ব্রান্ডটির জন্ম মে ১৯৯৫। এর বছর দু’য়েকের মধ্যেই আমার সঙ্গে পরিচয়। আ¯েÍ আ¯েÍ হৃদ্যতা। সময়ের সঙ্গে ব্র্যান্ডটির পূর্ণতা দেখতে দেখতে এগোনো। বাংলাদেশের ফ্যাশন মানচিত্রে ফেনোমেনা হয়ে ওঠা সেই হাউজটির দরজা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল ৩০ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ ১৭ বছর পর। আকস্মিক এই স্তব্ধতায় হতাশ অনুরাগীরা। তাদের মনে উদ্গত নানা প্রশ্ন। সঙ্গতও। ঠিকানা মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আগেই। এরই অংশ হিসেবে ছিল ক্লিয়ারেন্স সেল। সেপ্টেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহ। একাধিক দিন গুলশান আউটলেটে গিয়ে দেখেছি ফ্যানরা স্মৃতি আঁকড়ে ধরতে চাইছেন প্রাণপণে। কিনছেন যা পাচ্ছেন। যতটা পারছেন। রেখে দেয়া আরকি। স্মারক হিসেবে। সাইজ না মিললেও কিনতে দেখেছি অনেককে। কারণ এসব সংগ্রহ আর কখনোই মিলবে না। যা একেবারে অন্যরকম।
ঘরোয়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময়ের সম্পৃক্ততার কারণে আমিও যে নস্টালজিক হচ্ছি না তা নয়। সেজন্য এ লেখাকে স্মৃতিচারণাও বলা যেতে পারে। পুরনো পত্রিকার পাতা উল্টে পেয়ে যাই প্রথম লেখাটি। এই ব্র্যান্ডকে নিয়ে। তখন আমি দৈনিক জনকণ্ঠে। সেটা ১৯৯৭ সালের মার্চ। দিনটা ঠিক মনে নেই সাÿাতের। তবে ছাপা হয়েছিল ২১ মার্চ। শিরোনাম ছিল: প্রকৃত শিল্পীর প্রতিকৃতি। পাঠক এতÿণ হয়তো পুরো বিষয়টিকে হেয়ালি ভাবছেন। আসলে তা না। নামটা বলা হয়নি। ডিজাইনার আনিলা হকের সিগনেচার ব্র্যান্ড অ্যান্ডেজ। বন্ধ হয়ে গেলো। ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের ফ্যাশন থেকে অতএব হারিয়ে গেল অন্য মেজাজের একটি সৃজনচিহ্ন। কারণ? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে প্রথমদিনটির কথা না বললেই নয়। অ্যান্ডেজ তখন ২৪ শান্তিনগরে। পূর্ব নির্ঘন্ট অনুযায়ী হাজির হয়েছিলাম। কথা ছিল আধঘন্টার বেশি সময় পাওয়া যাবে না। তবে বেরিয়েছিলাম তিন ঘন্টা পর। প্রথমদিনেই কথা হয়েছিল অনেক। নানা বিষয় এসেছিল ঘুরে ফিরে। অফিসটাকে আসলে ডিজাইন স্টুডিই বলাই ভাল। এরই লাগোয়া এক চিলতে জায়গায় পোশাকের উপস্থাপন। চারাপাশের সজ্জার মধ্যে অ™ভ’দ সহজ সৌন্দর্যের প্রকাশ মুগ্ধ না করে পারিনি। বলেওছিলেন, তাঁর অšে¦ষা সহজতায় সৌন্দর্য আহরণের। এই সত্যের প্রকাশ তাঁর কাজে সবসময়েই প্রতীয়মান ছিল।
আমি গিয়েছিলাম একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের সাÿাতকার নিতে। বাংলাদেশে কাজ করছেন এমন ডিজাইনারদের তখন খুঁজে বের করে পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছি। বাংলাদেশে ঐ সময়ে ফ্যাশন পাতা বলতেই জনকণ্ঠ। আর কোন দৈনিকেরই তো ছিল না। যাহোক, তিনি নিজেকে প্রথমেই ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে মেনে নিতে চাইলেন না। বললেন, আমি ফ্যাশন ডিজাইনার নই। গ্রাফিক ডিজাইনার। ফ্যাশন ডিজাইনিং স্রেফ প্যাশন। ষোল আনা সৃষ্টির একটা অংশ মাত্র। নিজেই বলেছিলেন, ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়তে যাই। পড়িও কিছুদিন। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলে গ্রাফিক ডিজাইনে চলে আসি। যেখানে কমার্শিয়াল আর্ট, ফাইন আর্ট, ফটোগ্রাফিসহ নানা বিষয়েই পড়তে হয়েছে। শিখতে হয়েছে। মোকাবিলা করতে হয়েছে নানামাত্রিক চ্যালেঞ্জ।
সেসব স্মৃতিকে আরো একবার সজীব করছিলেন তিনি স¤প্রতি। নিজের সাজিয়ে তোলা স্বপ্নকে পুনরায় বাক্সবন্দী করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে সব গুছানোয় ব্য¯Í। তেমনই একদিন হাজির হয়ে যাই আনিলার জে এন টাওয়ারের অফিসে। বাইরে তাঁর সৃজনশোভিত অ্যান্ডেজের প্রকাশ। ক’দিন পরেই যেটা আর থাকবে না। অন্য কোন নকশা সেখানে প্রকাশ করবে তার পরিচয়। চারপাশে ডাঁই করা জিনিষ। আউটলেটে বি¯Íর আনাগোনা ক্রেতাদের। দীর্ঘদিন আনিলার সঙ্গে কাজ করা কর্মীরা তখনও ব্য¯Í তাঁর জন্যে কিছু কাজ শেষবারের মতো করে দিতে। শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গে থাকা বকুল আর রেহানার বিরস মুখ।
এরই মাঝে জায়গা করে নিয়ে বসে কথা হলো। টানা চারঘন্টা। পুরনো অনেককথাই নতুন করে শোনা হোল। জানা হালো নতুন। এমনকি ভবিষ্যত পরিকল্পনাও।
বর্তমানে যেখানে অফিস সেটায় এসেছিলেন নতুন শতকে। তবে শান্তিনগর থেকে সোজা এখানে নয়। এর আগে পাশেরই রা¯Íার একটি ছোট্ট বাড়িতে ছিল অ্যান্ডেজ। অল্প কিছুদিন। এখানে আসার পর আরো দুটো আউটলেট খুলেছিলেন। একটি হোটেল র্যাডিসনে। নীচতলায়। যেটা এখন একটি ব্যাঙ্ক। আর একটি থানমন্ডির আনাম-র্যাঙ্গস প্লাজায়। র্যাডিসনেরটা বন্ধ হয়ে যায় আগেই। বি¯Íারের ইচ্ছা তাঁর কখনোই ছিল না। বরং নিরন্তর নিরীÿায় নতুন আর নান্দনিক কিছু উপহার দিতে চেয়েছেন আনিলা সব সময়েই। ফলে দেশীয় ফ্যাশনে অনেক নতুনই তাঁর সংযোজন। হালের যে লং কামিজ নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে তা আরো তিন থেকে চার বছর আগে ইন্ট্রোডিউস করে অ্যান্ডেজ।
নিজের জীবনকে একটা ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করেন আনিলা। এমনকি নিজের কাজকেও। তারই প্রকাশ ঘটে পেশাদার কাজ কিংবা সৃষ্টিতে। দেশে ফিরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সি করার মাঝে একটি আর্ট একজিবিশন করেন। ট্র্র্যাভেল জার্নাল। শিল্পকলা একাডেমিকে। ১৯৯৪ সালে। আর কাপড়ের ক্যানভাসে তার সবই তো তাঁর কাব্যসফর। পোয়েটিক জার্নাল। যেখানে অলঙ্করণের মোটিফ হয়েছে বিশেষত কবিতা। ক্যালিগ্রাফি, টাউপোগ্রাফি আর নানা কিছুর গ্রাফিক্যাল প্রেজেন্টেশনই তাঁর সিগনেচার। জীবনানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এমনি চৈনিক, ফরাসী, আরবী কবিরাও। দেশে ফিরে ফ্যাশন ডিজাইনেরর সঙ্গে নিজেকে ক্রমে জড়িয়ে ফেলার গল্পটাও ফ্যাসিনেটিং। নিজের পোশাক নিজেই তৈরি করতেন। তা দেখে সহকর্মীদের ভালোলাগা। তাদের জন্য বানিয়ে দেয়ার বায়না থেকে একটা দুটো করে তৈরি করে অফিসের মধ্যে একটা কোণায় সাজিয়ে রাখার পরামর্শ। তারা যাতে কিনতে পারে। এভাবেই জন্ম অ্যান্ডেজের ফ্যাশন লাইনের। কারণ মূল অ্যান্ডেজের শুরু গ্রাফিক ডিজাইনিংসহ নানা প্রিন্টিং সলিউশনের জন্য। তখন বাংলাদেশে গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়টিই ছিল নতুন। ইউনিসেফ ঢাকার তখনকার প্রধান শারদ চোপড়ার দেয়া এই নাম। আলোচনা প্রসঙ্গেই এসেছিল। আনিলা’জ ডিজাইন থেকে এসেছে নামটি। তাঁর পরামর্শ ছিল আনিলা থেকে অ্যান আর ডিজাইন থেকে ডেজ। ব্যস। অঙ্কুরোদ্গম নবীন উদ্যোগের।
শিÿাজীবন থেকে শুরু করে নিজের সম্পূর্ণ নির্মাণপর্বে পাশে পেয়েছেন অনেক বন্ধু, বরিষ্ঠব্যক্তিত্বকে। এমনকি নিজের শিÿকদের কথা আজো স্মরণ করেন। যোগাযোগ রয়েছে অনেকের সঙ্গে। দেশে ফিরে কাজ করেছেন ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ইউনিসেফ, নোবেল লরিয়েট ড. মুহম্মদ ইউনুসের সঙ্গে। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ভবনে নোবেল পুরস্কার প্রদর্শনীর জন্য প্রদর্শকÿের কনসেপ্ট ডিজাইনও তাঁর। ইউনিসেফ বাংলাদেশ, আফগানি¯Íান, কোপেনহেগেন, আর তুর্কমেনি¯Íানের জন্যও কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে এখনও চুক্তি রয়েছে। তবে সেটা বাতিল করেছেন। কারণ কেবল ফ্যাশন হাউজ নয় পুরো অ্যান্ডেজই আপাতত বন্ধ করে দিলেন তিনি। এতে অবাক তারাও।
ফ্যাশন নিয়ে তাঁর ভ্রমণটা আসলেই চমকপ্রদ। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয়ই উপজীব্য হয়েছে তাঁর ডিজাইনের। আফ্রিকা, আরব, ইউরোপ কিংবা দূরপ্রাচ্য। প্রচুর ভ্রমণাভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ভান্ডারই তাঁর ডিজাইনের প্রেরণা হয়েছে। সেসব ডিজাইনও যে অনুসৃত হয়েছে অনেকের কাজে তা আর বলার অপেÿা রাখে না।
খাদিকে বিয়ের পোশাকে ব্যবহারের সাহস দেখিয়েছেন আনিলা। দিলøীর ব্রাইডাল এশিয়ায় তাঁর কালেকশন বোদ্ধাদের প্রশংসা পেয়েছে। দিলøী ছাড়াও মুম্বাই, কলম্বো, কাঠমাডু আর করাচীতে ফ্যাশন শো করেছেন তিনি। দেশেও করেছেন একাধিকবার। লাল, কালো আর সাদার সঙ্গে মিতালী আনিলার। কাজ তবুও ভুবন ভরিয়েছেন আরো অনেক রঙে। করতে পেরেছেন সঠিক কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং। ফলে অ্যান্ডেজ হয়ে উঠেছে অনন্য।
বেশ কয়েকমাস আগেই শোনা গিয়েছিল অ্যান্ডেজের হাতবদলের। তবে সিদ্ধান্ত বদলেছেন। হাতবদল নয়; রেখে দিচ্ছেন নিজের কাছেই। দরজা বন্ধ থাকছে আপাতত। পশ্চিমের মতো আমাদের দেশে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ঐতিহ্য নেই। তাই হঠাৎ করেই থেমে যায়। যেমন হচ্ছে এÿেত্রে। আপাতত ক্যারিয়ার নয়, ভাবছেন ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। এটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। বছরের বেশ অনেকটা থাকছে হচ্ছে অন্যদেশে। জার্মানিই ক্রমে তাঁর হোম হয়ে উঠছে। ২০১০-এ জার্মান ইঞ্জিনিয়ার মিখায়েলকে বিয়ের পর মিউনিখই তাঁর ঠিকানা।
অবশ্য সৃজনের নেশাটা তার বহমানই থাকবে। তৈরি হবেন একজিবিশনের জন্য। ট্র্যাভেল জার্নাল টু। কবে তা এ মুহুর্তে স্থির নয়। ফ্যাশন ডিজাইনিংকে তাবলে ছুটি দিচ্ছেন না আনিলা। কাজ করবেন। সময় সুযোগ পেলে কোন ফ্যাশন শোতে অংশ নিবেন। কিন্তু রিটেইল আউটলেট নয় আর। সেটা অকপটে স্বীকার করেছেন। বিদেশে বসে বাংলাদেশকে প্রোমোট করতে চান। তুলে ধরতে চান সুন্দর দেশটির ইতিবাচক ভাবমূর্তি। তার সৃষ্টিই হবে বার্তা পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন, মনিরুল ইসলামরা ভিনদেশে থেকেও দেশের। আনিলাও তাই থাকতে চান। ছবি আঁকা, ছবি তোলা, ফ্যাশন ডিজাইন সবকিছু নিয়েই মেতে থাকবেন। আগে নিজের ঘর সামলে। নতুন জীবনকে ষোলআনা উপভোগ করে।
এদিকে বাংলাদেশের ফ্যাশর ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যান্ডেজ থেকে যাবে অমোছনীয় স্মৃতি হয়ে। অ্যান্ডেজ-শূন্যতা, আনিলা স্বীকার করতে না চাইলেও, ভাবাবেই তার অনুরাগীদের। ইন্ডাস্ট্রিতেও থাকবে অভাবের সেই বোধ।
লেখক, নির্বাহী সম্পাদক, ক্যানভাস
ছবি: ক্যানভাস-এর সৌজন্যে