আগুন লেগেছে দেশে দেশে

আগুন লেগেছে দেশে দেশে

মোনায়েম সরকার: আদিমকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একটা বিষয় লক্ষণীয় সেটা হলো ‘জোর যার মুল্লুক তার’। কখনো এই জোরের কাজটা বিভৎস হয়ে দেখা দিয়েছে। কখনো এটা মুখোশ বা ছদ্মবেশের আড়ালে থেকে মুল্লুক দখলের কার্যটা সম্পন্ন করেছে। সবল চিরদিনই দুর্বলকে আক্রমণ করেছে। এখনো করে, ভবিষ্যতেও করবে। ক্ষমতার কাজই হলো, আধিপত্য বিস্তার করা। এটা যেন অনেকটা সেই বলিষ্ঠ শিশুর মতো। আমরা মাঝে মাঝে লক্ষ করি, কিছু হৃষ্টপুষ্ট শিশু এমনিতেই সারাক্ষণ লাফঝাঁপ মারে। যে যা-ই বলুক না কেন তাতে ওই শিশুর লম্ফ-ঝম্ফ বন্ধ হয় না। কেন বন্ধ হয় না? বন্ধ হয় না এই জন্য যে ওই শিশুর ভেতরে শক্তি আছে, ওই শক্তি ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই।

আজকের পৃথিবীতে কিছু কিছু রাষ্ট্র এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তারাও শক্তিশালী কিন্তু নির্বোধ শিশুর মতো লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করে দিয়েছে। শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়কদের এই উস্কানিমূলক, মানবসমাজ বিধ্বংসী কর্মকা- পৃথিবীর জন্য আজ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা আজ এমন মনে হচ্ছে, পৃথিবী যেন মানুষের হাতে যে কোনো সময় ধ্বংস হয়ে যাবে। একবিংশ শতাব্দীর মানবসমাজ আজ এতটাই উৎকর্ষ লাভ করেছে যে মানুষ ইচ্ছে করলেই তাদের এই পৃথিবীটা সুন্দর করতে পারে, মানবিক করতে পারে, কিন্তু আজ আমরা দেখছি ঠিক এর উল্টো চিত্র। মানুষ অন্য মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করার জন্য, অন্যের সম্পদ লুন্ঠন করার জন্য দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। সম্পদের লোভ যে মানুষকে কতটা উন্মাদ করে তুলতে পারে, বর্তমান পৃথিবীর সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালেই সে কথা পরিষ্কার বোঝা যায়।

আজ দারুণ এক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে মানবসমাজ। জীবজগতের ইতর শ্রেণির প্রাণীর চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মানব সম্প্রদায়। মানুষ এখন মানুষের বড় শত্রু হয়ে উঠেছে। লোভের মোহে নিজের সমস্ত মঙ্গল গুণাবলি বিসর্জন দিয়ে পশুর চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মানুষ। মানুষ যতক্ষণ না এই লোভের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসবে, ব্যক্তিগত লাভের দিকে কম দৃষ্টি দিবে, ততক্ষণ মানুষের শান্তি হবে না। একটি কাক যখন বিপদে পড়ে তখন আরো কাক এসে সেই বিপদগ্রস্ত কাকটাকে উদ্ধার করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষ যখন বিপদে পড়ছে তখন মানুষের পাশে মানুষ এসে দাঁড়াতে চাইছে না। একটি মানুষ যেন পৃথিবীতে আজ অন্য মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা যেন এই পৃথিবী আজ আর মানুষের ভার সহ্য করতে পারছে না। অথচ আমরা জানি এখনও এই গোটা পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তা পৃথিবীর জন্য বোঝা নয়, সম্পদতুল্য। আমরা লক্ষ্য করছি কোনো কোনো শক্তিমান রাষ্ট্র শুধু অর্থনৈতিক কারণে কিংবা নিজেদের শক্তিকে সমুন্নত রাখতে অন্য রাষ্ট্রের উপর জোরপূবক যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে বা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিচ্ছে। যার ফলে ওই রাষ্ট্র নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে মানুষ বুঝতে পারছে যুদ্ধের পরিণাম কত ভয়াবহ, যুদ্ধ কখনোই সুন্দর সমাধানের পথ দেখাতে পারে না, তবু মানুষ যুদ্ধের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। স্বেচ্ছা মৃত্যুর জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ। মানুষের এই ইচ্ছা মৃত্যুর ব্যাধি যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে যেকোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

পৃথিবীতে আজ এমন কোনো দেশ নেই, এমন কোনো মানব গোষ্ঠী নেই, যে দেশ বা যে গোষ্ঠী কোনো না কোনো যন্ত্রণা ভোগ না করছে, সবদেশ, সব সমাজই আজ সমস্যায় জর্জরিত। এই সমস্যার প্রধান কারণ ‘অস্ত্র’। শক্তিশালী মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে সেই অস্ত্র বিক্রয় করার জন্য অস্ত্র উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে বাধ্য করছে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে। কোনো দেশ যদি যুদ্ধে জড়াতে অস্বীকার করে তাহলে ওই দেশের অভ্যন্তরেই যুদ্ধ লাগিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে সে দেশে প্রথমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে, তারপর সেই কৃত্রিম সংকট সমাধান করার জন্য শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে সেই ষড়যন্ত্রকারী রাষ্ট্র। এভাবেই আজ রাষ্ট্র দখলের পাঁয়তারা করছে যুদ্ধোন্মাদ পুঁজিবাদী দেশগুলো। আজ মানুষকে অকারণে অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করার সংকল্প করতে হবে। মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হয় এমন কোনো কাজ যেদিন মানুষ নিজেই করা থেকে বিরত হবে সেদিনই পৃথিবী জুড়ে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করবে। আজ ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া, কোথাও কোনো শান্তি নেই। কোনো দেশ দেউলিয়া হচ্ছে,  কোনো দেশ যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। দেশে দেশে আজ শুধু আগুন আর আগুন জ্বলে উঠছে। অথচ এ আগুন নেভানোর দায় কেউ নিচ্ছে না। সবাই আজ এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছে যে, কোনো মানবিক আবেদনই আজ আর মানুষের মনে সাড়া জাগাতে পারছে না। দেশহারা মানুষের সংখ্যা আজ ক্রমে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরণার্থীর ঢল নামছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বসত বাড়ি থেকে মানুষকে উচ্ছেদ করে কারা শরণার্থী বানাচ্ছে তা মানুষ বুঝতে পেরেও কোনো সমাধানের পথে হাঁটছে না। হাঁটার গরজ বোধ করছে বলেও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে সর্বগ্রাসী আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে এই বিশ্ব সংসার। সেদিন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমরা যারা দুর্বল তারা সবাই-ই ধ্বংসের অতলে তলিয়ে যাবো।

এক সময় লোহার সিন্দুকের খুব মূল্য ছিল কিন্তু এ যুগে লোহার সিন্দুক কেউ খুব একটা ব্যবহার করে না। আমাদের একটা লোহার সিন্দুক আছে। এটা আমার মা ব্যবহার করতেন। এটা একসময় প্রয়োজনীয় ছিল বটে কিন্তু আজ আবর্জনায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই আবর্জনা এখন আমরা না পারছি ফেলতে, না পারছি ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণ করে রাখতে। লোহার সিন্দুক এখন আমাদের সংসারে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ এত পরিমাণ মারণাস্ত্র মজুদ করেছে যে, সেগুলো এখন তাদের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সব রাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন তাদের দেশে যদি একটা পারমাণবিক বোমা কোনো কারণে বিস্ফোরিত হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রে কি পরিমাণ প্রাণহানি হবে তা আমরা সকলেই কমবেশি উপলব্ধি করতে পারছি। পৃথিবীর বুকে পারমাণবিক বোমাসহ সকল মারণাস্ত্র আজ অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকটা আমাদের সিন্দুকের মতোই হয়ে উঠেছে। এসব পারমাণবিক শক্তি আজ যদি মানুষ স্বেচ্ছায় করেই ধ্বংস না করে তাহলে তা একদিন মানুষকেই ধ্বংস করে দিবে। এই কথাটা এখন বিশ্ববিবেককে বুঝতে হবে। বিশ্ববিবেক চুপ করে থাকলে সেই নীরবতাই নীরব ঘাতক হয়ে দেখা দিবে। নিকট ভবিষ্যতের সেই ভয়াবহ ধ্বংসের কথা ভেবে এখন মানুষকে সাবধান হওয়া দরকার। যত দ্রুত মানুষ সাবধান হবে, তত দ্রুতই আমরা নিরাপদ হতে পারবো। মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থেই আজ মানুষকে সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। আজ পৃথিবীতে ভাষাভিত্তিক ও জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে যেসব সংঘাত তৈরি হচ্ছে সেগুলো মোটেই শুভকর নয়। স্বাধীনতার নামে, তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে সর্বত্রই আজ রক্তপাত হচ্ছে। এই রক্তপাত বন্ধ করতে হলে সম্পদ আহরণের লোভ সবার আগে দমন করা দরকার। সহমর্মিতার ও সংযমের গুণ আয়ত্ত করা প্রয়োজন। আশাকরি মানুষকে এ সংযমের পরিচয় দিয়েও? এক সময় রাজার রাজত্ব ছিল, পৌরহিত্যের দৌরাত্ম ছিল। আজ রাজার রাজত্ব গেছে, ধর্মীয় পৌরোহিত্যের দৌরাত্ম্যও হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে পুঁজির সীমাহীন লোভ। এই লোভ পৃথিবীকে বিপথে  টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, অযৌক্তিক উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রনায়ক। তাদের খামখেয়ালির শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ। নিরীহ মানুষ মৃত্যু নয়, জীবনকে ভালোবাসে। দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবন নয়, একটি সুন্দর জীবন প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষকে শান্তি ফিরিয়ে দেওয়াই হোক বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের একমাত্র দায়িত্ব। মানুষের অধিকার হরণ করলে, যুদ্ধের মধ্যে, ধ্বংসের মধ্যে মানুষকে নিক্ষেপ করলে এই নিরীহ মানুষেরাই একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। সেই ঘুরে দাঁড়ানো কতটা মঙ্গলজনক হবে জানি না, তবে একটা পরিবর্তন যে সাধিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর মানুষ আজ যে আগুন নিয়ে খেলছে. এই আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করতে হবে। যেদিন আমরা আগুনখেলা বন্ধ করে মানুষকে সুখী করার জন্য মনোযোগী হবো সেদিনকার পৃথিবীই হবে মানবিক পৃথিবী, মানুষের পৃথিবী। আমরা মূলত মানুষ দ্বারা শাসিত মানবিক পৃথিবী-ই চাই। আসুন সবাই সুন্দর পৃথিবী গড়তে, সাধ্যমত মানবিক হওয়ার চেষ্টা করি।    

০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.