
মোনায়েম সরকার: ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ নয় মাস তিনি অন্ধকার জেলখানায় আটক থাকেন। পাকিস্তানি জেলে শেখ মুজিব সীমাহীন শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেন। সেখানে তাঁকে হত্যা করারও চক্রান্ত করা হয়। কিন্তু সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে যুদ্ধজয়ী বীরের বেশেই স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন হয় তার।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জানুয়ারির ৮ তারিখে (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের ৬৩৫ নং ফ্লাইটটি লন্ডনে পৌঁছালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র এবং কমনওয়েলথ অফিসের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় ব্রিটেন-প্রবাসী বাঙালিদের গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বিমানবন্দর।
লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’এ ওঠেন। এখানে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তাঁর প্রতি সাংবাদিকদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, তিনি কেন ঢাকা না-গিয়ে প্রথমে ব্রিটেনে এসেছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমাকে লন্ডন পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকারের। আমি তাদের বন্দি ছিলাম।
লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। বঙ্গবন্ধুর এ কথা প্রচারের কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটেনের সরকারি কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ-এর সঙ্গে তাঁর সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঐদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট-এ সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ তখন সদ্যস্বাধীন একটি দেশ। মহাপরাক্রমশালী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তাঁর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা মি. হিথ নিজেই খুলে দেন।
হিথ-মুজিব’ সৌজন্য সাক্ষাৎকালে শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এডওয়ার্ড হিথ যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ে স্বীকৃতিদানের আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের পর কমনওয়েলথ এর সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর হোটেল কক্ষে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ৯ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু দিল্লির উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন।
১০ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। ব্রিটেনের রয়াল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানটি দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উজ্জ্বল সূর্যালোকে দৃপ্ত পায়ে বিমান থেকে নেমে আসেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতার নয়নের মণি। এই সময় তার পরনে ছিল ধূসর রঙের স্যুট এবং কালো ওভারকোর্ট। তিনি বিমান থেকে নামার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরেন প্রিয় নেতাকে। ২১ বার তোপধ্বনি করে ভারত অভিবাদন জানায় বাংলাদেশের মহান নেতাকে। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। বিশ্বের ২০টির বেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন। পুরো এলাকা বাংলাদেশ এবং ভারতের পতাকায় সজ্জিত ছিল। তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল তাঁকে গার্ড অফ অনার প্রদান করেন। দিল্লিতে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন শেখ মুজিব। দিল্লিতে বাংলায় ভাষণ দিয়ে দিল্লির মানুষের মন জয় করেন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১০ জানুয়ারি সকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল। ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পূর্বে ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের কমেট বিমানের পাইলটরা বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রায় পৌনে একঘণ্টা বিমানটিকে নিয়ে ঢাকার আশে চক্কর দেন। বঙ্গবন্ধু অশ্রুভরা চোখে দেখেন তার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বিরান বঙ্গভূমিকে। অবশেষে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ। বাংলার মহান নেতা এসে দাঁড়ালেন তার প্রিয় জনগণের মধ্যে। বাংলার মানুষ আনন্দাশ্রু আর ফুলেল ভালোবাসায় বরণ করে নিলেন তাদের প্রাণের নেতাকে। ৩১ বার তোপধ্বনি হয় তেজগাঁও বিমানবন্দরে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রী পরিষদ সদস্যরা স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। তাঁকে বহনকারী গাড়িটি জনতার ভিড় ঠেলে অত্যন্ত ধীর গতিতে এগুতে থাকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের দিকে।
তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বহনকারী ট্রাকটি লক্ষ লক্ষ জনতার মধ্য দিয়ে পিঁপড়ার মতো ধীরে ধীরে চলে প্রায় দু’ঘণ্টায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছায়। ইয়াহিয়ার বন্দিশালার দুর্বিসহ নিঃসঙ্গতা আর চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে যখন বলেন, ‘আমি আবার আপনাদের কাছে এসেছি। লক্ষ লক্ষ ভাই, মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো পরিমাপ নেই। এর কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনে…।’ তখন এমন কোনো বাঙালি ছিল না, যার নিজের চোখেও পানি জমেনি এবং আবেগে গলাটা রুদ্ধ হয়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছে। তিনি যখন মুক্ত হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলার মাটিতে আসেন, সেদিনই সূচিত হয় বাংলাদেশের প্রকৃত বিজয়।
১০ জানুয়ারি এলেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা বাঙালির মনে দোলা দেয়। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আক্ষরিক অর্থেই শুধু প্রত্যাবর্তন ছিল নাÑ সেটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিরও অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের পরে রাজনৈতিকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলা ও বাঙালির স্বাধীকার অর্জনের লক্ষ্যে জাতির পিতা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের যে গৌরব ছিল তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। ছাত্রলীগ থেকে যেমন অনেক ত্যাগী মানুষের জন্ম হয়েছে, তেমনি অনেক বিশ্বাসঘাতকও জন্ম নেয় এই প্রতিষ্ঠান থেকে। ছাত্রলীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের সঙ্গে প্রতারণা করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে ছাত্রলীগের অনেকেই খুনি মোশতাকের সঙ্গে যোগ দেন। কেউ কেউ গড়ে তোলেন আলাদা আলাদা দল। ছাত্রলীগের হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই এখন আওয়ামী লীগ বিরোধী জোটে বসে ষড়যন্ত্র করছে।
বঙ্গবন্ধু অনেক ঘনিষ্ঠ কর্মীও বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ঘাতক গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। এই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে সেদিনের অনেক ছাত্রনেতাও একাত্ম হয়েছিলেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে সক্রিয় ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও ঘৃণ্য চক্রান্ত। কিন্তু সেই চক্রান্ত বাস্তবায়ন করতে বিদেশিরা এদেশের কতিপয় লোভী ও বিভ্রান্ত রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যবহার করে। জাসদ সৃষ্টির পরেই বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। জাসদের উগ্রবাদী-সশস্ত্রগোষ্ঠী নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর চলার পথে বিঘ সৃষ্টি করে। জাসদ যদি বিপদগামী শক্তি না হয়ে দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর কাজে হাত লাগাতো তাহলেও অন্যরকম হতো বাংলার ইতিহাস। আজ একটি প্রশ্ন বারবার আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়, যে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়েছে, যার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, সেই মহানেতার মৃত্যুমুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষ কেন ঘর থেকে বের হলো না? এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভব বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক নেতার কাছেই নেই। বঙ্গবন্ধু আসলে কোনোদিনই ভুল ছিলেন না, ভুল বুঝেছিলাম আমরা। কিছু বিশ্বাসঘাতক নেতাকর্মী লাভের কারণে ও লোভের বশবর্তী হয়ে তাঁকে আকাশ থেকে টেনে মাটিতে নামিয়ে ছিল। আজ তারাও আস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন বঙ্গবন্ধুই সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত। বিভ্রান্ত নেতারা সঙ্গত কারণেই আজ পরিত্যক্ত। ছাত্রলীগের বিভ্রান্ত নেতারা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে উগ্রমতবাদ প্রচার করে রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পথ প্রশস্ত করে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১টি বছর শাসকগোষ্ঠী নানানভাবে চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট আঁধার হানা দিয়েছিলো বাংলার জনপদে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর আবারো মাথা উঁচু করে বাংলাদেশ অভিষিক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। সূর্যের ন্যায় উদিত হয়েছেন জাতির জনক তাঁর স্ব-মহিমায়। এ সূর্য, এ আলোকিত দিন কখনো হারাবার নয়। ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা আঁধাররূপী দানবীয় শক্তির উত্থান যাতে আর কখনো ঘটতে না পারে, সে দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। এ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে হবে। জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪৯তম বার্ষিকীতে সে দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার অঙ্গীকারই করতে হবে আমাদের। শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিগত বছরগুলোতে তার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ধারায় প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন। আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে দেশরতœ শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে সোনার বাংলা গড়ে তোলা। আশাকরি নতুন প্রজন্ম সমস্ত বিভ্রান্তি ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে ভুমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্ববন্ধু। কারণ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ শুধু বাংলাদেশে নয়Ñ জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তর ও বিশ্বের বহু দেশ তার জন্মশতবর্ষ যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন করবে। এটা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক সংবাদ। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করুক।
-মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।