ওখানে কেউ নেই

ওখানে কেউ নেই

দীর্ঘদিন হয়ে গেছে কবিতা দের বাড়ি যাওয়া হয়নি , শেষ কবে গিয়েছিলাম মনে নেই , মনে হয় শেষবার এসেছিলাম ওর বিয়ের সময় । তারপর আর আসা হয়নি । লেখাপড়ার পাঠ না চুঁকতেই ওর মামা ওর বিয়ে দিয়ে দেয় , বাপ মা মরা মেয়ে কবিতা ।


বাবা মা না থাকলে মনে হয় নিজের বলতে কিছুই থাকে না , না চাওয়া পাওয়া না নিজের ইচ্ছে ।
এসব ভাবতে ভাবতেই আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেলাম , আমার সাথে সোনিয়া আর রাতুল যাচ্ছে, আমাদের দেখা প্রায় আট থেকে দশ বছর পর । সেই স্কুল জীবন একসাথে শেষ করে আমি বিদেশে পাড়ি দিলাম উচ্চশিক্ষার জন্য,
তখন সবার সাথে কথা হলেও কবিতার সাথে কথা হতো না, শুনেছি ওর বরটা একটু অন্যরকম, সবসময় ওকে অনেক শাসনের মধ্যে রাখতো , রাতুলের কাছে শুনেছিলাম একবার ওর একটা ফুটফুটে ছেলে বাবু হয়েছে , তবে যাই হোক স্বামী ছেলে নিয়ে সে সুখেই আছে ।
স্টেশনে পা রাখার সাথে সাথেই  আকাশে এক টুকরো ঘন কালো মেঘের ভেলা দেখে মনটা বিচলিত হয়ে উঠলো। সোনিয়া আর রাতুল কে বলে উঠলাম, নাহ আর দেরি করা চলবে না। তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে। আকাশের অবস্থা ভালো নয় দেখছি।
ওরা দুজনে আমার কথায় সায় দিয়ে “হ্যাঁ” বলে উঠলো ।
স্টেশনের ভিতরে যেতে যেতেই কানে ভেঁসে উঠলো, আজকে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে ।
মেজাজ পুরোই খারাপ হয় গেলো আমাদের, আমরা এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম সবাই ছুঁটছে নিজেদের মতো করে ,
এদিকে একটা গাড়ি, অথবা রিক্সা কিছুই  দেখতে পাচ্ছি না।
কত বছর পর যাচ্ছি কিন্তু পথেই এমন বাঁধা ।
হঠাৎ করেই মনে হলো পাশেই আমার একটা ফুপুর বাড়ি ,বহুবছর আগে গিয়েছিলাম ফুপুর বাড়ি। শেষ বার ফুপার মৃত্যুর সময় গিয়েছিলাম দাদীর সাথে ।
তবে এ পথে এলাম অনেক বছর হয়ে গেলো । কিন্তু এই চত্বরটা তো এখনও একরকমই দেখছি। কিছুই পরিবর্তন হয়নি।
এতোটা পথ, হেঁটে যেতে যেতে মাঝপথে  আকাশ ভেঙে পড়লেই গেলো। স্টেশনে থাকা টাও নিরাপদ না তাই আমরা আর কিছু না ভেবে হাঁটা শুরু করে দিলাম , এদিকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও  গাড়ির অস্তিত্ব তো দূরে থাক একটা জনমানব ও চোখে পড়ছিল না । মিনিট খানেক হাঁটার পরেই আকাশ আরো কালো করে বৃষ্টি নেমে এল।  অসময়ের বৃষ্টি ভিজলেই নির্ঘাত শরীর খারাপ হবে,  ভাবতে ভাবতেই  সামনে পথের ডান পাশে একটা দোকান দেখতে পেলাম। মনের ভিতরে বেশ একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেল এই অসময়ে, অজানা জায়গা । তার উপর আমরা তিনজন আশে পাশে আর কেউ নেই বললেই চলে
যাই হোক বাবা একটা মাথা গোঁজার আশ্রয় তো পেলাম।

এক ছুটে আমরা গিয়ে ঢুকলাম দোকানের ভিতরে। কিন্তু এদিকে বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। টিনের ফুটো চাল দিয়ে টপ, টপ, টপ, করে বৃষ্টির জল পড়ছে একটা বালতির উপর। আমরা তিনজন একমনে উপভোগ করছিলাম বালতির উপরে বৃষ্টির জল পড়ার শব্দ। হঠাৎ শুনতে পেলাম একটা অচেনা কণ্ঠস্বর,
আমরা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, পরে বুঝতে পারলাম বছর পাঁচেকের একটা ছোট ছেলে , সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর, মনে হচ্ছিলো বৃষ্টির পানি ওর শরীরে খেলা করছে ।
রাতুল ওর পাশে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো ,

” ওই বেটা , তুই এখানে কি করিস রে “

ছেলেটা খুব আস্তে করে বলে উঠলো
” এইডা আমাগো দোকান “
আমি আর সোনিয়া চুপচাপ ওদের কথা শুনছিলাম , কেমন যেন গা ছমছম করছে শীতে আবহাওয়া টা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেছে ।

” শোন খুব খিঁদে পেয়েছে আমাদের, তুই কিছু খাবার জোগাড় করে দিতে পারবি “

ঠিক তখনি দোকানের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো কে রে নিমাই নাকি ,
ছেলেটা কিছু না বলে চুপচাপ এক দৌরে চলে গেলো
দোকানের শাটার তুলে একটা লোক হাই তুলতে তুলতে বললো

” কে আপনারা ? ” এখানে কি করেন

আমি এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলাম

” কিছু মনে করবেন না আসলে আমরা সামনে যাব হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাই আপনার দোকানে এসে দাঁড়িয়েছি, “

লোকটা কিছু বললো না শুধু বললো ” চা খাবেন “

সঙ্গে সঙ্গে রাতুল বলে উঠলো আরে হেব্বি হবে তো বৃষ্টির সময় এক কাপ চা ।
আমি হাঁসলাম , সোনিয়া বৃষ্টি দেখছে আর গুনগুনিয়ে গান বলতে ব্যস্ত ।
লোকটা আমাকে চা দিতে দিতে বললো ……

“কি আফা কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

ওর প্রশ্ন শুনে বলে উঠলাম,“আরে না না অসুবিধা কি বলছেন,
বৃষ্টির সময় এই অচেনা জায়গা আর অচেনা জঙ্গলের মাঝে যে আশ্রয় পেলাম এই দুর্যোগের সময় এইটাই বিশাল বড় ব্যাপার। না হলে ভিজতে হত।
আমার উত্তর শুনে লোকটা হেসে উঠলো।
হেঁসে ওঠার কারণ বুঝতে পারলাম না আমরা কেউ

“আপনি কি একাই এখানে থাকেন?”

“হ্যাঁ”…

তবে যে একটা ছোট বাচ্চা দেখলাম সে কি আপনার ছেলে ।

” নাহ্ তো আমার কোন ছেলে নেই আমি একাই থাকি “

মনে মনে ভাবতে লাগলাম তাহলে সেই ছেলেটা কে ।

“এই জঙ্গলে একা  থাকতে ভয় লাগেনা?”

“না। অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রকৃতিই আমার সঙ্গী।  নির্জনতা আমার আত্মা। কোলাহল আমার বড় অপছন্দের।”

“বাহ্ আপনি তো বেশ কথা বলেন! ওই দেখো আপনার নামটাই জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি ….”

“নিরমল ।”

চা শেষ করে চুপচাপ বসে আছি এদিকে রাতুল গিটার হাতে টুং টাং শব্দ করেই চলছে আর সোনিয়া গুনগুনিয়ে গান বলছে ।

তবে এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই  লক্ষ্য করছি আশ্রয়দাতা মানুষটির আচরণ একটু অন্যরকম।

আমার মাথায় নানারকম প্রশ্ন ঘুরতে থাকলেও অহেতুক  প্রশ্ন করা উচিত নয় ভেবে চুপ করে আছি। 

কিন্তু সামনের মানুষটা যেন বিপরীতের মানুষটার মস্তিস্কের গতিপথ  অনুভব করতে পারে। সে  যেন এক মুহুর্তে পড়ে ফেললো আমার ভিতরের কথা। নিজের থেকেই বলে উঠলো,

” আফা কি আমাকে নিয়ে কিছু ভাবতাছেন? “

আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। কেমন যেন একটা ঘোরে আছি। হঠাৎ করে বাইরের মতনই ঘরের ভিতরের বাতাসটাও কেমন যেন ভারী হয়ে উঠেছে।

খুব কাছাকাছিই জোরে কয়েকবার বাজ পড়বার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম আবার। আবহাওয়া কে হাল্কা করতে বলে উঠলাম, “কই না তো ।”

আমার কথায় সামনের চোখ দুটো যেন চিকচিক করে উঠলো। রাত বাড়ছে। বাইরের প্রকৃতি ক্রমশ আরও অশান্ত হয়ে উঠছে। এদিকে আমরা তিনজন আর দোকানের সেই লোকটা ।
জোড়ে জোড়ে বাতাস দিচ্ছে , শীতের প্রকোপ বেড়ে চলেছে ,
এদিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে, সোনিয়া আবার খিদে সহ্য করতে পারে না, ও তো কান্না কাটি করতে করতে শেষ, বেচারি ভয় পেয়েছে নিশ্চয়ই । ওর কান্নাকাটি দেখে লোকটি খুব তারাতারি
আলুর পরোঠা, আর চা বানিয়ে দিলো তা দিয়ে আমরা রাতের খাবার শেষ করলাম। এ যেন আমাদের কাছে অকাল বর্ষণ। স্টেশনে নেমে আশ্রয় কোথায় পাবো বুঝতে পারছিলাম না, কি করবো ভাবতে পারছিলাম না সেখানে আশ্রয়ের সাথে সাথে এইরকম সুস্বাদু গরম গরম খাবার পাবো কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি।

খাবার শেষে গিটারে গান ধরলো রাতুল , “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল  করেছ দান…..আমি দিতে এসেছি  শ্রাবণের গান।….”
একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুর তুলে চলেছে।
সোনিয়ার চোখ ঘুমে আটকে যাচ্ছে বারবার ।
আমি চুপচাপ বসে আছি । মনে মনে আল্লাহ্ কে ডাকতে থাকলাম , রাত গভীর হতে লাগলো এদিকে বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই, জঙ্গল টা আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে বলে মনে হচ্ছে, কোথাও যেন কেউ নেই, চুপচাপ বসে আছি আনমনে হঠাৎ চোখের কোণে ঘুমের আভা চলে এলো , এদিকে রাতুল আর সোনিয়া কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল করিনি , দোকানের সেই লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেছে, এদিক সেদিক লোকটাকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ মনে হলো ঠিক কিছুটা দূরে দুটো চোখ চিকচিক করছে আমি ভয় পেয়ে কে কে ওখানে বলতে বলতেই একটা ছোট্ট ছেলের কন্ঠে ভেসে উঠলো ওখানে কেউ নেই আমরা তো এখানে ঠিক তখনি আমি মাথায় একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম ।
আমার চোখ ভার হয়ে আসছিলো , হঠাৎ চোখটা বন্ধ হয়ে গেলো হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল করিনি ,
চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম আমার পাশের বেডে রাতুল আর অন্য বেডে সোনিয়া শুয়ে আছে ,মনে হচ্ছে ওরা ঘুমাচ্ছে, তবে কিছুই বুঝতে পাচ্ছিলাম না ,মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে কেন জানি
হঠাৎ একটা লোক আমার দিকে এগিয়ে এসে বলতে লাগলো
এই যাত্রা খুব জোর বেঁচে গেছেন আপনারা,
জঙ্গলের শ্রমিকরা পথের ধারে আপনাদের পড়ে থাকতে দেখে প্রথমে মৃত ভাবলেও কাছে এসে যখন দেখে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চলছে তখন হাসপাতালে নিয়ে যায়।
আমি ওই দোকানের লোকটার কথা জিজ্ঞেস করতেই তারা বলে উঠে ওখানে কোন দোকান ছিলো না, না কেউ ওখানে থাকে ওটা তো পুরোটাই জঙ্গল ।
আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছিলাম না শুধু মনে হচ্ছিলো

“তবে কি সত্যি কেউ ছিলো না “।

● অর্পিতা ঐশ্বর্য কামাল কাছনা রংপুর ।।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.