রায় পড়ার সময়ও ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় সাকা’র ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ!
সকাল ১০টা ৪৩ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল রায় পড়ার শুরু করার ঘণ্টাখানেক পরেই আদালতকে তা পড়া বন্ধ করতে বলেন এই বিএনপি নেতা।
বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন, “এগুলো পড়ার দরকার নাই, এগুলো তো গত দুই দিন ধরে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।”
এ সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য বিচারক রায় পড়া বন্ধ রাখেন। মিনিট খানেক পর আবার রায় পড়া শুরু করেন তিনি।
এর আগে হাসতে হাসতে নিচু কণ্ঠে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “যেটা পড়া হয়নি সেটা পড়েন, পড়ে চলেন বাড়ি যাই।”
ট্রাইব্যুনালে সারাক্ষণই কখা বলতে দেখা যায় তাকে। কখনো জোরে, কখনো নিচু কণ্ঠে।
ফাঁসির সেলে মুছে গেছে সাকার সেই হাসি
গাজীপুর করেসপন্ডেন্ট, বাংলামেইল২৪ডটকম
কাশিমপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এ বন্দি বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে সাধারণ কয়েদীর পোশাকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে তার ডিভিশন সুবিধা।
২ অক্টোবর কনডেম সেলে একাই দিন কাটিয়েছেন সাকা চৌধুরী। তবে তার স্বভাবসুলভ সেই হাসি ঠোঁট থেকে মুছে গেছে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা। জানা যায়, তবে খাবার গ্রহণ করেছেন স্বাভাবিকভাবেই।
১ অক্টোবর মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার পর তার ভিআইপি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। ওইদিন রাতেই তাকে কয়েদীর পোশাকে কনডেম (ত্রিশ) সেলে পাঠানো হয়।
জানা যায়, সাকা চৌধুরীকে রায় ঘোষণার পর রাতেই পর্যাপ্ত পুলিশ প্রহরায় প্রিজনভ্যানে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে আসা হয়।
ফাঁসির রায়ের আগে সাকা ওই কারাগারের চিত্রা ভবনে ভিআইপি মর্যাদায় ছিলেন। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর সাকা চৌধুরীকে এ কারাগারে পাঠানো হয়।
ঋতু পরিবর্তন হয়েছে বন্ধুরা টের পাচ্ছেন না?
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাকা চৌধুরী রায় শুরুর আগে সাকা চৌধুরীকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন তিনি হাসিমুখে ছিলেন। বেঞ্চ বসার পর রায় ঘোষণা শুরু হলে কিছুক্ষণ পরপর তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন। এসময় তিনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের রায় সহি হাদিস।’
সেই সেঙ্গে তিনি রায় লিখে দেয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান তিনি। রায় ঘোষণার পর তিনি বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ। আমার বিরুদ্ধে রায় লিখে দেয়ার জন্য।’
প্রথম অভিযোগ পড়ে শেষ করার পর তিনি বলেন, ‘এটা প্রমাণিত। দুইদিন ধরে রায়ের কপি অনলাইনে প্রকাশ পেয়েছে। এ রায় পড়া দরকার কি। রায় তো ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার পক্ষে রায় দিয়েছে। আমি ছয়বারের এমপি। সেই আমি ট্রাইব্যুনালের কি রায় শুনবো!’
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে রায় ঘোষণার আগে এজলাসে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে এই দম্ভোক্তিমূলক কথাগুলো বলেন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
১৭ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বিচারপতিদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘ঋতু পরিবর্তন হয়েছে বন্ধুরা টের পাচ্ছে না?’
তিনি বলেন, ‘আমি নাকি সাক্ষী আনতে ফেল করেছি। আমি ১২ জন সাক্ষীর তালিকা দিয়েছি। তার মধ্যে একজন সিটিং জজও ছিল।’
২৩ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বলেন, ‘ছি ছি প্রসিকিউশন ফেল করেছে। এই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।’
রায় বেলজিয়াম থেকে লিখে আনা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি নাকি ধানের কল চুরি করেছি। আমি তখন কী রকম গরিব ছিলাম?’
তিনি বলেন, ‘সাঈদী সাহেবের মতো লোককে ফাঁসি দিয়েছেন আর আমি তো গোনাগার। ফাঁসি দিয়ে দেও, ফাঁসি দিয়ে দেও।’
মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে ১৭২ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
এর আগে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে এজলাসে হাজির করা হয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে।
সাকা’র মতোই সাকাপুত্র, ‘তামশা দ্যাখতে আইছি’!
“আমার বাবারেত ‘সাকা’ বানাইছেন, আমারে আবার হুকা বানাইয়েন না।”
তীর্যক, তাচ্ছিল্যপূর্ণ বেপড়োয়া, আপত্তিকর কথাবার্তায় সাকা সকলকে ছাড়িয়ে- সবাই জানে সে কথা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সাকাপুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরীও কম যান না।
সাকার মামলার রায় শুনতে এসে তার ছোট ছেলে হুম্মামের কন্ঠে সে সুরই শোনা গেলো! সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ত্যাড়াভাবে বলেন, রায় শুনতে নয়, ট্রাইব্যুনালে এসেছি ‘তামাশা’ দেখতে।
এই রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনালের বাইরে হুম্মান সাংবাদিকদের বলেন, “রায় গতকালই পইড়া ফালাইছি। আজ তামশা দ্যাখতে আইছি।”
রায় আগে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকার এই পুত্র বলেন, “জাস্টিস কনসার্ন ডট অর্গ নামের একটা ওয়েবসাইটে।”
বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে হুম্মাম পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আইজ পর্যন্ত দ্যাখছেন মুখ বন্ধ কইরা থাকতে?”
রায় দেখতে কে কে এসেছেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ফুল গুষ্টিসুদ্ধা চইলা আইছি”।
সালাউদ্দিন কাদেরের বড় ছেলে ফজলুল কাদের চৌধুরী ও মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরীও এ সময় তার পাশে ছিলেন।
এক পর্যায়ে হুম্মাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমার বাবারেত ‘সাকা’ বানাইছেন, আমারে আবার হুকা বানাইয়েন না।”
আদালতে স্ত্রীর ধমক!
আদালতেও বদলায়নি সাকা’র স্বভাব। এমনকি চূড়ান্ত রায় ঘোষণার সময় পর্যন্ত নানা তীর্যক মন্তব্য করেই যাচ্ছিলেন এই বিএনপি নেতা।
রায়ের নানা প্রসঙ্গে পাল্টা কথা বলে আসছিলেন তিনি। ব্যঙ্গও করছিলেন মাঝে মাঝে।
রায়ের এক পর্যায়ে তিনি বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমার বোনকে বিয়ে করার কথা ছিলো, সেটা বল না?’
এ সময় এই দাপুটে বিএনপি নেতাকে ধমক দেন স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী।
স্বামীকে ধমক দিয়ে তিনি বলেন, ‘হেই, কী বলছো তুমি এ সব?’
বিচারক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানোর সময় সাকা বলতে থাকেন, ‘বল বল কীভাবে কি করছি……বল….তোর বোনকে কি করছি বল….
‘……হু ধানের কল চুরি করছি, ঘরে ঢুকছি, তারপর কি করছি বল…….’
‘………লাল মিয়া, সোনা মিয়া…বল….পাঁচ কেটে ছয় করার দরকার কি…মিয়া তো ঠিকই আছে……’
আদালতে করা সাকার অন্য অধিকাংশ মন্তব্যে তার স্ত্রী-স্বজনদের অন্যদের কাছে হাসির খোরাক যুগিয়েছে। একই সাথে তাদের দারুণ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য সাকা আরো বেশ কিছু অশ্লীল মন্তব্য করেন। সে সময় প্রতিক্রিয়াহীন দেখা যায় তার স্ত্রী-সন্তানদের।
থাকছে এমপি পদ
মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ড পেলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সংসদ সদস্যপদ সহসায় বাতিল হচ্ছে না। এজন্য আপিল বিভাগের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ সাংবাদিকের জানিয়েছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কারও সংসদ সদস্যপদ থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু এ জন্য আপিল বিভাগের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আবু হাফিজ আরো বলেন, আপিল বিভাগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় বহাল থাকলে তার সংসদ সদস্যপদ থাকবে না। এই হিসাবে নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ থাকতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সদস্যপদ হারাবেন কি না, তা নিশ্চিত না। কারণ বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি।
-সময়ের কথা ডেস্ক