২৫ মার্চ, ১৯৭১: কালরাত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম ছোবল ও প্রতিরোধ

২৫ মার্চ, ১৯৭১: কালরাত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম ছোবল ও প্রতিরোধ

ড. এ.বি.এম আব্দুল্লাহ: আনুমানিক রাত সাড়ে দশটা-এগারোটার সময় হঠাৎ করে রঙবেরঙের অগ্নিগোলা পড়ে এলেনবাড়ী বুড়িমার দরগা-মসজিদের পাশের বস্তিতে। চারিদিক দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠে। সাথে সাথে বস্তির কুঁড়েঘর গুলি আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। চারিদিকে হৈ চৈ চিৎকার। নিরীহ সর্বহারা বস্তিবাসী কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। বর্তমান বিজয় সরণি ও নভোথিয়েটার ছিল (তখনকার লালদীঘি মনিপুরী পাড়ার অংশ) এই বস্তি ঠিক উল্টাদিকে। এখানে পুরাতন তেজগাঁ বিমানবন্দরের শেষ, ড্রাম-ফ্যাক্টরি, সি.এন.বি গোডাউন, তেজকুনীপাড়া, আওলাদ হোসেন মাঠের সংলগ্ন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে এই বস্তির অবস্থান। এখানে একটি রেল লাইনও ছিল।

সকাল থেকে নানা গুজব, যেকোন সময়  পাকিস্তানি আর্মি কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্ট থেকে এসে ঢাকা শহর আক্রমণ করতে পারে।  বিকাল থেকে আওলাদ হোসেন মাকের্ট-তেজগাঁও থানা-ফার্মগেইট কাওরান বাজার-বাংলামোটর পর্যন্ত আস্তে আস্তে আবালবৃদ্ধ, সাধারণ জনগণ জড়ো হতে শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ৪৭ বছর পর এ লেখা খুবই কঠিন, সম্পূর্ণ স্মৃতির উপর নির্ভর করে। তবে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলাম তাই লিখছি। এই লেখার পটভূমি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন, ৬-দফা, ১১-দফা, স্বাধিকার আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু এককভাবে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেন (১৬৯/৩০০ সদস্য)। ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন বাঙালির দাবি। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চে ১৮ মিনিটের বক্তব্যে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে তুলে ধরছেন। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

তেজগাঁ থানার বামপন্থি, ন্যাপ (অধ্যাপক মোজাফফর, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), গোপন কমিউনিস্ট পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, খেলাঘর), প্রথম থেকে ৬-দফা/১১-দফা, ‘কপ’, ‘ডাকপ্রভৃতি আন্দোলন/কর্মসূচি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করে আসছে। তবে নিজেদেরও পৃথক কর্মসূচি ছিল এবং ৭০ নির্বাচনে পৃথকভাবে অংশ গ্রহণ করে। কেন্দ্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কেউই নির্বাচিত হতে পারেনি। পশ্চিমা পাকিস্তানে ওয়ালী খানসহ বেশ কয়েকজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং তারা বঙ্গবন্ধুর ৬-দফাকে সমর্থন প্রদান করে। ভুট্টো-ইয়াইয়া চক্র ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং লোক দেখানো আলোচনা শুরু হয়। তাই এই পরিস্থিতে কেন্দ্রীয় ন্যাপ বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে নিজেদের কর্মসূচি এবং যৌথ কর্মসূচি মোতাবেক অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যায়।

ঢাকা শহরে তেজগাঁও অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। শহরের উপকণ্ঠে শিল্প অঞ্চল এবং দেশ বিভাগের আগ থেকে এখানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কৃষি গবেষণা, পাট গবেষণা, কলেরা রিসার্চ, টেক্সটাইল, পলিটেকনিক কলেজ, কৃষি কলেজ, হলিক্রস স্কুল, শাহীন স্কুল, বিজি প্রেস, এফডিসি ইত্যাদিসহ ক্যান্টেনমেন্ট পাশাপাশি অবস্থিত। তাই ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা ১৯৬৮-র ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ফার্মগেটে, ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথকর্মসূচি বিরাট ছাত্রজনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান স্বরাষ্টমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা জনাব আসাদুজ্জামান (কামাল) মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবুল খায়ের চৌধুরী, মরহুম নেয়াজ আহমেদ, স্থানীয় নেতাসহ ড. মাহাব্বুল্লাহ, শাহাজান সিরাজ (প্রাক্তন মন্ত্রী) ও শেখর দত্ত কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। ১৯৬৯, ১লা বৈশাখের ঘুর্ণিঝড় উত্তর নাখালপাড়া ও তেজগাঁও শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে চিকিৎসা, পুনর্বাসন কাজে ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের স্থানীয় কর্মীদের যেমন, তেমনি আওয়ামী লীগ, শ্রমিকলীগ নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় ন্যাপনেতাকর্মীদের একধরনের সংহতি গড়ে উঠে। তেমনি ভাবে ৭০-এর বিহারী-বাঙালি দাঙ্গার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের যৌথভাবে প্রতিরোধ করায়ও এ ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ বিষয়ে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান, সংবাদ সম্পাদক ন্যাপ নেতা আহমেদুল কবির ও তার সহধর্মিনী আমাদের সকলের প্রিয় লায়লা কবিরের অনেক অবদান ছিল। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার চৌধুরী, গাজী গোলাম মোস্তফা, মোজাফফর হোসেন পল্টু, ন্যাপ নেতা ওসমান গনি, মোনায়েম সরকার অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেন। ন্যাপ নেতা আমার বন্ধু মোনায়েম সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রেখে আমরা কর্মকা- পরিচালনা করতাম। তার কাছ থেকে অনেক খবর পেতাম, মোনায়েম তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতো।

অধ্যাপক আনোয়রুল হক, অধ্যাপক সেলিম, অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্র, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, আবদুল হাফিজ, জুলহাস উদ্দিন, আবদুল ওদুদ, শাহাবুদ্দিন ও ছালেহা আনোয়ার ও আনোয়ার স্যারের সহযোগিতায় তেজগাঁও অঞ্চলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হলিক্রস স্কুল ও কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ, শাহীন স্কুল, পলিটেকনিক স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মাঝে সংগঠন গড়ে তোলে। এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ সংগঠনের মাধ্যমে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হন।

৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ৯/১০ তারিখে ন্যাপ নেতা মোনায়েম সরকার ফার্মগেটের উদ্যানে এক জরুরি বৈঠকে ডাকেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জয়কুমার সারগী, অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন, অধ্যাপক গৌরঙ্গ মিত্র ও আমাকে। দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের মুখোমুখি যেকোন সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে। সকল প্রকার প্রস্তুতি দরকার। যুদ্ধ স্বল্প বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। নির্ভর করে বিশ্বরাজনীতির উপর, মোনায়েম প্রথম আলোচনার সূত্রপাত করলো এবং বললো, অস্ত্র-সস্ত্র সংগ্রহ বিশেষ করে বিস্ফোরক তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে হবে। অধ্যাপক সারগী স্যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও কাজের বিবরণ দিলেন। প্রয়োজনী উপাদান ও সংগ্রহের ব্যবস্থা ইতোমধ্যে হয়েছে। মোনায়েম সরকারের মাধ্যমে বর্তমান বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলের ২৩৪/২৩৫ রুমে (মি. সাদন ও অজয়ের রুমে) কাজ শুরু হয়। তারা দুইজনই পূর্ব পরিচিত। অধ্যাপক আমিন ও আমি রসায়নে তাই মূল কাজটি আমাদের করতে হবে। কয়েকদিন পর আইরিশ মি. টাকার অধ্যাপক নটর ডেম কলেজ তিনি আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। প্রথামিকভাবে আমরা কিছু বোমা তৈরি করতে সক্ষম হই। বন্ধু মোনায়েম সরকারের পরামর্শে  শহীদ মুক্তিযুদ্ধা আজাদ ও সিরাজুল মুনির রাত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরিকৃত  Explosive Test করেন। পরের দিন আমাদের রেজাল্ট দেন। মনে পড়ে ১৬Ñ১৭ তারিখের মধ্যে আমরা কাজটি করতে সমর্থ হই। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খাঁন Detonation & Design of Explosive  উপর ঢাকা ক্যান্টমেন্ট লাইব্রেরির একটি বই আমাকে দেন। এটা আমাদের অনেক কাজে আসে। ইতোমধ্যে আলোচনার কোন অগগ্রতি নাই। অফিস, আদালত বন্ধ অসহযোগ চলছে। প্রতি দিন আমাদের নিজেদের এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগের নেতাদের সাথে আমার যোগাযোগ হত, বিশেষ করে জনাব কিবরিয়ার সাথে। তিনি বলতেন আব্দুল্লাহ ভাই আমাদের সকল প্রস্তুতি আছে। আপনারা শুধু আমাদের সাথে থাকবেন। তেজগাঁ থানার সঙ্গে ওনাদের যোগযোগের কথা তিনি আমাকে বলেছিলেন। সে কথা অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান সাহেব আমাকে ২৩Ñ২৪ তারিখ জানিয়েছেন। মানববন্ধন, রাস্তাকাটা, গাছকাটা, বেরিকেট দেওয়া, পেট্রোল ড্রাম টেক, আর,সি,সি রোলারটেক ছাড়াও আওলাদ হোসেন মার্কেট থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত মনিপুরী পাড়া, তেজকুনি পাড়া, তেজতুরি বাজারের বড় রাস্তার উভয় পাশের গলিপথগুলির মাধ্যমে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। এখনকার মতো এত বড় বড় বিল্ডিং তখন এই রোডের দুই পাশে ছিল না। তবুও বিশেষ বিশেষ বিল্ডিং বিশেষ করে পলিটেকনিক বালিকা বিদ্যালয়সহ অনেক বাড়ির ছাদ থেকে আক্রমণ হবে। মূল আক্রমণ ছিল তেজগাঁ থানার ও ফার্মগেটের  চৌরাস্তার মোড়ের চারিদিক ঘিরে। 

মনে পড়ে ২৩, ২৪, ২৫ মার্চ আমি ও বন্ধু অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ন্যাপ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন পাড়া ও শ্রমিক বস্তিতে আমাদের যোগযোগ এবং করণীয় সম্বন্ধে আলোচনা করি। সকালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের সাথে ফার্মগেট থেকে পুরাতন তেজগাঁ এয়ারপোর্ট পর্যন্ত প্রাতঃভ্রমণ করি, সেই দিন অর্থাৎ ২৫ শে মার্চ সকালে সংবাদ পত্রের হকার  জনাব তোফাজ্জল হোসেন এসে আমাকে কানে কানে বললেন, গতকাল অর্থাৎ ২৪ তারিখে ক্যান্টমেন্টে পত্রিকা দিতে গিয়ে শুনেছি পাক আর্মিরা আজই ঢাকা শহর আক্রমণ করবে। এ সময় প্রতিদিন সে আমাদের ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা জানাতো। সাইদুর রহমান স্যার আগের দিন রাত্রে আমাকে বলেছেন আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমরা ৬ দফা মানে না। মুজিব ৬ দফায় ছাড় দিবে না। সংঘাত অনিবার্য, সকাল ১০টায় স্যারের বাসা হয়ে কিবরিয়ার বাসায় যাই। সে কিভাবে পাক আর্মিকে মোকাবেলা করবে তা আমাকে বিস্তারিত খুলে বলে। প্রতিটি গলি পথে, বিশেষ বিশেষ বাড়ির  ছাদে, এবং তেজগাঁ থানা, ফার্মগেট চৌরাস্তার রাস্তা কাটা, গুপ্ত ট্রাপ, পেট্রোল ড্রাম বোমা, জ.ঈ.ঈ জরহম বোমা, বন্দুক, রাইফেল, ক্রস ফায়ারিং, মোটের উপর ফার্মগেটে বিরাট বিরাট গর্ত বা আচ্ছাদিত বালির গর্ত। কেন্দ্রের থেকে বিশেষ লোকজন এবং তেজগাঁও থানাকে কেন্দ্র ও ওয়ারেলস্ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। তবে প্রথমে মানববন্ধন বা ঐঁসধহ ধিষষ দ্বারা শুরু হবে। আমি আমাদের প্রতিটি কেন্দ্রে এবং ব্রিগেড যথা স্থানে ৬ টার মধ্যে উপস্থিত থাকতে সকলকে বলে আসি। এর আগে হকার মার্কেটের ন্যাপ অফিসে বন্ধু মোনায়েম সরকার, ওসমান ভাই মোর্তজা খাঁন, ইদু ভাই, মহিবুর  রহমান, হায়দার চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতার সাথে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু, ওয়ালি খান ও অধ্যাপক মোজাফফর সাহেবের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বিষয়টিও জানতে পারি। প্রতিদিনের মতো পল্টন ময়দানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঠে, শহিদ মিনারে বিগ্রেড ট্রেনিং ও মিটিং চলে। এটা ছিল সে সময়ে প্রতিদিনে রুটিন মতো কাজ, তবে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের ব্রিগ্রেড সাভারের জনাব ইদ্রিস দেওয়ানের প্রচেষ্টায় ফায়ারিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

এই সময় পাড়ার দোকানদার কয়েকটি কেরোসিনের বোমা দেখান, সে তৈরি করে রেখেছে। কিছু দিন আগে তাকে ইঙ্গিতে বলেছিলাম। হাজার হাজার মানুষ আওলাদ হোসেন মার্কেট থেকে শুরু করে বাংলা মোটর পর্যন্ত জড় হয়েছে। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই রাস্তায়। সন্ধ্যার আগে জনাব মাহবুর হক (বিথী), অধ্যাপক আনওয়ারুল হক, শাহবুদ্দীন, হাজী আহম্মদ আলী অধ্যাপক সেলিম, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, আবু তাহের, আনোয়ার পাটয়ারী, জুলহাস মাস্টার, ওয়াদুদ মাস্টারসহ অনেকের সাথে ফার্মগেটের বিথীর সাথে রাস্তায় মানববন্ধনের বিষয়ে আলোচনা হয়। সবাই অস্থির কি হতে যাচ্ছে। লোকে লোকারণ্য। অনেক কষ্টে ৪৯নং সংশয়ে স্যারের বাসায় আসি। আমি তার ছাত্রের (বঙ্গবন্ধুর) কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেন আমার ছাত্র, ৭ই মার্চে বলে দিয়েছেন এবার তোমাদের পালা। নিয়তি কি করে দেখ, এই প্রথম তাঁর মুখে নিয়তির কথা শুনি।

এমনি অবস্থায় রাত সাড়ে দশটাÑএগারোটার মধ্যে বুড়িমার দরগার মসজিদের বস্তিতে ওষষঁসরহধঃরহম গোলার আঘাতে হঠাৎ চারিদিক আলোকিত হয়ে আগুন জ্বলে উঠে। মানুষ জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে সেদিকে অগ্রসর হয়। তবে যাওয়ার পথ নাই, রেলপথ ধরে আমরা অগ্রসর হইলেও আগুন নেভাবার কোন পানি নাই। বুদ্ধি করে দূরের বস্তিগুলি ভেঙ্গে দেয় হয়। ইতোমধ্যে আস্তে আস্তে  একটা-দুইটা আর্মির গাড়ি ঢাকায় ঢুকতে চেষ্টা করে মানুষ বাধা দেয়। বোমা মারে, ২/১ টি সামরিক গাড়িতে আগুন লেগে হতাহত হয়, তারা মাঝে কিছুক্ষণ থমকে যায়। কিছুক্ষণ পর পিছুন থেকে আরও বড় বড় বহর আসলে চারদিকে গুলি শুরু করে মানুষ রাস্তা ছাড়ছে না, মরছে। সংঘর্ষ শুরু। এদিকে অনেকে বড় রাস্তা থেকে গলি পথে চলে আসছে। আবার জয় বাংলা বলে বড় রাস্তায় ছুটছে, ওরা গুলি করছে। থানার পরে তারা আগাতে পারেনি বেশ কিছু সামরিক গাড়ি ড্রামবোমা, টেপবোমাসহ গর্তে পড়ে আগুন ধরে যায়। ইতোমধ্যে বিরাট বিরাট বুলড্রজার, মেশিনগান, টেঙ্ক বাহিনী আস্তে আস্তে আওলাদ হোসেন মার্কেট, ফার্মগেটের প্রতিরোধ ভেঙ্গে দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে আসে তখন রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত বিশেষ করে বড় রাস্তায় টিকে থাকতে না পেরে যার কাছে যা ছিল তা নিয়ে গলি থেকে পাকবাহিনীকে যথাসম্ভব প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করে। মনে পড়ে রাত এক-দুইটার দিকে হাজার হাজার লোক আওলাদ হোসেন মার্কেট ও তেজগাঁও রেস্ট হাউজের গলি থেকে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছে। পাকিদের ধর বলে সকলে তেজগাঁও শ্রমিক অঞ্চল থেকে আসছে। এক পর্যায় আমি বাধা দিতে গেলে বলেন আব্দুল্লাহ ভাই মরতে ভয় পাই না, জীবনের মায়া নাই, দেশ স্বাধীন করতে চাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। রাত দ্ইুটার পর বড় রাস্তায় যাওয়া সম্ভব হয়নি, মনে হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সকল রকম বড় ছোট হালকা ভারি অস্ত্র দিয়ে ঢাকা শেষ করে দিবে অর্থাৎ পাকিস্তানিদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইট শুরু।

০৪ জুলাই, ২০১৮

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.