‘আদুরী’ তিন শব্দের ছোট্ট, সুন্দর একটা নাম। নামটির প্রতিটি শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে রাজ্যের আদর-স্নেহ, আবেগ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা। শব্দটির সৃষ্টিই হয়েছে বাবা-মায়ের প্রাণপ্রিয় সন্তানের প্রতি সুগভীর মমত্বের নির্যাসে। যেখানে স্নেহময়ী মা কিংবা আবেগাপ্লুত বাবার হৃদয় থেকে সন্তানের প্রতি উৎসারিত হয় পৃথিবীর সেরা দরদমাখা উচ্চারণ।
সেই ‘আদুরী’র প্রতি এ কেমন আদর বা সমাদর!
গৃহপরিচারিকা দশ বছরের ছোট্ট শিশু আদুরীর জীবন ও শরীরের ওপর যে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তা যে কোনো সভ্যতাকে হার মানায়। যে কোনো বর্বরতাকে পেছনে ফেলে দেয়।
হায় আদুরী! হায় তার নিয়তি!
জানা যায়, ২২ সেপ্টেম্বরের সকালে আদুরীকে বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেল লাইন সংলগ্ন একটি ডাস্টবিনের পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়া ও নির্যাতনের চিহ্ন ছিলো জাজ্জ্বল্যমান।
এরপর কঙ্কালরসার মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ডাস্টবিনের পাশ থেকে এ শিশুটিকে উদ্ধার করেছিলেন লিলি আক্তার নামের এক নারী। আদুরীর সমস্ত শরীর জুড়ে দগদগে পোড়া ক্ষত। ঠোঁট ফুটো হয়ে গেছে গরম খুন্তির ছ্যাকায়, ব্লেডের কাটাকুটি গোটা শরীরের এখানে সেখানে।
কি ছিলো মেয়েটির অপরাধ? তবে তাকাতে হবে একটু পেছনে, যদ্দুর জানা যায়, তা অনেকটা এরকম, দু’মাস আগে মা সাফিয়া বেগম তার অতি প্রিয় আদুরীকে ‘কাজের মেয়ে’ হিসেবে রেখে গিয়েছিল অভিজাত এলাকার গৃহকর্ত্রী নদী নামের জনৈকা ডায়নীর বাসায়।
আদুরীর গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। পাঁচ ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে সে নবম। ভাই সোহেল, দোয়েল, পান্না পটুয়াখালী নদীতে মাছ ধরে সংসার চালায়। বড় বোন তানিয়া, সোনিয়াও ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করে। বাবা বেঁচে নেই।
ডায়নী নদী’র বাসাতেই আদুরীর ;কাজের মেয়ে’ জীবন শুরু।
দিন রাত গাধার খাটুনি খাটতে হতো। কখনো না খেয়ে, কখনো উচ্ছিষ্ট খাবার আধা পেটা খেয়ে দিন কাটতো শিশুটির।
সুখ-শখ, আহলাদ মানুষের আজন্ম স্বভাবসিদ্ধ। আদুরীই বা এ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কেনো। আর তাছাড়া সে তো শিশু। তার তো শখটা আরো ব্যাপক এবং বিস্তুত। আর সেই শখের বশবর্তী হয়েই সে একদিন গৃহকর্ত্রীর কন্যাদের কানের দুল দেখে তা পরেছিলো। আর সেটাই হলো কাল। ধরা পড়ার পর থেকেই ক্রমাগত চলতে থাকলো অকথ্য নির্যাতন!
গরম খুন্তি দিয়ে খোঁচা দেয়া, ইস্ত্রি গরম করে পিঠে ছেঁকা দেয়া, সাথে মারধোর তো আছেই। গৃহকর্ত্রীর দুই কন্যা ব্লেড দিয়ে রক্তাক্ত করেছে শিশু আদুরীর শরীর। বর্তমানে ঢাকা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় চিকিৎসা চলছে আদুরীর।
কংকালসার শিশুটি যে অনেকদিনের অভুক্ত তা স্পষ্ট বোঝা যায় পাঁজরের হাড়গুলো দেখে, শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি জুড়ে তার নতুন কেবল দগদগে ক্ষত, মাথায় খাবলা খাবলা দিয়ে উঠে গেছে চুল।
কি বলবেন এটাকে? সভ্যতা?
‘আদুরী’ যে মেয়েটির এমন একটি নাম। সেই দশ বছরের ছোট্ট শিশুটির তো আদর-সোহাগ, স্নেহ-ভালোবাসাতেই বেড়ে এঠার কথা, তাই না? কিন্তু তার সারা দেহে এ কোন আদর-সোহাগের চিহৃ! আদুরীদের জন্য এই কি প্রকৃত ‘আদর’ নির্ধারিত? আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, মানবতা তবে এসব ইস্যুতে এতোটা নীরব কেনো!
কী সাংঘাতিক নদী নামের ডায়নী ও তার সন্তানদের মারণ কামড়? কী পাষন্ড! কী নির্মম! কী বর্বর!
এ নির্যাতন কচি মাসুম শিশু আদুরীর জীবনে পাল্টে দিয়েছে আদর-স্নেহ, ভালোবাসার সংজ্ঞা!
পত্র-পত্রিকায় আদুরীর যে ছবি ছাপা হয়েছে তার চাইতে মর্মস্পর্শী ছবি বুঝি আর হয় না। এখানে সব মানবতা থমকে যায় যায়। সভ্যতা চমকে যায়!
দশ বছরের একটি কচি শিশুর প্রতি জানোয়ার সদৃশ্য গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের এ চিত্র আমাদের আজ এমন একটি বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায় যে, ‘সভ্যতার’ পোষ্টার-প্ল্যাকার্ড বুকে ধারণ করার যোগ্যতাটুকুও এখন আর আমাদের নেই।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এক আদুরীই এই অমানবিক ঘটনার শেষ পরিণতি নয়। ছিলোও না। কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে, একটা করে ঘটনা প্রকাশ পায়. ‘উহু:’ ‘আহ্’ শব্দের বাতাসে মানবতা নড়ানড়া করে; পরিশেষে আবার যে লাউ, সেই-ই কদু!
আমাদের নগর জীবনে গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর ক’টাইবা প্রকাশ পাচ্ছে? কী কঠিন নির্যাতনে লোকচক্ষুর অন্তরালে কতোজনকে যে প্রাণ দিতে হচ্ছে সে খবরই বা কে রাখে। তবে একটা কথা দিনের আলোর মতোই পরিস্কার যে, দিনে দিনে পাষন্ড নদীদের সংখ্যা বাড়ছে আর একই সাথে বাড়ছে নির্যাতিতের ঘটনা।
আর কতো নিশ্চুপ থাকবে হে মানবতা? ‘আদুরী’দের রক্ষা করার দায়িত্ব কি তোমাদেরও নয়?
ধন্যবাদ সবাইকে।
মাহাবুবুল হাসান নীরু
ক্যালগেরি, কানাডা।