কার্ল মার্কস-এর প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখের খণ্ডচিত্র

কার্ল মার্কস-এর প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখের খণ্ডচিত্র

(৫ মে কার্ল মার্কসের জন্মদিন উপলক্ষে)

মোনায়েম সরকার: কার্ল মার্কস এবং জেনি ভন ওয়েস্টফালেন শৈশবে থাকতেন জার্মানির ট্রিয়ের শহরে। জেনির ভোট ভাই এডগার ছিলেন কার্ল মার্কস-এর সহপাঠী এবং বন্ধু। এই সুবাদেই জেনি, এডগারদের পরিবারে যাতায়াত, তারা হয়ে উঠলেন কৈশোরের খেলার সঙ্গী ও বন্ধু। তারা ক্রমশ বড় হন মার্কস ও জেনি ক্রমশ অনুভব করেন তারা প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন। বোরন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়েই মার্কস জেনিকে উদ্দেশ্য করে বেশ কয়েকটি কবিতা লেখেন। তার একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি হল,

“My heart profoundly fetterd

My soul’s eye clearer grew

What I had vaguely, hoped  for yor,

I found at last in you.”

আরেকবার কার্ল মার্কস চিঠিতে জেনিকে বলেছিলেন, ট্রিয়েরের তরুণেরা যখন তোমার সুন্দর মুখের দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে ভাবে এই শহরের সেরা বিদূষী ও সুন্দরী হল জেনি, তখন আমার গর্বই হয়। এই সুন্দরী বিদূষী তরুণী আমার সহযোদ্ধা, আমার প্রণয়ী।

জেনি ভন ওয়েস্টফালেন-এর জন্ম ১৮১৪ সালে এবং কার্ল মার্কসের জন্ম ১৮১৮ সালের ৫ মে। সেই অর্থে জেনি মার্কস-এর চাইতে বয়সে কিছুটা বড়।

কার্ল মার্কস-এর পুরো নাম কার্ল হেনরিক মার্কস। তার বাবা হেনরিক এবং মা উভয়েই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং উদার মতাবলম্বী। তাদের আট সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে শৈশবেই মারা যায়। ক কার্ল মার্কস এবং তার তিন বোন জীবিত ছিলেন। কার্ল মার্কস পরিবারের সকলেরই ছিলেন আদরের। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য, গণিতশাস্ত্র, দর্শন, আইনশাস্ত্রে হলেন খ্যাতিমান। কার্ল মার্কস-এর দর্শন ও মতবাদ নিয়ে বর্তমান পৃথিবীতে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তার মতবাদ সংগ্রামী মানুষের জীবনে প্রেরণা হিসাবে এসেছে। মার্কস ও এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার সারা পৃথিবীতে প্রায় সমস্ত ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে। একমাত্র বাইবেল ছাড়া অন্য কোনও বই এত ভাষায় অনূদিত হয়নি। তার রচিত গ্রন্থ  ‘দ্য ক্যাপিটাল’, ‘মজুরী শ্রম ও পুঁজি’ তার আবিষ্কৃত উদ্বৃত্ত শ্রম তত্ত্ব সারা পৃথিবীর অর্থনীেিত আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তার রচিত প্রবন্ধগুলি ‘ফ্রান্সে শ্রেণি সংগ্রাম, জার্মান দর্শন, লুই  বোনাপার্ট এবং আঠারই ক্রমেয়ার’ গ্রন্থ এবং ‘ভারতের ভূমি ব্যবস্থা ও ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ’ সংক্রান্ত রচনাবলী মানব সমাজকে নতুন দিশা দেখিয়েছে।

জেনি ওয়েস্টফালেনও ছিলেন অভিজাত পরিবারের মেয়ে। তার ঠাকুর্দা সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা, বাবা গ্রুশিয়ার ডিউকের অন্যতম উপদেশক। তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে মার্কস-এর পিতার সখ্য ছিল। এই সূত্রেই দুই পরিবারের যোগ এবং  কৈশোরের সঙ্গি এবং পরে প্রণয়। ১৯৪২ সালের মার্চে মার্কস প্রথম হেগেলের রাষ্ট্র আইন এবং সংবিধানিক রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে আলোড়ন জাগানো প্রবন্ধ লেখেন জেনি তখন তার পাশে। ১৯৪৩ সালের ১৯ জুন কার্ল মার্কস এবং জেনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। এরপর দুজনের নতুন করে ঝড়ের জীবন। মার্কস বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করেন। নিজস্ব মত প্রচারের জন্য সাপ্তাহিক কাগজ প্রকাশ করেন। জেনি সহযোগী। প্রুশিয়ার পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বিষদৃষ্টিতে পড়েন। তারা ফ্রান্সে চলে আসেন, এখানেও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এবার ফ্রান্স থেকে তাদের চলে যেতে হয়।  এলেন ব্রাসেলস-এ। এখানে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে উদ্যোগী এঙ্গেলস তার সহযোদ্ধা। এখানেও জেনি তার পাশে। পুলিশ মার্কস ও জেনিকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ব্রাসেলস থেকে বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসেন প্রুশিয়ায়। প্রুশিয়া থেকে আবার বিতাড়ন, পুনরায় ফ্রান্সে। ফ্রান্স থেকে আবার বিতাড়ন।

এবার আশ্রয় নেন লন্ডনে। এখানে শ্রমিক অঞ্চলে বসবাস করা শুরু করেন। এখান থেকেই কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সঙগঠন গড়ায় উদ্যোগী হন। এখানেই জীবনাবসান হয়। কঠিন কষ্টের জীবন অতিবাহিত করেছেন মার্কস ও জেনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মার্কস তার স্ত্রীকে তরুণী প্রেমিকের মতই ভালো বেসেছেন। মার্কস ও জেনির সাত সন্তানের মধ্যে তিন মেয়ে বেঁচেছিলেন। বাকি চারজন শৈশবে মারা যান। এই যন্ত্রণা মার্কস ও জেনিকে সহ্য করতে হয়েছে। আর্থিক কষ্ট তাদের জীবন ঘিরে রেখেছিল। এক সন্তান মারা যাওয়ার পর তার কফিন ও কবরের খরচ দিয়েছিল এক প্রতিবেশী। মার্কসের তিন মেয়ে তিনজনই ছিল বিদূষী। বড় মেয়ের নামও ছিল জেনি। জেনি কার্ল মার্কস পরবর্তীকারে জেনি কার্ল লঙ্গুয়েট। সে বিয়ে করে কমিউনিস্ট আন্তজাতিক নেতা চার্লস লঙ্গুয়েটাকে। মেজ মেয়ে নোরা বিয়ে করে পল লাফার্গকে। দুজনেই মার্কস-এর সহযোদ্ধা, কমরেড। লোরা তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, মার্কস শত কাজের মধ্যেও স্ত্রী এবং মেয়েদের সময় দিতেন। সময় পেলে বেড়াতে যেতেন। দাবা খেলতেন। স্ত্রী এবং মেয়েদের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা বলতেন। মার্কস-এর পরিবারের আরও একজন যুক্ত হয়েছিলেন। তার নাম হেলেন ডেমুথ। তিনি জার্মানিতে জেনির মায়ের পরিচর্যা করতেন। জেনির মায়ের মৃত্যুর পর তিনিও চলে আসেন মার্কাস ও জেনির কাছে লন্ডনে। এখানে অসুস্থ জেনি ও মার্কস-এর পরিচর্যা এবং তাদের মেয়েদের সেবা যতেœর দায়িত্ব নিয়ে তিনিও যেন এই পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। কার্ল মার্কস, হেন এবং তাদের সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জার্মানির শাসকবর্গ কনোন ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক মামলা। মার্কস ও জেনি এবং তাদের পরিবার লন্ডন থেকে এই মামলা পরিচালনা করেছেন এবং এই ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতকি জনমত গড়ে তুলেছিলেন। ইতিমধ্যে জেনি ও মার্কস, উভয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন। জেনি মার্কস লিভার ক্যানসার রোগে আক্রান্ত। মার্কস-এর ছোট মেয়ে এলিয়নের ডাকনাম টুসি এ বিষয়ে তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, মার্কস প্রতিদিন জেনির ঘরে ঢুকে গল্পে আড্ডায় মাতিয়ে রাখতেন। আমরা ঘরে যেতাম, কিন্তু মজা করে শুনতাম যেন দুই তরুণ-তরুণী জীবনের জয়গান গাইছেন। জেনি মার্কস-এর জীবনাবসান হয় ১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর। এতে মার্কস-এর মন ভেঙে যায়। এরই মধ্যে মার্কস-এর জীবনে আবার আঘাত তার বড় মেয়ে জেনি লেঙ্গুয়াটের জীবনাবসান হয়। মেয়ের বয়স তখন ৩৮। মার্কস ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হন। তার জীবনাবসান ঘটে ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ। সারা পৃথিবীর অনেক মানুষই ধর্মের মধ্যে মানসিক আশ্রয় খোঁজে। অনেক আর্ত মানুষ ধর্মে আশ্রয় খোঁজে পরিত্রাণের আশায়। মোল্লা-পুরোহিতেরা ধর্ম নিয়ে নানা বিধান দেয়, ধর্মকে তারা ব্যবহার করে। মার্কস ও জেনি এ বিষয়টি মেনে নেননি। তাই কোনও ধর্মীয় সংগঠন মার্কস জেনিকে স্বীকৃতি দেয়নি। যারা ধর্মকে অস্বীকার করে ইংল্যান্ডের কোনো চিরাচরিত কবরখানায় তাদের কবর দেওয়া যায়নি। তবে এই ‘নাস্তিক’দের কবর দেওয়ার জন্য হাইগেট কবরখানায় একটি নির্দিষ্ট জায়গা অবশ্য ছিল। এখানেই কবর দেওয়া হয়েছে মার্কস পত্নী জেনিকে এবং পরবর্তীকালে কার্ল মার্কসকে। আজীবন ঝড়ের মধ্য দিয়ে চলা সহযোদ্ধা। রোমান্টিক প্রণয়ী মার্কস ও জেনি, এখানেও তারা পাশাপাশি।

বিশ্বের বহু মানুষ ও মণীষী লন্ডন গেলে মার্কসের সমাধি দেখতে যায়। একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী একজন মার্কস জন্ম নিলে দুর্বিত্তায়িত বিশ্বকে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে শান্তির বিশ্বে পরিণত করা যেতো।

-০৮ মে, ২০১৭

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.