থিওরি অব লাভ

থিওরি অব লাভ

সাফাত জামিল শুভ: ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা।


ভালোবাসা নিয়ে যুগে যুগে বহু গবেষণা হয়েছে। নানা বিশেষজ্ঞরা ভালোবাসা নিয়ে দিয়েছেন নানা মত, নানা তত্ত্ব।আলোচ্য প্রবন্ধটি মূলত “ভালোবাসার ত্রিভুজতত্ত্ব” সম্পর্কে, যার প্রবক্তা হলেন স্টার্ণবার্গ। তার এই তত্ত্ব অনুসারে,ভালোবাসার তিনটি উপাদান রয়েছে: অঙ্গীকার, আবেগ ও অন্তরঙ্গতা!


আমেরিকার মনস্তাত্ত্বিক রবার্ট স্টার্ণবার্গ এমন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন যা সকলের কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে। তাঁর প্রস্তাবিত তত্ত্বটি এমন একটি বিষয়কে পাকাপোক্ত করেছে যা বহু মনকে করেছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং হৃদয়কে করেছে কম্পিত: সেই বিষয়টি হলো ভালোবাসা।


তিনি এটিকে নামকরণ করেছেন “ভালোবাসার ত্রিতত্ত্ব”, যেহেতু এই তত্ত্বটি একটি ত্রিভুজের মাধ্যমে সবচেয়ে সহজভাবে ব্যাখা করা যায়, কিন্তু এটি স্টার্ণবার্গের প্রেম তত্ত্ব হিসেবেই অধিক জনপ্রিয়। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি অনুযায়ী, ভালোবাসার রয়েছে তিনটি উপাদান: একটি উপাদান হলো অন্তরঙ্গতা(Intimacy), একটি আবেগীয় উপাদান(Passion) এবং শেষোক্ত উপাদানটি হলো অঙ্গীকার(Commitment)।


প্রথম উপাদানটিতে অন্তরঙ্গতা নিয়ে বলা হয়েছে। এই তত্ত্ব অনুসারে, এটি হলো অনুরাগ,ঘনিষ্ঠতা ও সংযুক্ততার অনুভূতি। দ্বিতীয় উপাদানটি হলো আবেগ, কারো প্রতি ভালো লাগা থেকে যে অগ্নীতুল্য প্রগাঢ় অনুভূতি আমরা পেয়ে থাকি এটি সেই বিষয়টিকেই বোঝায়। এটি পরিবেষ্টিত করে রেখেছে আবেগপ্রবণ আকর্ষণ ও যৌন আকর্ষণের প্রেরণাকে। অঙ্গীকার এই দুই উপাদানকে একত্রে আবদ্ধ করে রেখেছে। এটি হলো একে অপরের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া (সল্পমেয়াদী) ও ভবিষ্যতের জন্য নানা পরিকল্পনা করা (দীর্ঘমেয়াদী)।


উল্লেখিত তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে ভালোবাসার রূপ গঠিত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভালোবাসার প্রকাশ ৮রকম হতে পারে এবং সেগুলো হলো:
ভালোবাসাবিহীন:এটি কেবলমাত্র তিনটি উপাদানের (অন্তরঙ্গতা,আবেগ,অঙ্গীকার) অনুপস্থিতিকে বোঝায়। আমাদের জানাশোনা অথবা আমরা যাদের সাথে বিশেষভাবে জড়িত নই এমন ব্যক্তিদেরকে এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়।


বন্ধুত্ব:অন্তরঙ্গতার উপস্থিতিতে বন্ধুত্বকে চিহ্নিত করা হয়। এটি হলো অনুভূতির নানা অংশ যা প্রচন্ড আবেগ অথবা আবেগীয় কোন অঙ্গীকার ছাড়াই একজন উপলব্ধি করে থাকে। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ এটি ভালোবাসার অন্যান্য রূপ প্রকাশের শিকড় হতে পারে।


মোহাচ্ছন্ন ভালোবাসা:যখন আবেগ উপস্থিত এবং আসক্তি ও অঙ্গীকার উভয়ই অবর্তমান তাকে মোহাচ্ছন্ন অবস্থা বলে। সহজ ভাষায় “ক্রাশ”-রা (সেলিব্রেটি বা অন্য কেউ) এর অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোনো অনুভূতি ছাড়াই কেবল যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারীরাও এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, যেহেতু তারা শুধুমাত্র জাগতিক কামনা দ্বারা বেষ্টিত। যেহেতু বিশ্বাস করা হয় অন্তরঙ্গতা সময়ের সাথে বিকশিত হয়, তাই এটিকে আবেগপ্রবণ ভালোবাসার মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু অন্তরঙ্গতা বা অঙ্গীকার কোনটিই যদি বিকশিত না হয় তাহলে সময়ের সাথে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে।
অসার ভালোবাসা:এধরনের ভালোবাসার উদাহরণ হচ্ছে অসুখী দাম্পত্য জীবন, যেখানে জীবনসঙ্গীর প্রতি আসক্তি বা ঝোঁক আর নেই এবং আবেগের শেষ শিখাটিও বহু আগেই নিভে গিয়েছে; বিবাহের চুক্তি ব্যতীত এই বৈবাহিক জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অসার ভালোবাসা হলো আবেগ ও অন্তরঙ্গতা অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অঙ্গীকারের উপস্থিতি। অনেক সময় একটি প্রগাঢ় ভালোবাসা অসার ভালোবাসাতে পতিত হতে পারে।


আবেগপ্রবণ ভালোবাসা:ভালোবাসার এই রূপটি হলো অন্তরঙ্গতা ও আবেগের এক সংমিশ্রন। এই শ্রেণীর অন্তর্গত প্রেমিক-প্রেমিকার দল কেবলমাত্র শারীরিকভাবেই নয়, অনুভূতির দিক থেকেও আকৃষ্ট ও জড়িত। এটি দাম্পত্য জীবন অভিষেকের অন্যতম সাধারণ কারণ। এধরনের সম্পর্ক অঙ্গীকারবিহীন। তাই যখন উভয় পক্ষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন খুব সহজেই কোনো আইনগত ঝামেলা ছাড়াই এই ধরনের সম্পর্কের অবসান ঘটে।


স্বার্থান্বেষী ভালোবাসা:এটি হলো অন্তরঙ্গতা ও অঙ্গীকারের সমন্বয়ে গঠিত এক সম্পর্ক, যেখানে আবেগ অনুপস্থিত। অঙ্গীকার উপাদানটির উপস্থিতির কারণে এধরনের সম্পর্ক বন্ধুত্বের মধ্যে ভালোবাসার যে রূপ তা থেকে অধিক দৃঢ়। স্বার্থান্বেষী ভালোবাসা দীর্ঘমেয়াদী দাম্পত্য সম্পর্কগুলোতে লক্ষ্য করা যায়, যেখানে ভালোবাসার সাথে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে থাকার জন্য ঠিক আবেগের প্রয়োজন নেই যেহেতু সম্পর্কটিতে মায়া কাজ করছে। এধরনের সম্পর্ক পরিবারের সদস্য ও নিকট বন্ধুদের মধ্যেও দেখা যায়, যাদের মধ্যে একটি আদর্শমূলক কিন্তু দৃঢ় বন্ধুত্ব রয়েছে।


বিমূঢ় ভালোবাসা:কিম কারদাসিয়ানের সাথ ক্রীস হামফ্রীসের বিয়ে হলো বিমূঢ় ভালোবাসার যথাযথ উদাহরণ, যেখানে বিয়ের ৭২ দিন পর তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এটি হচ্ছে সেসব ঘূর্ণাবর্ত রোমান্স যা আমরা আমাদের টেলিভিশনে দেখে থাকি। বিমুঢ় ভালোবাসা হচ্ছে ঠিক তাই। কিম ও ক্রীসের বিয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গতা ছিল না, সেই সাথে তারা খুব তাড়াতাড়ি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল এবং তা প্রকাশ্যে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল যা তাদের দাম্পত্য জীবন অবসানে অন্যতম অবদান রেখেছে বলে ধারণা করা হয়।


সুসম্পূর্ণ ভালোবাসা:এধরনের ভালোবাসাকে বসানো যায় ত্রিভুজের মধ্যখানে, কেননা বলা হয় এটি হলো আদর্শ ও নিখুঁত ভালোবাসা। এতে ভালোবাসার ৩টি উপাদানই উপস্থিত ও এধরনের ভালোবাসা হলো ভালোবাসায় নিমজ্জিত সকল যুগলের লক্ষ্য। স্টার্নবার্গের মতানুযায়ী, এই ভালোবাসায় নিমজ্জিত যুগলেরা ১৫ বছর বা তারও অধিক সময় ধরে অসাধারণ যৌন সম্পর্ক উপভোগ করে থাকে, তারা একে অপরকে ছাড়া দীর্ঘ সময় নিজেদেরকে সুখী হিসেবে ভাবতে পারে না, তারা কঠিন সময়গুলো শৃঙ্খলার সাথে অতিক্রম করে এবং প্রত্যেকে একে অপরের সাথে এই সম্পর্কে পরমানন্দ অনুভব করে। তবে স্টার্নবার্গ সতর্ক করেছেন যে এই ধরনের সম্পর্ক অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা অধিক কঠিন। তাছাড়া এটি ভালোবাসার স্থায়ী রূপও নয়।


ভালবাসার জনপ্রিয় আরেকটি রূপ হল প্লেটোনিক ভালোবাসা বা বায়বীয় ভালোবাসা ( ইংরেজি : Platonic love) হ’ল সেই শুদ্ধতম ভালোবাসা যাতে কামনা বাসনার কোনও স্থান নেই। এ শব্দটির উৎপত্তি মূলত প্লেটোর “প্লেটোনিজম” মতবাদ থেকে যাতে বলা হয় এমন প্রকার ভালোবাসার কথা যাতে প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোবাসার সর্ব্বোচ পর্যায়ে প্রবেশ করবে কিন্তু শরীর নামক বস্তুটি থাকবে অনুপস্থিত। যে প্রেমে শরীর বিষয়টি অনুপস্থিত অথচ প্রেমের স্বাদ বা রস আস্বাদন করা যায় ষোলো আনা, এমন প্রেমই একমাত্র প্লেটোনিক প্রেম বা বায়বীয় ভালোবাসা হিসেবে পরিগণিত হবে।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Comments are closed.