যে দুল চুরি করার কারণে আদুরীর ওপর চরম নির্যাতন নেমে এসেছিল। অবশেষে সেই দুল পরেছে আদুরী। শুধু দুলই নয়, গলায় মালা ঝুলছে তার। হাতে ব্যান্ডেজ থাকার কারণে আপাতত হাতের চুরি পরতে পারেনি। এখন সে হাসে। তার চেহারায় নেই আর ভয়ের ছাপ। এমনই তথ্য জানিয়েছেন ওসিসির সংশ্লিষ্টরা। এদিকে আদালতে গৃহকত্রী নদীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) এখন আদুরী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। মাথার হাড়ে আঘাত থাকায় তার মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়েছে। মাথা ও হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সে পরেছিল গোলাপি প্রিন্টের একটি জামা। এর মধ্যেই কানে দুল। গলায় একটি মালা। লিকলিকে শরীর। তারপরও সে নির্যাতনের ছাপ এতোটাই প্রকট যে, এখনও আদুরীকে দেখলে আঁতকে উঠতে হয়।
১ অক্টোবর সকালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি ওসিসিতে দেখতে যান আদুরীকে। তিনি আদুরীর জন্য জামা, কানের দুল, গলার মালা ও বিভিন্ন ফল নিয়ে যান। কিন্তু আদুরীর কাছে গিয়েই প্রতিমন্ত্রী আঁতকে ওঠেন। তিনি আদুরীকে দেখেই বলেন, ‘ওহ, এ অবস্থা কেমন করে হতে পারে!’ প্রতিমন্ত্রী আদুরীর কাছে নাম জানতে চাইলে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে আদুরী।
ওসিসি থেকে বের হয়ে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আদুরীর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের আওতায় নিয়ে বিচার করা প্রয়োজন। সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয়ে মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেছে। আদুরীর কথা আরেকটু স্পষ্ট হলে আসল পরিস্থিতি জানা যাবে। এ মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অন্যরাও গৃহকর্মী শিশুদের নির্যাতন করতে ভয় পাবে বলে তিনি জানান।
ওসিসির কো-অর্ডিনেটর ডা. বিলকিস বেগম আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, আদুরীর অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। সে এখন চলাফেরা করতে পারে। নিজ হাতে খেতে পারে। বুধবার আদুরীকে আরেক ব্যাগ রক্ত দেয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মেরিন সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, মামলার আসামি নওরীন জাহান ওরফে নদীর রিমান্ড শেষে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার জন্য আদালতে পাঠানো হয়। এখন তদন্ত বিভাগ থেকে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন পাঠানো হবে। মেরিন সুলতানা বলেন, নদী আদুরীকে নির্যাতন করার কথা স্বীকার করেছেন এবং তার ভুল বুঝতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে নদী নিজে আদুরিকে ডাস্টবিনে ফেলে আসেননি বলে জানিয়েছেন। কথা শুনত না, এক কথা বারবার বলতে হতো, কাজে মনোযোগ দিত না ইত্যাদি কারণেই তিনি আদুরীকে নির্যাতন করতেন বলে জানিয়েছেন।
জানা যায়, শিশু আদুরীকে নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপপরিদর্শক এনামুল হক খন্দকার আসামিকে তিন দিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে তার এ স্বীকারোক্তি রেকর্ড করেন। আসামি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিতে চাইলে আদালত তার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার আবেদন মঞ্জুর করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ এরফান উল্লাহ আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
পিশাচিনির অকপট স্বীকারোক্তি!
আদুরীকে (১১) গরম খুন্তি ও গরম ইস্ত্রি দিয়ে নির্যাতন করার কথা আদালতে স্বীকার করেছেন গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী (২৫)।
১ সেপ্টেম্বর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ এরফানউল্লাহর কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার সময় গৃহকর্ত্রী নদী এই অমানবিক অপরাধের কথা স্বীকার করেন।
৩ দিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার নদীকে ঢাকা সিএমএম আদালতে হাজির করে জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের এসআই কুইন আক্তার।
জবানবন্দি গ্রহণ করে ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
জবানবন্দিতে নদী আদুরীকে নির্যাতনের কথা স্বীকার করলেও তাকে ডাস্টবিনে ফেলে আসার কথা অস্বীকার করেছেন বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
স্বীকারোক্তিতে নদী বলেন, তিনি খুব বদরাগী। তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তিনি প্রায় দু’বছর যাবত আলাদা থাকছেন। ওই সময় তিনি আদুরীকে নিয়ে যান।
নদী জানান, কখনও তিনি গরম খুন্তি দিয়ে, কখনও গরম ইস্ত্রি দিয়ে আদুরীকে ছ্যাঁকা দিতেন। কোনো কোনো সময় উত্তেজিত হয়ে তিনি নিজেই নিজের শরীর ব্লেড দিয়ে কাটতেন। আবার আদুরীর শরীরও ব্লেড দিয়ে কাটতেন।
নদীকে তার বাসা থেকে আটক করে পল্লবী থানা পুলিশের একটি দল। এরপর ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হলে তার বিরুদ্ধে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
উল্লেখ্য, বারিধারা ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন একটি ডাস্টবিনের পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় গৃহকর্মী আদুরীকে উদ্ধার করা হয়। এরপর তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক ) হাসপাতালে।
এ ঘটনায় পল্লবী থানায় নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিসহ চারজনকে আসামি করে মামলা করা হয়।
গ্রন্থণা : নূরুল আলম