যৌবন অনাহারে অর্ধমৃত, বার্ধক্য অতিভোজনে অসাড়

যৌবন অনাহারে অর্ধমৃত, বার্ধক্য অতিভোজনে অসাড়

Source: Internet

সৈয়দ জাহিদ হাসান: যৌবন সৃষ্টির কাল। পুরাতনকে, জীর্ণ-পচা আদিম অবস্থাকে নবরূপ দান করাই যৌবনের ধর্ম। যেখানে অত্যাচার-নিপীড়ন, সেখানেই যৌবন শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী। পৃথিবীতে যৌবনের বন্দনা যে করে না, তারুণ্যের শক্তিকে যে সম্মান করে না, সে আর যা কিছুই করুক, তবু সে নরাধন। পৃথিবীর এত উত্থান, এত সমৃদ্ধি, এর পেছনে আছে দুরন্ত যৌবনের দুঃসাহসী কর্ম। যৌবনের অমিত তেজই সভ্যতা বিকাশের হাতিয়ার। এই যৌবন হাতিয়ার যারা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছেন, তারাই অসম্ভবকে ‘সম্ভব’ করেছেন, ‘না’কে ‘হ্যাঁ’তে পরিণত করেছেন। পক্ষান্তরে বার্ধক্য এক স্থবির অবস্থার নাম। বার্ধক্য নিজেকে নিয়ে নিজেই ভারাক্রান্ত, তার পক্ষে নতুন পথে যাত্রা করা শুধু কষ্টকর নয়, অসম্ভবও। বার্ধক্যের অভিজ্ঞতার মর্যাদা আমাদের দিতেই হবে। কিন্তু বার্ধক্যকে মর্যাদা দিতে গিয়ে যৌবনকে অবজ্ঞা, অবহেলা করাকে অবিচার বলেই মনে হয়। আমরা কোথাও কোনো অবিচার দেখতে চাই না, সবখানেই ন্যায়বিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই।

বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নানা কারণে আবার স্তমিত হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ শিক্ষিত বেকার যুবকদের মধ্যে কিছুটা আশার আলো জাগালেও সেই আলো সরকারের বার্ধক্যআক্রান্ত আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের কারণে দিনে দিনে নিভে যাচ্ছে। কোটা নিয়ে কথা বলাকে আমি নৈতিক দায়িত্ব নয়, অধিকার বলেই মনে করি। পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের জন্য বিশেষ সুবিধা বা প্রণোদনা দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু এটাও ভেবে দেখা দরকার, দুর্বলকে সকল করতে গিয়ে, সবল যেন দুর্বল হয়ে না পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের মানুষের আবেগের জায়গাটাকে পুরোপুরি দখল করে আছে এতে কোনো দ্বিমত নেই। যারা জাতির বীরসন্তান তারা আমাদের সম্মান এবং শ্রদ্ধা পেতেই পারেন, কিন্তু বীর যোদ্ধার দুরাচারী পুত্রের জন্য, তার বিপদগামী নাতি-নাতনির জন্য সুবিধার পথ তৈরি করাকে কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। কারো কোনো ভালো কাজের জন্য কেবল তাকেই পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে (বড় জোর তার অসহায় স্ত্রী ও নাবালক সন্তানদের বেঁচে থাকার অবলম্বন করে দেওয়া যেতে পারে), কিন্তু বংশ পরম্পরায় পুরস্কার দেওয়াকে ‘পুরস্কারের অপচয়’ বলেই আমার কাছে মনে হয়।

বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতির অপপ্রয়োগে দেশ তার মেধাবী সন্তানদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, প্রশাসন যোগ্য লোকের অভাবে বয়ঃবৃদ্ধ বা দুর্বল মেধার প্রশাসক দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। একটি রাষ্ট্র যখন দুর্বলের পক্ষ নিয়ে সবলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়, তখন বুঝতে হবে সে রাষ্ট্র ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মেধাবীরা কারো করুণা চায় না, তার চায় যোগ্যতা প্রমাণ করে নিজের প্রাপ্য অধিকারটুকু বুঝে নিতে। অপরপক্ষে কোটা পদ্ধতি কিছুটা হলেও করুণাসিক্ত, বিশেষ কারণে বিশেষ সুবিধার পক্ষে। এদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ-সুবিধা দেশের সম্পদ অনুসারে একটু বেশি বলেই মনে হচ্ছে (এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা)। একটি উদাহরণ দিই, আমি যখন সরকারি তোলারাম কলেজে প্রভাষক পদে চাকরি করতাম, তখন আমার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ওই সময় আমাদের কলেজে তিনিই একমাত্র ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাকি সবাই রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধবিরোধী ছিলেন এমন নয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সম্মান আমাদের কাছে একটু বেশিই ছিল। আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে আমি শ্রদ্ধা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করি।

আমার বিভাগীয় প্রধানকে আমি একটি গল্পের বই (জখম) উৎসর্গ করলাম। উৎসর্গপত্র পড়ে আমার বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক একদিন আমাকে বললেন, ‘উপরের রঙ দেখে ব্যক্তি বা বস্তু বিচারের স্বভাব লেখকের থাকতে নেই, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করুন। সব অন্যরকম মনে হবে।’ কেন আমার সহকর্মী ও কথা বলছিলেন কিছুদিন পরেই তা টের পেয়েছি। আমি এখন পর্যন্ত দেশের ছোট-বড় ছয়টি সরকারি কলেজে চাকরি করেছি, কিন্তু আমার ওই মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপকের মতো কর্কশ ভাষী, অমানবিক, কর্তব্য অবহেলাকারী, অর্থ ও ক্ষমতালোভী, শ্রেণিকক্ষবিমুখ শিক্ষক দ্বিতীয়টি পাইনি। মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক স্যার মোটা অংকের মাইনে পান, তার স্ত্রী একটি এনজিও-তে দুই-আড়াই লাখ টাকা বেতন পান, দুই ছেলেই আমেরিকায় থাকে, টাকা-পয়সার তার কোনো অভাব নেই, তবু তিনি মুক্তিযোদ্ধার ভাতা নেন, মুক্তিযোদ্ধা নাম ভাঙিয়ে যেখানে যেটুকু সুবিধা পাওয়ার তা পেতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করেন না। এদেশের কোনো বার্ধক্য আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার অধীনে চাকরি না করলে বোঝা যাবে না, তারা কিভাবে প্রশাসনযন্ত্র বিকল করছেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখছেন।

বহুদিন আগে সুলেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের একটি লেখা পড়েছিলাম ‘কেউ থাকে যুদ্ধে, কেউ যায় ভিক্ষায়’ এই নামে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন এক সময়ের বীর যোদ্ধারা সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে বদলে যান। এদেশের সব মুক্তিযোদ্ধাই আজ মুক্তিযোদ্ধা নন, অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এখন ভিক্ষুক হয়ে গেছেন। ভিক্ষাবৃত্তি ঘৃণা করে এখনও যারা যুদ্ধ করছেন তাদের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়। ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ছেয়ে গেছে। যে দেশে এখনও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না খেয়ে মরছে, অথচ নকল যোদ্ধারা গাড়ি-বাড়ি-চাকরি-ক্ষমতা নিয়ে দাপটের সঙ্গে প্রশাসনিক কলকাঠি নাড়ছে, সে দেশে মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত কোটা-পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে সোচ্চার না হওয়া পাপ বলেই গণ্য করা উচিত।

আমি যখন দেখি আমার ক্লাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্রটি লেখাপড়া শেষ করে বেকার হয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে ধুকে ধুকে মরছে এবং বার্ধক্য-আক্রান্তরা অতি ভোজনে অসাড় বিকলাঙ্গ হচ্ছে, তখন নিজেকে সান্ত¦না দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাই না। যারা কাজ করার যোগ্য তারা কাজ পাচ্ছে না, অথচ যাদের দিয়ে এক পয়সার কাজ হয় না, তারা যখন কাজের দায়িত্ব পায় তখন বিদ্রƒপের হাসি আটকে রাখা কার পক্ষে সম্ভব?

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যুবকের সংখ্যা পাঁচ কোটি। আড়াই কোটি যুবকই বেকার অর্থাৎ কর্মহীন। এই কর্মহীন বেকার যুবশক্তি কাজ করলে দেশ কত দ্রুত এগুতো তা কি আমরা কখনো চিন্তা করি? যুবশক্তি অনাহারে মরে যেতে না দিয়ে কাজ দিয়ে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সরকারকে দ্রুত সেই পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতিও দিন দিন সবল হচ্ছে, কিন্তু কোটি কোটি যুবককে বেকার রেখে টেকসই অর্থনৈতিক ভিত তৈরি করাকে ‘বালির বাঁধ’ বলেই মনে হয়।

গত ঈদুল ফিতরের উৎসব আমার পরিবার উদ্যাপন করতে পারেনি। কেন পারেনি সেই কথাটা একটু বলতে চাই, ঈদের দুই মাস আগে আমি চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে ফরিদপুরের সদরপুরে আসি। আমার এলপিসির সফট কপি এবং হার্ড কপিতে বেতনের কিছুটা গড়মিল ছিল। আমি সংশ্লিষ্ট হিসাবরক্ষণ অফিসের পরামর্শে কয়েকবার ফরিদপুর-চট্টগ্রাম করলাম। তাতেও কাজ হলো না। বেতন-বোনাস সবকিছু আটকে গেল। দশ মিনিটের একটি টেকনিক্যাল কাজ আমি দুই মাসেও হিসাবরক্ষণ অফিসার দিয়ে করতে পারলাম না। কেন পারলাম না? পারলাম না এই কারণে যে সদরপুরের হিসাবরক্ষণ অফিসারকে আরো দুটি উপজেলায় অফিস করতে হয়। তিনি সপ্তাহে একদিন, বড়জোর দুইদিন অফিস করেন। কোনো সপ্তাহে আবার অফিসেও আসেন না। চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হিসাবরক্ষণ অফিসার সাহেব নিজের জীবনের হিসাব মেলাতেই এখন তিনি ক্লান্ত। কার ঈদ হলো, কে বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে লাঞ্ছিত হলো, কার শিশুসন্তান স্কুলের মাইনে দিতে না পেরে স্কুলে অপমানিত হলো, এসব কিছু দেখার সময় কোথায় তার! দেবিদ্বার উপজেলাতেও দেখেছি একজন হিসাবরক্ষণ অফিসারকে তিন জায়গায় অফিস করতে। আমি ভেবে পাই না, দেশে কি এতই লোক সংকট পড়ে গেছে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস একজন মানুষ দিয়েই চালাতে হবে?

কবি জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) জননী কবি কুসুমকুমারী দাশ (১৮৮২-১৯৪৮) বলেছিলেন,

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।

মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন,

‘মানুষ’ হইতে হবে এই যার পণ।’

 কুসুমকুমারী দাশের কাক্সিক্ষত আদর্শ ছেলে আমাদের দেশে সম্ভবত কোনোদিনই হবে না। কেননা আমাদের ছেলেরা জীবন্মৃত। ছেলেদের মুখে হাসি নাই, অসহায় হাড্ডিসার বুকে বল নেই, তাদের হতাশ মনে কোনো তেজ নেই। তারা মানুষ হওয়ার পণ নয়, পেটের দায়ে অন্ধকার গলির মাস্তান হওয়ার ফন্দি করছে। অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াই যেন বাংলাদেশের যৌবন শক্তির নিয়তি। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের মধ্যে যুবকদের সংখ্যাই সর্বাধিক। আজ আমাদের সেই টগবগে যুবকরা কর্মহীন হয়ে যখন রাস্তায় রাস্তায় ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ায়, অনাহারে কষ্ট পায়, পকেটে টাকা নেই বলে আপনজনকে মুখ দেখাতে না পেরে পালিয়ে পালিয়ে চলে, তাদের জন্য কি আমাদের একটুও মায়া জাগবে না? শুধু বিশেষ শ্রেণির প্রতি অন্ধ আবেগ নয়, সবার প্রতি বিবেকতাড়িত সিদ্ধান্তই পারে বর্তমান সংকট সমাধান করতে। যৌবন দৃপ্ত পায়ে নিঃসঙ্কোচে কর্মপথে হেঁটে যাক, বার্ধক্য সম্মানের সঙ্গে অবসর যাপন করুক, এটাই হোক দল-মত-নির্বিশেষে সব মানুষের প্রত্যাশা।

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী।

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.