারা শব্দ নির্মাণে দক্ষ, শব্দ যাদের হাতের ছোঁয়া পেলেই দল মেলে বিকশিত হয়ে ওঠে, তাদের সঙ্গে লেনদেন করেন কবিতাদেবী। বইমেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো কবিতার বই। একটি কবিতার বই কিনেই পাঠক পাতা উল্টিয়ে পড়তে শুরু করেন। প্রয়োজনে কবিকণ্ঠেও শুনতে পারেন সরস কবিতা। এ এক অন্যরকম ভালোলাগার  বিষয়।

বই মেলার প্রথম সপ্তাহে শতাধিক কাব্যের দেখা পেলাম। নবীন-প্রবীণ সব বয়সের কবিদের বই-ই এসেছে বইমেলার শুরুর দিনগুলোতে। পারিজাত প্রকাশনীর স্টলে প্রেমপদ্ম শিরোনামের কবিতার বইটি হাতে নিয়েই মন ভরে গেল। কবি দীপক রায়ের লেখা এই বইয়ের কবিতাগুলো হৃদয়কে আকৃষ্ট করল। আরেক নবীন কবি এম. এস. জামানের কৃত্রিম মা গ্রন্থটিও পাঠককে আনন্দ দিবে বলেই আমার মনে হয়। প্রয়াত কবি শহীদ কাদরীর কথাও এ প্রসঙ্গে বলা দরকার। তার সদ্যপ্রকাশিত গোধূলির গান কাব্যটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি এখন সর্বাধিক। শহীদ কাদরী বাংলা ভাষার একজন শক্তিমাল কবি। এই শক্তিমান কবির কবিতা পাঠককে অতীত দিনে মুগ্ধ করেছে, এখনও করছে। গোধূলির গানে কবি যে আবেগ বিস্তার করেছেন, সে আবেগের সঙ্গে শহীদ কাদরীর পূর্ববর্তী কাব্যগুলোর মিল খুব একটা নেই। এ ছাড়া মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আবু হাসান শাহরিয়ার গ্রন্থও স্টল থেকে আলো ছড়িয়ে পাঠকের দৃষ্টিপথ আকর্ষণ করছে অবিরাম।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নানা বিষয়ের নানা বয়সের পাঠকের জন্যই বই পাওয়া যায়। বিচিত্র বিষয়ের নতুন বই যখন হাতে নিই, যখন সেই বইয়ের গন্ধ শুঁকি মনে হয় বইটি বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যাই। বই শুধু আমাদের বিনোদনের সঙ্গী তাই নয়, সুসময়ের-দুঃসময়ে, সব মুহূর্তে বই আমাদের আনন্দ দেয়। বই মেলার অন্যান্য বই নিয়ে আরেকদিন বিস্তৃত পরিসরে লেখার ইচ্ছে রইল। আজ শুধু এটুকুই বলবো, যেখানেই থাকি চিরদিন যেন বইয়ের সঙ্গেই থাকি। আমাদের সমাজ বইমুখী হোক।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.