একুশে ফেব্রুয়ারি : মহত্তর ত্যাগের নবতর সংকল্প

একুশে ফেব্রুয়ারি : মহত্তর ত্যাগের নবতর সংকল্প

আমরা অনেকেই বলি ‘অমর একুশে’। কেন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি অমর’ সেই উত্তরটি হয়তো অনেকেরই জানা  নেই।

সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাঙালি জাতির ইতিহাস মূলত লড়াই-সংগ্রাম-রক্তদানের ইতিহাস। স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাঙালির রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন নানা কারণেই উল্লেখযোগ্য। বাঙালির রাষ্ট্রভাষার দাবি রক্তর রক্তিম আখরে লেখা এক ইতিহাসের নাম। ভাষা-আন্দোলন শোষণ-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিকে জ্বলে ওঠার প্রেরণা দিয়েছে, বার বার তাকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করেছে, বিজয়ী হয়ে ঘরে ফেরার পথ দেখিয়েছে। বাঙালির শিল্প-সাহিত্যে যে দুটি অবিস্মরণীয় ঘটনা দিগন্তপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে তার একটি হলো ১৯৫২ সালের রক্তরঞ্জিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, অপরটি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেই বাঙালির অপূর্ব-আবেগ জড়িত, সংকল্প সুগ্রথিত, রুধির ও হৃদপি-ের স্পন্দন মিলেমিশে একাকার। সম্ভবত এ কারণেই বাঙালির কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, নাটকে, নৃত্যে, এ দুটোর প্রত্যাশিত প্রতিধ্বনি বিঘোষিত

সম্প্রতি পাঠ করলাম লেখক-গবেষক-মুক্তচিন্তক মোনায়েম সরকার সম্পাদিত ‘একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটির পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় শুধু এটাই বলতে চাই সুবিন্যস্ত এই গ্রন্থটি কেবল আকরগ্রন্থই নয়, এটি একটি অসামান্য সংকলনের নমুনা গ্রন্থও বটে। কবি হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৫৩)’, বুদ্ধদেব বসুর ‘আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৫৪)’, হুমায়ুন আজাদের ‘বাংলা ভাষা (দুই খ-ে সমাপ্ত, ১৯৮৪), যেমন সংকলিত গ্রন্থ হিসেবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; তেমনি ‘একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০১৯)’ গ্রন্থটিও শ্রমসাধ্য সংকলনের সমপঙ্ক্তিতে স্থাপনযোগ্য। বাংলাদেশের খ্যাতনামা পঁয়তাল্লিশ জন লেখকের পঁয়তাল্লিশটি অনন্যসাধারণ প্রবন্ধ দিয়ে ‘একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি সজ্জিত। মোনায়েম সরকার কেন এমন একটি গ্রন্থ সংকলনে ব্রতী হয়েছেন তার একটি কৈফিয়তও তিনি উল্লেখ করেছেন বইটির ভূমিকাংশে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘১৯৫৩ সালে বরেণ্য কবি হাসান হাফিজুর রহমান অপরিসীম শ্রম ও মানসম্মত লেখা দিয়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ শিরোনামে যে অসামান্য সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, সেই মানের সংকলন বাংলাদেশে এখনও বিরল। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ অনেক কিছুর সমাহারে সজ্জিত একটি উৎকৃষ্ট সংকলন। সেখানে প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ আরো অনেক বিষয় স্থান পেয়েছিল। আমি মনে করি এখন সময় এসেছে একুশের প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে নতুনভাবে কাজ করার। সেই উপরব্ধি থেকেই ‘একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ সংকলনের কাজ শুরু করি।’ সম্পাদক কর্তৃক রচিত এই ভূমিকাংশে নতুন চিন্তার বেশ কয়েকটি সূত্র আছে। এই সূত্রাবলির কয়েকটি হলো, পূর্বজ সংকলকের কাছে ঋণ স্বীকার, একুশের চেতনার প্রতি যথার্থ সম্মানজ্ঞাপন, নতুন আঙ্গিকে একুশের শিল্প-সাহিত্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে হাজির করার তাগিদ। ‘একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থের সবগুলো প্রবন্ধই সুচিন্তিত ও সুলিখিত। প্রত্যেকটি লেখাই ধারণ করেছে একুশের আবেগ ও একুশ-পরবর্তী সংগ্রামের নির্মোহ বিশ্লেষণ। বাঙালি জাতির জীবনে অমর একুশে এক গৌরবগাথার নাম। এই গৌরবগাথার অগ্নি থেকেই বাঙালি জাতি স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেরণা লাভ করেছে। ভয়ঙ্কর শত্রুর লোহার খাঁচা থেকে ছিনিয়ে এনেছে রুধিরধৌত স্বাধীনতা। একুশের চেতনা কিভাবে বাঙালির শিল্পীসত্তা বিকাশে প্রাণিত করেছে তারও একটা পরিচ্ছন্ন ধারণা বাংলা বর্ণের বর্ণিল বন্ধনে ব্যক্ত হয়েছে এই গ্রন্থে।

আমরা অনেকেই বলি ‘অমর একুশে’। কেন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি অমর’ সেই উত্তরটি হয়তো অনেকেরই জানা  নেই। খান সারওয়ার মুরশিদের একটি প্রবন্ধ আছে যেটির শিরোনাম ‘একুশে অমর কেন’। এই প্রবন্ধে জ্ঞানতাপস খান সারওয়ার মুরশিদ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দেখার চেষ্টা করেছেন কি কি কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি অমরত্ব লাভ করেছে। এই প্রবন্ধটি পাঠ করলে একুশ সম্পর্কে নতুন নতুন অনেক তথ্যই জানা যাবে। বদলে যাবে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি।

‘একুশের ভাবনা’ প্রবন্ধে আহমদ শরীফ যে কথাগুলো বলেছেন সে কথাগুলোও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আহমদ শরীফ এমন একজন লেখক যার দৃষ্টিভঙ্গি সব সময়ই নতুন কিছু দেখে। ‘একুশের ভাবনা’ প্রবন্ধেও নতুন চিন্তার ও নতুন দেখার ভঙ্গি আছে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনে সংবাদপত্র, বেতার, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের ভূমিকার কথা তুলে ধরে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এ সময়ের প্রেক্ষাপটে কথাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। সাহিত্যের বিচিত্র-প্রকরণে একুশে ফেব্রুয়ারি ঘুরেফিরে এসেছে। এক্ষেত্রে রফিকুল ইসলামের ‘একুশের কবিতা ও গান’, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের ‘অমর একুশের পঞ্চাশ বছর : বাংলাদেশে লোক-সাহিত্য চর্চা’, হুমায়ুন আজাদের ‘একুশের চেতনা ও তিন দশকের উপন্যাস’ প্রবন্ধ পাঠ করলে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি হবে, কিভাবে একুশের চেতনা কবি-সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছে এবং তারা একুশের প্রভাব কতটা সাফল্যের সঙ্গে জনমনে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন।

আজকাল বাংলাদেশে অগণিত সম্পাদক দেখা যায়। বিশেষ করে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ভুরি ভুরি সম্পাদিত গ্রন্থ দেখে বোঝার উপায় নেই বাংলাদেশে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আহমদ শরীফ, খান সারওয়ার মুরশিদের মতো লেখক-সম্পাদকের কত অভাব। একজন সম্পাদকও তার সম্পাদনাকৌশলের কারণে হয়ে উঠতে পারেন সৃষ্টিশীল লেখকদের মতো গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য তার কর্মনিষ্ঠা প্রয়োজন, বিস্তর পাঠাভ্যাস প্রয়োজন, আরো প্রয়োজন আকর্ষণীয় বিষয়াবলি নির্বাচন। একজন সম্পাদককে প্রথমেই ভেবে নিতে হবে তিনি কী করবেন এবং কেন ও কিভাবে করবেন। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে শনাক্ত করতে পারলে সম্পাদনার পরবর্তী কাজগুলো অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়।

মোনায়েম সরকার লেখক হিসেবে যেমন শক্তিমান লেখক, সম্পাদক হিসেবেও তিনি সম্মানের জায়গায় নিজেকে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা একাডেমি থেকে তার সম্পাদনায় দুই খ-ে প্রকাশিত হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে,‘হাজার বছরের বাংলা গান’, ‘বাঙালির কণ্ঠ’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের বইগুলো। প্রত্যেকটি বইতেই মোনায়েম সরকার তার শ্রমঘনিষ্ঠ, প্রতিভাজাত, সৃষ্টিশীল মননের পরিচয় দিয়েছেন। ‘একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধ’ সংকলনটি বেশ গোছানো এবং মূল্যবান সংকলন বলেই আমি মনে করি। লেখকদের নামের আদ্যাক্ষরকে ভিত্তি করে সব লেখকের প্রতি সম্পাদক নিরপেক্ষতা বজায় রাখাসহ সবার সেরা লেখাটাকেই তিনি উক্ত গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।

ভাষা-আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের নামে যা কিছুই লেখা হয় সবকিছুই সত্য-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এমন নয়। একজন ভাষা সংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোনায়েম সরকার যখন ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনো কাজ করেন তখন তার আবেগটাই থাকে অন্যরকম। ‘একুশের নির্বাচিত প্রবন্ধে’ও পাঠক এই সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবেন। আবুল ফজল বলেছিলেন, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ এমন একটি সুদর্শন, সুপাঠ্য, সুবৃহৎ বই প্রকাশ করে প্রকাশক ওসমান গনি ও তার আগামী প্রকাশনী বৈশ্যবুদ্ধির কাছে মাথা নত না করে একুশে প্রীতির যে পরিচয় দিয়েছেন, এ জন্য তারা ধন্যবাদপ্রাপ্য।  

লেখক : কবি ও কথাশিল্পীs

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Comments are closed.