আবদুল আলিম : লোকসঙ্গীতের বরপুত্র

আবদুল আলিম : লোকসঙ্গীতের বরপুত্র

সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাংলাদেশ। দুধের সরের মতো উর্বর পলি মাটি দিয়ে গড়া এক শ্যামল ভূখণ্ড। এদেশের হাওযায় হাওয়ায় সুর, বনে বনে উল্লাস, যমুনার পাড়ে পাড়ে বিরহ-বিলাপ। এর পাহাড়ের মানুষ মহুয়ার রঙিন আবেগে, মাদলের তালে তালে যেভাবে আনন্দ করে, উত্তরবঙ্গের গাড়িয়াল ভাইয়ের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তদ্রƒপ মাঝির গানের সুরেও আছে অপরূপ বৈচিত্র্য। আউল-বাউল-পীর-মুর্শিদের আখড়ার-মাজারের আনন্দলহরী, হৃদয় তোলপাড় করে যেভাবে আহ্বান করেÑ তার তুলনা কোথায়?

বাংলার লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ ধারায় যাঁরা আত্মনিয়োগ করে লোকসঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁদের ঋণ কোনোদিনও বাংলার মানুষ শোধ করতে পারবে না। বাংলার লোকসঙ্গীত শুধু যে নিরক্ষর গ্রামীণ মানুষের মনোরঞ্জন করেছে তা-ই নয়, আধুনিক রুচিসম্মত মানুষের মনেও লোকসঙ্গীতের সুর দোলা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কাজী নজরুল ইসলামসহ আরো অনেককেই লোকসঙ্গীতের অপার্থিব সুর আকর্ষণ করেছিল। কেননা এঁদের অনেক গানেই এঁরা লোকসঙ্গীতের সুর ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে লোকসঙ্গীতের সুর সংযোজন করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকসঙ্গীতকে অপূর্ব মর্যাদায় উন্নীত করেন।

বাংলা লোকসঙ্গীতের গায়ক হিসেবে যাঁরা গণমানুষের শ্রদ্ধার আসন অলংকৃত করেছেন আবদুল আলিম (১৯৩১-১৯৭৪) তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আবদুল আলিম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই ভারতের মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে আবদুল আলিম ছিলেন নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তান। মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লেখাপড়া করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশি দূর অগ্রসর হতে না পারলেও সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ বাল্যকাল থেকেই পরিলক্ষিত হয়।

আবদুল আলিমের আর্থিক সঙ্গতি ছিল না বলে গানের শিক্ষক রেখে তিনি গান শিখতে পারেননি। অন্যের গাওয়া গান শুনে শুনে তিনি গান শিখেন। আবদুল আলিমের জীবনের বাঁক বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। সৈয়দ বদরুদ্দোজা ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র এবং মুর্শিদাবাদের অধিবাসী। আবদুল আলিমের কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। তিনি আবদুল আলিমকে স্নেহের বন্ধনে  জড়িয়ে তালিবপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। কলকাতায় এসে আবদুল আলিম সৈয়দ গোলাম ওলির কাছে সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন। একবার কলকাতার আলীয়া মাদরাসার মুসলিম হলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে গান শোনানোর সৌভাগ্য লাভ করেন তিনি। শেরে বাংলা আবদুল আলিমের গান শুনে তরুণ আবদুল আলিমকে আশীর্বাদ করেন।

আবদুল আলিম বিখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীনেরও স্নেহধন্য ছিলেন। আবদুল আলিম ও আব্বাসউদ্দীনের জীবনচিত্র তুলনা করলে অনেক বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। আবার দুজনের জীবনে বেশ কিছু মিলও আছে। আব্বাসউদ্দীন ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর কুচবিহারের তুফানগঞ্জের বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জোতদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। বি.এ. পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন কিন্তু বি.এ. পাশ করতে পারেননি। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে আবদুল আলিমের মতো আব্বাসউদ্দীনও বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সঙ্গীত¯্রষ্টা। তাঁর সান্নিধ্য যাঁরা পেয়েছেন তাঁরাই সঙ্গীতজগতে অমরত্ব লাভ করেছেন। আবদুল আলিমও কাজী নজরুলের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছিলেন। আবদুল আলিম যখন চৌদ্দ বছরের কিশোর তখনই তাঁর গানের গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়। সে সময়ে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

আবদুল আলিম বিখ্যাত দোতারা বাদক কানাইলাল শীলের (১৮৯৫-১৯৭৪) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কানাইলাল শীল ছিলেন ফরিদপুরের সন্তান। কানাইলালের সঙ্গে কিভাবে আবদুল আলিমের পরিচয় হয় তার প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ফরিদপুরের অম্বিকাপুরের এক অনুষ্ঠানে কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে কানাইলাল শীলের পরিচয় হয়। কানাইলাল শীলের দোতারা শুনে কবি মুগ্ধ হন এবং তাকে কলকাতা নিয়ে যান। এখানে তিনি আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। এমনকি নজরুল ইসলামের সঙ্গেও তিনি দোতারা সঙ্গত করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। আব্বাস উদ্দীনের অকৃপণ সহযোগিতায় কানাইলাল শীল গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদান করেন। কলকাতা থাকতেই আবদুল আলিম ও কানাইলাল শীলের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের এই আন্তরিক সম্পর্ক মৃত্যু পর্যন্ত দৃঢ় ছিল। কানাইলাল শীল এবং আবদুল আলিম দুজনেই ঢাকায় ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কানাইলাল শীল প্রয়াত হন জুলাই মাসে, আবদুল আলিম দেহত্যাগ করেন সেপ্টেম্বর মাসে।

১৯৪৭ সাল শুধু ভারতবর্ষকেই দ্বিখণ্ডিত করেনি, শিল্পী-সাহিত্যিকদেরকেও দ্বিখণ্ডিত করে। মুসলমান শিল্পী সাহিত্যিকগণ পাকিস্তানে চলে যান, হিন্দু শিল্পী-সাহিত্যিকগণ পাড়ি জমান ভারতে। এই পরিস্থিতিতে আবদুল আলিম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে চলে আসেন। আবদুল আলিম ঢাকা আসেন ১৯৪৮ সালের দিকে। ঢাকা এসে তিনি পুরোদমে সঙ্গীতে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে সেসময়ে তিনি নিয়মিত পল্লীগীতি পরিবেশন করে কোটি কোটি শ্রোতার মন জয় করেন। ধীরে ধীরে তিনি লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ‘সব সখীরে পার করিতে’, ‘নাইয়ারে নাওয়ের বাদাম তুইলা’, ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’, ‘আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালু’ তাঁর বিখ্যাত গান।

ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আবদুল আলিম কণ্ঠ দিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন আবদুল জব্বার খান। ৯৯ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটির নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ৬৪ হাজার রুপি এবং আয় করে ৪৮ হাজার রুপি। সুরকার সমর দাস এই ছবির গানে সুর দেন। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দেন আবদুল আলিম ও মাহবুবা হাসনাত। সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ধীর আলী। ১৯৫৩ সালে ‘মুখ ও মুখোশে’র নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ছবিটির মহরত অনুষ্ঠান হয় ১৯৫৪ সালে। মহরত অনুষ্ঠানে তৎকালীন গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা উপস্থিত ছিলেন।

চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে আবদুল আলিম প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ‘এদেশ তোমার আমার’, ‘জোয়ার এলো’, ‘সুতরাং’, ‘পরশমনি’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘বেদের মেয়ে’,  ‘রূপবান’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী,’ ‘আপন দুলাল’, ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘লালন ফকির’, ‘সুজন সখী’, ‘নিমাই সন্ন্যাসী’, ‘দয়াল মুর্শিদ’, তীর ভাঙা ঢেউ’।

বাংলা লোকসঙ্গীতকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে যে-কজন মহান মানুষ চিরদিনই আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আবদুল আলিম তাঁদের একজন। মানুষ হিসেবে আবদুল আলিম সাদামনের মানুষই ছিলেন। বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনোই কম ছিল না। এত কিছুর পরেও দুটি বিশেষ ঘটনার কারণে এদেশের মানুষের অন্তরে আবদুল আলিম একটু অন্যভাবেই চিহ্নিত হয়ে আছেন।

পাকিস্তানি সরকার মনে করেছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থী। তাই সে সময়ের পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। আবদুল আলিম সরকারি এই সিদ্ধান্তের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দেন, ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৬৭ সারের ২২ জুন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল আলিম পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার দাবিতে বিবৃতি প্রদান করেন। তাঁর মতো একজন মানুষের পক্ষে কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর আজ আর পাওয়া যাবে না। দোষ-ত্রুটি নিয়েই মানুষের জীবন। একজন শিল্পীও দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। আবদুল আলিমের একটি-দুটি ত্রুটি থাকা স্বত্ত্বেও তাঁকে বাংলার মানুষ হাসিমুখে অন্তরে স্থান দিয়েছে। তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বটে, কিন্তু মানুষের ভালোবাসার যে পুরস্কার তিনি পেয়েছেন তার কোনো তুলনা নেই।

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.