জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যদেরই মনোনয়ন দিতে হবে

জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যদেরই মনোনয়ন দিতে হবে

মোনায়েম সরকার: একটি নতুন জাতীয় দৈনিক প্রকাশিত হয়েছে অতি সম্প্রতি। এতে প্রথম দিনই তারা যে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, তাতে বলা হচ্ছে ২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি যে সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের ১০০ জন নতুন করে মনোনয়ন না পাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। উক্ত সংবাদপত্রে তাদের অনেকের নামও প্রকাশ করা হয়েছে এবং কী কারণে তারা মনোনয়ন না পেতে পারেন, তার কিছু সম্ভাব্য কারণও বর্ণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ, নির্বাচনী এলাকার ভোটার, জনসাধারণ এমনকি দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগহীনতা; আরও আছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার রেকর্ড, বিতর্কিত ভূমিকা গ্রহণ করে দল ও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার মতো কাজ। বিগত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংসদের সব আসনে প্রার্থী দেয়নি। কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল জোটসঙ্গীদের। কিছু আসনে হয়েছিল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কীভাবে অংশ নেবে, তা অবশ্য এখনো স্পষ্ট নয়। তাছাড়া নির্বাচনের এখনো প্রায় এক বছর বাকি। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বভাবতই ৩০০ আসন সামনে রেখেই দলীয়ভাবে কাদের মনোনয়ন দেওয়া যায়, তা বিবেচনা করে দেখছেন। বিভিন্নভাবে তিনি খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সাংগঠনিকভাবে খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব উপায়েও বরাবর খোঁজ নিয়ে থাকেন তিনি। দলে যারা ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত, তাদের সঙ্গেও তিনি পরামর্শ করেন বলে জানি।

ইতোমধ্যে একাধিকবার তিনি দলীয় ফোরামে বলেছেন, যাদের কর্মকা- ও ভাবমূর্তি ইতিবাচক নয়, তাদের আর মনোনয়ন দেওয়া হবে না। যাদের ভূমিকায় দল ও সরকার বিব্রত হয়েছে, তাদের আগামীতে সংসদে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। সেটাই স্বাভাবিক। অনেকে আবার বয়োবৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় কিংবা অসুস্থ বলে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় মনোনয়ন না পেতে পারেন। সে বিষয়টি আলাদা। সেটা তারা হয়তো সহজে গ্রহণও করবেন। নবীন নেতাদের সামনে আসার সুযোগ করে দেওয়ার কাজটা তারা নিজেরাও করতে পারেন। এটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমাদের রাজনীতিতে নিজে থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা অবশ্য কম। অনেকে আবার চান, পরিবারের কেউ তার শূন্য স্থান পূরণ করুক। যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকলে সে বিষয়ে কারো আপত্তি অবশ্য থাকে না। কিন্তু চাপিয়ে দেওয়ার মনোবৃত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। দলীয় সভাপতিকে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। দল ও সরকারকে যারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদেরও ছাড় দেওয়া উচিত হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবেচনার ওপর সবার আস্থা আছে। নিজস্ব উপায়ে খবর সংগ্রহ করে তিনি দলীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্যও যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই প্রত্যাশা।

আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলেই সবাই মনে করছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমনটিও বলেছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের মতো হবে আগামী নির্বাচনটি। আমরা জানি, কোন্ প্রেক্ষাপটে সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তেমন প্রেক্ষাপট গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কেউ অবশ্য প্রত্যাশা করে না। সংবিধানের আওতায়, গণতান্ত্রিক আবহেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বিএনপির পক্ষ থেকে যে দাবি অব্যাহতভাবে জানানো হচ্ছে, তা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে এবং তাতে সম্ভাব্য সবাই অংশ নিতে পারবে। সংবিধানের আওতায় তার ব্যবস্থা করা হবে বলেই আশা করি। বিরোধীদের আশ্বস্ত করতে তাদের কিছু দাবি মেনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। সব মিলিয়ে এটা বারবারই বলা হচ্ছে, ২০১৪ বা ১০১৮ সালের নির্বাচনের মতো হবে না আগামী নির্বাচনটি। সে নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও উন্নয়নের বিষয়ে দৃষ্টি রাখা প্রভাবশালী দেশগুলোরও আগ্রহ আছে। তারা অব্যাহতভাবে আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার ওপর জোর দিচ্ছে। মাঠের বিরোধী দলের জন্য অধিকতর রাজনৈতিক সুবিধার দাবিকেও তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন যে অতীতের মতো সহজ হবে না, এটা ধরেই নেওয়া যায়। সরকারের সব পর্যায় থেকেও তাই একথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন মোকাবেলার প্রস্তুতিও শুরু করেছে অন্যদের চেয়ে আগে। তা সামনে রেখেই ইতোমধ্যে যারা এমপি হিসেবে আছেন, তাদের পারফরম্যান্স বিচারের প্রশ্নটি দলীয় হাই কমান্ডের সামনে চলে এসেছে। তাতেই দেখা যাচ্ছে, ১০০ এমপি আছেন নতুন মনোনয়ন না পাওয়ার ঝুঁকিতে। আমরা আশা করব, সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেই আগামী নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। মনোনয়ন প্রদান নিয়ে গতানুগতিক যেসব অভিযোগ উঠতে দেখা যায়, সেগুলো থেকেও মুক্ত থাকতে হবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। তাতে দলের ভাবমূর্তি ভালো হবে। সর্বোপরি দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে রাখতে হবে সতর্ক দৃষ্টি।

আওয়ামী লীগের যে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে গত বছরের শেষদিকে, তাতে কিন্তু দলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে উল্লেখ করার মতো কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০২৪ সালের নতুন প্রেক্ষাপটের নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশিত ছিল। তৃণমূলেও এ ধরনের প্রত্যাশা ছিল বলে মনে হয়। তা না হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের শেষ ভরসাস্থল শেখ হাসিনার ওপর সবাই আস্থা রাখবেন। সরকার ও দল পরিচালনায় সম্ভাব্য সব দিকে তার সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে বলেই বিশ্বাস করতে চাই। দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সঙ্গে দল পরিচালনা করে তিনি এ কাজে দক্ষ। কাকে দিয়ে কী কাজ হবে, সেটা তিনি সবচেয়ে ভালো জানেন। তার ওপর ১৯৯৬-এর পর ২০০৮ সাল থেকে তিনি সরকার পরিচালনা করছেন তিন মেয়াদে। প্রশাসন পরিচালনায়ও তিনি দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে একথা ঠিক, তার দূরদৃষ্টি ও গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবাই চলতে পারেননি। দল ও সরকার উভয় ক্ষেত্রে অনেকের বেলায়ই এটি ঘটতে দেখা গেছে। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে ছিটকে পড়েছেন। সরকার, এমনকি দল থেকে বাদ পড়েছেন তারা। এদের অনেককে আবার মার্জনা করে দলে ফিরে আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বৈকি। দলে যারা অপরিহার্য নন, তাদের ফিরিয়ে আনা জরুরি ছিল না বলেই মনে হয়। এ অবস্থায় দলীয় মনোনয়নে সহজে এমপি হয়ে যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, দলের জন্য দায় হয়ে উঠেছেন, তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হওয়ার সুযোগ নেই। আগামী নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে, এটা ধরে নিয়েই প্রার্থী বাছাই করা প্রয়োজন বলে মনে করি।

যে কোনো দলের সরকার দীর্ঘদিন একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকলে সে দলের ক্ষমতালিপ্সুদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সুশাসন দেওয়াও কঠিন হয়ে আসে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ একটি পুরনো ও বড় রাজনৈতিক দল এবং এই দলে রয়েছেন অনেক নেতা। ইতিবাচক ভূমিকা না রেখেও আবার অনেকে দলে ও সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদ দাবি করেন। তাদের সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। তবে আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ নেই, এটাও বাস্তবতা। এ অবস্থায় সরকারে ও দলে যারা অপরিহার্য নন, বরং এরই মধ্যে বোঝা হয়ে উঠেছেন, তাদের বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্যদের নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে তাকে। তৃণমূলের নেতাকর্মীই আওয়ামী লীগের প্রাণ। তাদের কাছে যারা আস্থাভাজন, তাদের কাছে টানতে হবে। প্রতিটি সরকারের আমলেই প্রশাসনের মাধ্যমে দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিষয়ে কিছু খোঁজ পেয়ে থাকে ক্ষমতাসীন দলের হাই কমান্ড। সরকারের জনসমর্থন বিষয়েও একটা ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা অনেক সময়ই বাস্তবতার সত্যিকার প্রতিফলন না হয়ে হয় খ-িত বা মনগড়া। প্রধানমন্ত্রীকে তাই এ ধরনের প্রতিবেদন যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা করে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিরপেক্ষ সংস্থা দ্বারা পরিচালিত জরিপ বা অনুসন্ধান এক্ষেত্রে পথ দেখাবে সন্দেহ নেই।

লেখার শুরুতে সংবাদপত্রের যে প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছি, তাতে কয়েকজন মন্ত্রীর মনোনয়ন না পাওয়ার ঝুঁকির কথাও তুলে ধরা হয়েছে। মিডিয়ায়ও অনেক মন্ত্রীর পারফরম্যান্স নিয়ে প্রায়শ প্রশ্ন তোলা হয়। এদিকে, সরকার ও প্রশাসনসহ অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ব্যক্তিকে করে রাখা হয়েছে ‘বিকল্পহীন’। ধারাবাহিক ব্যর্থতা এবং বারবার সমালোচিত হওয়ার পরও তাদের গুরুদায়িত্ব থেকে সরানো হচ্ছে না কেন, সে প্রশ্ন জনমনে রয়েছে। এদের কারও কারও দুর্নীতির বিষয়ে সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় সচিত্র প্রতিবেদনও ছাপা হয়। এর সত্যাসত্য যাচাই করে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অচিরেই একজন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদেও মনোনয়ন দিতে হবে। আগামী নির্বাচনে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে তিনি যাতে তা সামাল দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন, তেমন ব্যক্তিকেই আমরা রাষ্ট্রপতি পদে দেখতে চাই। পাশাপাশি মেয়াদের শেষ বছরে দল ও সরকারের মধ্যে পরিচালনা করতে হবে শুদ্ধি অভিযান। উন্নয়নের চলমান ধারার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পরের মেয়াদেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার বিকল্প এখনও দেখা যাচ্ছে না।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.