স্মৃতিচারণঃ আদরের ছোট ভাই নীরু

স্মৃতিচারণঃ আদরের ছোট ভাই নীরু

আজ যাকে নিয়ে লিখবো সে আমার আদরের ছোট ভাই নীরু , নীরুর সাথে আমার সম্পর্ক টা একদম গভীর,  সে আমাকে অনেক সম্মান করতো , আমি তার ছোট আপা । নীরুর সাথে কাটানো শেষ মুহূর্ত টা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না । আমার খুব মনে পড়ে , যখন মনে পড়ে তখন আমার চোখ অশ্রু শিক্ত হয়ে যায় ।

সময় টা ঠিক ২০১৩।

তখন নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে আমার  দিন অতিবাহিত হচ্ছিল, দীর্ঘদিন হয়ে গেলো আমার আদরের ছোট ভাই নীরুর সাথে আমার কথা হয় নি ।

আমি লোকালয়ের ছোট্ট একটা গ্রামে থাকতাম সেই সময়ে কিছু পারিবারিক সমস্যার কারণে আমার ছোট ভাই নীরু র সাথে আমি ঠিকঠাক ভাবে যোগাযোগ করতে পারি নি ।

নীরু যখন কানাডায় চলে গেলো,  যাওয়ার ঠিক আগে সে আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলো , নীরু আমাকে বলেছিলো “ছোট আপা সবসময় আমার জন্য দোয়া করিস” না যানি আবার কবে দেখা হবে , কানাডা যাওয়ার পর অবশ্য বেশ কয়েক বার সে বাংলাদেশে এসেছিলো , এসেছিলো তার প্রাণের পীরগাছায় , এসেই আমার সঙ্গে দেখা করেছিলো , 

এভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেলো অনেক দিন একদিন হঠাৎ প্রায় রাত ন’টায় আমি এশার নামাজ পড়তে বসেছি , হঠাৎ করেই আমার ছোট মোবাইল ফোনটা বেঁজে উঠলো,  আমার ছোট মেয়ে ঐশ্বর্য দ্রুত ফোনটা আমার কাছে নিয়ে আসলো , আমি তখন মোনাজাত পড়ছিলাম, মোনাজাত শেষ করে ঐশ্বর্য’র হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে  আমি লক্ষ্য করলাম এটা বাহিরের দেশের নাম্বার,  আমার বুকটা ধুকপুক করে উঠলো,  

ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ফোনের ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ভেসে এলো ছো–টো — আ —পা ।

আমি কন্ঠ শুনে কিছুক্ষণ থমকে গিয়েছিলাম, তারপর বললাম নী——রু ।

নীরু ওপাশ থেকে আবার বলে উঠলো , ছোট আপা , আমি তোর নীরু , শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা ।

আমি এপাশ থেকে বলে উঠলাম ” ময়না তোর কন্ঠ এমন শুনা যাচ্ছে কেন ? 

নীরু হঠাৎ কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো ” ছোট আপা আমার পেট টা হঠাৎ খুব ব্যথা করছে রে ।

আমি বললাম তুই কোথায়?

নীরু আমাকে বললো আমি এক রেস্টুরেন্ট এর সামনে গাড়ির সিটে শুয়ে আছি  ।

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে ছোট আপা ।

আমি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম ” আমার সোনা ভাইরে থাম আমি মাএ এশার নামাজ শেষ করেছি আমি অনেক অনেক দোয়া পড়ে তোর পেটে ফু দিয়ে দিবো তুই দেখবি এখনই সুস্থ হয়ে যাবি ” ।

তুই তোর মোবাইল টা পেটের উপরে রাখ আমি “সুরা ইয়াসিন” , ” সুরা আর – রহমান ” , ” সুরা ইব্রাহিম ” , আয়াতে শিফা পড়ে ফুঁকাচ্ছি । 

নীরু আমার কথা মতো ওর পেটের উপর ফোন রাখলো আমি এক এক করে সব দোয়া পড়ে ফু দিতে লাগলাম।

দোয়া ফুকানো শেষে যখন ও বলে উঠলো, ” ছোট আপা ‘এখন একটু ভালো লাগছে ” তখন আমি একটু স্বস্তি পেতাম ।

এভাবে আমার আমল চলতে থাকলো , হঠাৎ একদিন নীরু আমাকে বলতে লাগলো  

-জানিস ছোট আপা, তুই যখন আমাকে দোয়া পড়ে ফুকাস তখন অনেকেই গাড়ির কাছে এসে তোর তেলোয়াত শুনে । আর বলে নীরু ভাই কার সাথে এভাবে মনোযোগ দিয়ে কথা বলেন । 

আমি তখন হাসিমুখে বলে উঠি , “আমার ছোট আপা “।

নীরুর পেট ব্যথা বেড়েই চলেছে কোন উন্নতি দেখছি না,  আমি বাড়িতে এক দেড়শো মহিলা দিয়ে কালিমা পড়ে নেই যাতে আমার ছোট্ট আদরের ভাইটা খুব তারাতারি সুস্থ হয়ে যায় । আমার বাড়ি থেকে রংপুর শহরের  বিশ মাইল দূরে কেরামতিয়া  মসজিদ অবস্থিত, আমি সেখানে প্রতি সপ্তাহে পাশের প্রতিবেশী কিছু মহিলাদের নিয়ে নামাজ পড়ে ওর জন্য দোয়া করতাম । যেন খুব তারাতারি নীরু সুস্থ হয়ে উঠে ।

আমার” মা” নীরুকে খুব ভালোবাসতো,  আমার মা ছিলো নিরীহ, শান্ত শিষ্ট মানুষ । আমার মা আমাকে যখনই পীরগাছায় ডাকতে তখনি আমি ছুটে যেতাম ।

আমার মা আমাকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলতো মা , আমার বাবা টা কবে সুস্থ হবে , আল্লাহ্ আমার বাবা টাকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছে, কেন । 

মায়ের এমন কান্না দেখে আমার খুব কষ্ট হতো , আমি আরো বেশি বেশি আমল করতে থাকি ।

কিন্তু নীরু আমাকে তখনো সঠিক অসুস্থতার কথা বলে না শুধু বলে পেট ব্যথা ।

নীরুর পেট ব্যাথা বেড়েই চলেছে কোন উন্নতি হচ্ছে না । আমি নিরুপায় হয়ে যাচ্ছি দিন দিন ।

আমার ছোট ফোনটা সবসময়ই আমার কাছে কাছে রাখি কখন মা কিংবা নীরু ফোন দেবে ।

সেদিন হঠাৎ সকাল বেলা মা ফোন দিয়ে আমাকে পীরগাছায় ডাকছে , মাকে খুব দুশ্চিন্তায় আছে মনে হলো ।

আমি তারাতারি বাড়ির সব কাজ শেষ করে পীরগাছার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । গিয়ে দেখি মা উত্তেজনামূলক ভাবে পায়চারি করছে , আমাকে দেখা মাএ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো মারে আমার বাবা টা খুব অসুস্থ,  আমার নীরু টা যে খুব অসুস্থ ।আমার কিছুই ভালো লাগে না ।

আমি মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, মা আমি নীরুর জন্য প্রতিদিন আল্লাহ্ র কাছে দোয়া করছি , আমার দুই মেয়ে ঐশি, ঐশ্বর্য সবসময় তাদের মামার জন্য আল্লাহ্ র কাছে দোয়া করছে,  তুমি দেখেও আল্লাহ্ খুব তারাতারি নীরু কে সুস্থ করে দিবে । সেদিন কথাটা বলে  মায়ের মনে আশার আলো দেখিয়ে বাড়ি চলে আসলাম । বাড়ি এসে প্রচন্ড ভাবে নামাজে  কান্না করে আল্লাহ্ র কাছে নীরু র সুস্থতা ভিক্ষা চেয়েছিলাম ।

সেদিন রাত ১০ টায় হঠাৎ করে মোবাইল টা বেঁজে উঠলো আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম , ফোনের শব্দে আমি তারাহুরা করে ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মা বলে উঠলো

 মা জানিস আমার বাবা টার ক্যান্সার হয়েছে আজ ও আমাকে বলেছে ।

আমি এটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না,  ফোনের ওপাশ থেকে মা জোড়ে জোড়ে কান্না করতে থাকে,  আমি কি বলবো বুঝতে পাচ্ছিলাম না  ।

পরদিন সকালে মা আবার ফোন করে আমাকে বলেছিলো –দেখতো মা নীরু কেন জানি আমার ফোন ধরছে না ।

আমি মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম চিন্তা করবেন না মা , নীরু হয়তো ব্যাস্ত আছে পরে অবশ্যই ফোন ধরবে ।

আমার মাকে খুব দুশ্চিন্তা লাগছিল ।

সেদিন সারাদিন নীরু মাকে একটা বারের জন্য ফোন করে নি ।

রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম, কিছুতেই ঘুম আসছিলো না আমার, নীরু র জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল,  ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মাথার কাছে ছোট ফোনটা বেজে উঠলো আমি তারাহুরা করে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে এক মহিলার কন্ঠ শুনতে পেলাম ।

মহিলাটা ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো ” হ্যালো, আপনি কি নীরু ভাইয়ের ছোট আপা ।

আমি বললাম “জ্বি” বলুন আমার নীরু র কি হয়েছে, সে কেন আমার ফোন ধরছে না ।

ওপাশ থেকে বলে উঠলো , টেনশন করবেন না উনি এখন ভালো আছে , ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি উনি ঘুমাচ্ছে ।

আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ” ঘুমের ইনজেকশন,  কেন কি হয়েছে আমার সোনা ভাইটার ।

উনি বললো উনি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলো তাই আমরা উনাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি , চিন্তা করবেন না উনি এখন মোটামুটি সুস্থ আছে ।

বুকের ভেতর টা কেমন যেন করে উঠলো,  আমি জানি আমার নীরু ভালো নেই,  ও খুব কষ্টে আছে । ফোনটা কেটে গেলো , আমার আর ঘুম আসছিল না , ছটফট করে সেদিন রাতটা কেটে গেলো , তারপর বেশ কিছু দিন হয়ে গেলো নীরু র সাথে আমার কথা হলো না,  

এভাবে যেতে যেতে ২১ অক্টোবর ভোর রাতে হঠাৎ খবর এলো আমার মা আর নেই,  আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না কারন সেদিন  রাতেও আমি আমার মায়ের সাথে কথা বলেছি ।

আমার মা ছিলো আমার আত্মার আত্মা ।

মায়ের শোক কাটিয়ে উঠতেই পারছিলাম না  , এর মাঝে নীরুর সাথে আমার দু’একবার কথা হয়েছে , নীরু আমাকে বারবার মার কথা জিজ্ঞেস করেছে আমি উওর দিতে পারিনি । 

নভেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ ছোট বোন মানু আমাকে ফোন করে জানায় নীরু ঢাকায় এসেছে , আসার পর থেকেই শুরু আমাকে খুঁজছে । 

আমার ছোট মেয়ে ঐশ্বর্যর তখন জে.এস.সি পরীক্ষা চলছিলো , নীরুর কথা শোনার পর থেকে আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারছিলাম না,  মনে হচ্ছিলো যদি উড়ে চলে যেতে পারতাম । মেয়েটার শেষ  পরিক্ষা শেষ করেই মেয়েকে নিয়ে  সেদিন রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । চারদিকে তখন হরতাল, অবরোধ চলছে ,রাস্তায় রাস্তায়  জ্যাম অনেক । আমার মন নীরু কে একটি বার দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো ।

বহু কষ্টে মানুর বাসায় গিয়ে পৌঁছাইলাম ।

নীরু তখন হাসপাতালে ভর্তি আমি জানতাম না, মানুর বাসায় গিয়ে এ ঘর ও ঘর নীরু কে খুঁজতে লাগলাম ।

ঠিক তখনি বোনের জামাই বললো — ছোট আপা নীরু তো বাসায় নাই , ও হাসপাতালে এখন তো অনেক রাত ,কাল সকালে আমি আপনাকে ওর কাছে নিয়ে যাবো ।

রাতে নামাজ পড়ে  আমরা মা মেয়ে শুয়ে পড়লাম,  সারা রাত আমি চোখের পাতা এক করতে পারলাম না,  এ পাশ ও পাশ করতে লাগলাম , হঠাৎ ফজরের আজান দিয়ে দিলো সকালে ঘুম থেকে উঠে ওজু করে নামাজ আদায় করে নিলাম তারপর ঐশ্বর্য কে বাসায় রেখে ছোট ভাই পিটনের সঙ্গে মানুর দেওয়া নীরু র খাবার নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । ঢাকার পরিস্থিতি তখন খুব খারাপ,  অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে একটা রিক্সা পেলাম,  রিক্সা চালক অনেক কষ্ট করে আমাদের হাসপাতালে পৌঁছে দিলো । হাসপাতালে গিয়ে ৯ তালার ১০৩ নম্বর রুমে গিয়ে দরজায় নক করতেই আমার আরেক ভাই জোত্যি দরজাটা খুলে দিলো , আমি নীরুকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম , হঠাত্ নীরু আমাকে বলে উঠলো,  

ছোট আপা,  আয় আমার কাছে ।

আমি গিয়ে ওর বেডের  পাশে বসলাম ,ছোট ভাই জোত্যি 

নীরু কে বিছানায় শুয়ে দিলো । ওর কাছে বসতেই ও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,  ছোট আপা আমাকে তুই সবসময় যে দোয়া গুলো বলতিস,  সেগুলো বল আমার খুব শান্তি লাগে , এই বলে আমার ডান হাত টা ওর বুকের উপর রাখলো , ওকে এমন কষ্টে দেখে আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল,  আমি খুব কষ্টে নিজেকে আটকে রাখলাম আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম এই কি সেই নীরু যার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো ,যে গল্পের আসরে বসলে সবাই কে মাতিয়ে রাখতো । যে সবসময় আগলে রাখতো সবাই কে হঠাৎ তার একি হয়ে গেলো । কিছুক্ষণ পর জোত্যি চলে গেলো,  জোত্যি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সাবরিনা আসলো নীরুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প  বলে চলে গেলো ।

পপুলারে নীরু কিছুটা সুস্থ হয়ে গেলে আমরা নীরু কে ইস্কাটনে মানুর বাসায় নিয়ে আসলাম , মানু আগে থেকেই একটা রুম ঠিক করে রেখেছিলো , আমি হাসপাতাল থেকে এসেই রুম গোছাতে শুরু করি , রুম গোছানো শেষ হলে নীরু কে শুয়ে দিয়ে আমি নীরুর জন্য খাবার নিতে যাই। রাত ১০ টা পর্যন্ত ওই রুমে সবার যাতায়াত ছিলো ।

রাত ১০ টার পর ওই রুমটাতে আমি, নীরু আর আমার ছোট মেয়ে ঐশ্বর্য ।

নীরু বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তো আর আমি, ঐশ্বর্য ফ্লোরে এক কোণায় ঘুমিয়ে পড়তাম,  শীতের রাতে মাঝে মাঝে ফ্লোরের ঠান্ডায় গা কাঁপুনি দিয়ে উঠতো। তারপরো আমার কিংবা আমার মেয়ে ঐশ্বর্যর কোন অভিযোগ নেই কারণ নীরু আমাদের প্রান যে করেই হোক ওকে সুস্থ হতেই হবে ।

রাতের ইতিহাস খুবই কঠিন , সারারাত নীরু ঘুমায় না আমাকে মাথার কাছে বসিয়ে অনেক গল্প করে । মাঝে মাঝে হু হু করে কান্না করে উঠে । মার কথা জিজ্ঞেস করেছে অনেক বার  আমি উওর দিতে পারিনি , কিই বা বলবো আমি ।

আমার ছোট মেয়ে ঐশ্বর্য ওর মামার পায়ের কাছে সবসময় বসে থাকে,  রাতে যখন আচমকা নীরুর কান্নার শব্দে ঐশ্বর্যর ঘুম ভেঙ্গে যায়,  ঐশ্বর্য তখন  ওর মামার পায়ের কাছে বসে পা দুটো জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে আল্লাহ্ কে বলে ” আল্লাহ্ তুমি আমার মামাকে সুস্থ করে দেও ” নীরু তখন ঐশ্বর্য কে কাছে ডেকে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে , আল্লাহ্ আমাকে খুব তারাতারি সুস্থ করে দিবেন মা ।

নীরু প্রায় মাঝে মাঝে আমাকে বলতো , জানিস ছোট আপা আমার না একটা শেষ ইচ্ছে আছে ,

আমি বলতাম কি ময়না আমাকে বল 

নীরু তখন আমাকে বলতো 

” ছোট আপা তুই শুধু আল্লাহ্’র কাছে খুব খুব দোয়া কর আল্লাহ্ যেন আমাকে দুই বছর বাঁচিয়ে রাখে , আমার খুব ইচ্ছে আমি ঢাকা শহরে একটা ফ্ল্যাট নিবো তোকে ঐশ্বর্য কে ওই বাসায় রাখবো , আমি ৬ মাস পর পর এসে তোদের নিয়ে ঘুরতে যাবো ।

আমি নীরুর কথা শুনে চুপচাপ চোখের পানি ফেলি , কিছুই বলতে পার না , মনে মনে বলি হে আল্লাহ্ আমার সোনা ভাইকে শুধু দু বছর না যুগ যুগ বাঁচিয়ে রেখো ।

১৭ ডিসেম্বর ২০১৩ ।

হঠাত্ করেই নীরু সেদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে,  সবাই মিলে নীরু কে হাসপাতালে নিলো , রাত নয় টার দিকে ওর ডায়ালাইসিস করা হলো , আমি আর আমার মেয়ে ঐশ্বর্য সেদিন নীরুর সাথে ছিলাম ।

সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না,  চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল ।

রাতে যখন ওকে নিয়ে বাথরুমে নিয়ে গেলাম ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে উঠলো,  তুই আমার ছোট আপা না তুই তো আমার মা , আমার মা ।

শুনে বুকটা হু হু করে উঠলো,  মা বেঁচে  থাকলে নীরুর এমন দেখলে হয়তো সহ্য করতে পারতো না ।

এভাবেই ছোট মেয়ে ঐশ্বর্য কে নিয়ে নীরুর সাথে কেটে যাচ্ছিল দিন গুলো ।

৫ জানুয়ারি ২০১৪ ,

হাসপাতাল থেকে নীরু কে মানুর বাসায় নিয়ে আসলাম , সবাই এক এক করে নীরুকে দেখতে আসলো , নীরু একটু সুস্থ তখন , তবে রাতে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়তো , আমি বার বার মানু আর ওর জামাই কে ডাকতে চাইলে নীরু আমাকে বলতো ওরা ঘুমাচ্ছে তুই আমার মাথার কাছে বসে থাক , হাত দিয়ে আমার মাথা ছুঁয়ে বলে তুই আমার মা , আমার কলিজা ।

৭ জানুয়ারি ২০১৪  ,

অনেক দিন হলো ঢাকা এসেছি কোথাও যাওয়া হয়নি  , লুনা বারবার ওর বাসায় যেতে বলছিলো ।

নীরু যেহেতু একটু সুস্থ তাই নীরু আমাকে লুনার বাসায় যাওয়ার অনুমতি দিলো  ।

আমি,  ঐশ্বর্য,  মানুর দুই মেয়ে মীম, মুহু সহ লুনার বাসায় গেলাম । যাওয়ার মিনিট বিশেক পর মানু ফোন করে বললো ছোট আপা নীরু শুধু তোকে খুজতেছে, তুই তারাতারি আয় ।

দ্রুত বাসায় এসে আমি নীরুর মাথার  কাছে বসলাম ।

ঐশ্বর্য সেদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো ,প্রচন্ড জ্বর, ঐশ্বর্য এসে নীরুর পায়ের কাছে শুয়ে পড়লো ।

নীরু বারবার বলছিলো আমার জন্য ঐশ্বর্যর অনেক কষ্ট হচ্ছে ওকে বল আমরা কালকে সবাই একসাথে পীরগাছায় যাবো ।

আমি বললাম না না আগে তুই সুস্থ হ তার পর যাব ।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যার পর রাত হলো , রাত ১০.৩০ এ নীরু কে বিছানায় শুয়ে দিয়ে,  আমরা মা মেয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম । 

রাত যখন ঠিক ১১ টা হঠাৎ নীরু খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো,  ওর দুই পা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে , আমি খুব ভয় পেয়ে যাই তখন বাসার সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম । ছোট বোনের জামাই কিছুক্ষণ পর নীরুর মুখে একটু পানি দিতেই নীরু যেন থমকে গেলো ।

আমরা সবাই কান্না করতে করতে বাইরে চলে এলাম , আমার ছোট মেয়ে ঐশ্বর্য রুম থেকে এক সেকেন্ডর জন্য তার মামা কে ছেড়ে বের হচ্ছিল না,  মামার মাথার পাশে বসে আছে।

 ৫ কি ১০ মিনিট পর ঐশ্বর্য এক দৌরে রুম থেকে বের হয়ে সবাই কে ডাকতে থাকে চিত্কার করতে থাকে 

“তোমরা কে কোথায় আছো এসো মামা মারা যায় নাই আমার মামা বেঁচে আছে , আমার মুখের দিকে মুখ করে আমার শরীরে খুব জোরে একটা নিশ্বাস ফেলেছে ” 

ঐশ্বর্যর মুখে এমন কথা শুনে আমরা সবাই রুমে চলে আসলাম , আল-তামাস তারাহুরা করে ফ্ল্যাটের একটা ডাক্তারকে ডেকে আনলো , ডাক্তার এসে নীরু কে দেখে বললো হ্যা কিছুক্ষণ আগেই উনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

এক নিমেষে সব কিছু শেষ হয়ে গেলো , সবাই খবরটা শুনে ছুটে এলো , সারারাত আমরা সবাই নীরুর কাছে ,কিন্তু আমার আদরের ছোট ভাই নীরু আমার সাথে আর কথা বলছে না,  আমাকে ছোট আপা বলে আর ডাকছে না ।

এভাবে রাত চলে গেলো ভোরের দিকে একটা গাড়িতে আমি , ঐশ্বর্য, মুন্নি, জোত্যি, আলো   নীরু কে নিয়ে পীরগাছার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । মনে হচ্ছিলো পুরো পৃথিবী থমকে গেছে । আমি নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলাম না ।

দীর্ঘক্ষণ পর আমরা নীরু কে নিয়ে পীরগাছায় পৌছে গেলাম , নীরু কে রাখা হলো নীরুর প্রিয় কামরাঙা গাছের নিচে । সবাই ছুটে ছুটে নীরু কে দেখতে এলো , আমার আদরের নীরু কামরাঙা গাছের নিচে  ঘুমিয়ে আছে । এক এক করে সবাই এলো গেলো কিন্তু নীরু নিশ্চুপ হয়ে আছে একদম শান্ত শিষ্ট । 

সময় হয়ে এলো সবাই  নীরু কে আব্বা মার পাশে শিউলি গাছের তলে সারা জীবনের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিলো । আমি আর আমার সোনা ভাইটাকে একটা বারের জন্য চোখে দেখবো না আমাকে আর কেউ বলবে না  ছোট আপা তুইতো আমার মা। কেউ আর বলবে না ।

আজ অনেক বছর হলো নীরু আমাদের মাঝে নেই শুধু আছে স্মৃতি আর ভালোবাসা । 

আল্লাহ্ আমার ভাই টাকে তুমি জান্নাতবাসি করিও । 

ফিদা হাসান গিনি ( নীরু’র ছোট আপা ) 

কামাল কাছনা রংপুর 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.