কি ঘটতে যাচ্ছে সাকা’র ভাগ্যে?

কি ঘটতে যাচ্ছে সাকা’র ভাগ্যে?

Saka-chowdhury-

কি ঘটতে যাচ্ছে ফাঁকা বুলিওয়ালা সাকা চৌধুরীর ভাগ্যে? ফাঁসি, নাকি যাবজ্জীবন? নাকি রহস্যজনক কারণে আরো লঘুদন্ড? সাকা চৌধৃরীর রায়কে সামনে রেখে এমনি সব নানা প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে নানা জনের মুখে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ১৪ আগষ্ট এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হলে রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখা হয়। এর আগে দুই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি মামলার রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল-১ দুটি এবং ট্রাইব্যুনাল-২ চারটি মামলার রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল-১ সাকা’র সপ্তম মামলাটি রায়ের অপেক্ষায় রাখলেন। তবে এই প্রথম বিএনপির কোনো নেতার বিরুদ্ধে রায় অপেক্ষাধীন রাখা হলো।

যে ছয়টি রায় ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে, তার পাঁচটির আসামি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতারা, একজন সাবেক সদস্য। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ ১৪ আগষ্ট কার্যক্রম শুরু হয় আসামিপক্ষের অতিরিক্ত এক ঘণ্টা যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। আসামিপক্ষের আইনজীবী আহসানুল হক সপ্তম দিনের মতো যুক্তি উপস্থাপন করেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সুলতান মাহ্মুদ যুক্তি খণ্ডন শুরু করেন। তিনি আসামিপক্ষের সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরেন।পরে আইনগত বিষয়ে আসামিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করেন রাষ্ট্রপক্ষের আরেক কৌঁসুলি তুরিন আফরোজ। তিনি বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবী (আহসানুল হক) যত না মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে যুক্তি দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে ব্যক্তিগত দর্শন ও জ্ঞান নিয়ে কথা বলেছেন। লম্বা সময় ধরে তিনি রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের আক্রমণ করেছেন। পৃথিবীর সব লোকের সমালোচনা করেছেন, একমাত্র বারাক ওবামা ও প্রিন্স উইলিয়ামের কয়েক দিন আগে জন্ম নেওয়া ছেলেটা তাঁর সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু এসব সমালোচনা তাঁর মক্কেলকে (সাকা চৌধুরী) কতটা সাহায্য করেছে? তিনি (আহসানুল হক) বলেছেন, বিচারের সময় একজন আসামি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন; মিথ্যা বলতে পারেন, চুরি করতে পারেন, এমনকি দালিলিক নথি জাল করতে পারেন। তাঁর এ বক্তব্য যদি সত্য হয়, তবে আসামিপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া সাকা চৌধুরীর পুরো বক্তব্যই অবিশ্বাসযোগ্য।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে না—আসামিপক্ষের এ যুক্তি খণ্ডন করে রাষ্ট্রপক্ষের এ কৌঁসুলি বলেন, ‘আমাদের আইন ও ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণ দেশীয়, কিন্তু বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধের।

 

এ জন্য ট্রাইব্যুনালস আইনের অধীনে বিচার প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনের মেলবন্ধন। অবশ্যই ট্রাইব্যুনালস আইন অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু দেশীয় আইনে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আইন থেকে পূরণ করা যাবে।’ ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইন প্রয়োগের বিষয়ে কৌঁসুলি বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালে একটি খুন বা ধর্ষণের বিচার হচ্ছে না। মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিস্তৃত পরিসরে সংঘটিত নৃশংসতা, গণহত্যার বিচার হচ্ছে। এ জন্য এখানে প্রথাগত আইন বাইরে রেখে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে বিচার করা হচ্ছে। দুনিয়ার কোথাও কি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে প্রথাগত আইন ব্যবহার করা হয়?’

 

যুক্তি খণ্ডনের পরবর্তী পর্যায়ে তুরিন আফরোজ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আসামিপক্ষের উত্থাপিত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, মাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেও কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়, শুধু দেখতে হবে একমাত্র সাক্ষীর বক্তব্য প্রাসঙ্গিক ও বিশ্বাসযোগ্য কি না। এটা সম্পূর্ণই ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। ট্রাইব্যুনাল-২-এর তিনটি রায়ে একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে দোষী সাব্যস্ত করার নজির আছে। শোনা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেও দোষী সাব্যস্ত করার নজির ট্রাইব্যুনালের রায়েই আছে।

 

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের অসংগতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের এই কৌঁসুলি বলেন, ‘মৌখিক সাক্ষ্যে ছোটখাটো অসংগতি থাকা খুবই স্বাভাবিক। অনেক সাক্ষী নিজেরাই ঘটনার শিকার, তিনি হাজার হাজার লাশ দেখেছেন। তাঁর পক্ষে কী বলা সম্ভব কোন লাশের পা কাটা ছিল আর কোনটির আঙুল কাটা, সেটাও আবার ৪০ বছর পর? অসংগতি থাকাটাই স্বাভাবিক বরং এটা অনেক বেশি অস্বাভাবিক হতো, যদি সাক্ষ্য সম্পূর্ণ অসংগতিবিহীন হতো। তখন এটাই ভাবা স্বাভাবিক ছিল যে এসব সাক্ষ্য বানানো হয়েছে।

 

যুক্তি খণ্ডনের শেষ পর্যায়ে তুরিন আফরোজ বলেন, এ মামলায় এমন কয়েকটি উপাদান রয়েছে, যেগুলো সংঘটিত অপরাধ আরও গুরুতর করে তুলেছে। যেমন আসামি সাকা চৌধুরী রাজনৈতিক ও ক্ষমতাশালী পরিবারের সন্তান, তিনি তাঁর কর্তৃত্ববাদী ও প্রভাবশালী অবস্থানের অপব্যবহার করে অপরাধ সংঘটন করেছেন। নৃশংসতার শিকার মানুষের সংখ্যা অনেক, তাদের মধ্যে অসংখ্য নারী ও শিশু রয়েছে। অপরাধের প্রকৃতি ছিল ভয়াবহ ও নৃশংস। কিন্তু এসব অপরাধের জন্য আসামি কখনো অনুতাপ করেননি। বরং ‘৩০ লাখ শহীদের মধ্যে ৩০ জনের নামও তো আনতে পারলেন না’—এ ধরনের বক্তব্য প্রমাণ করে, অপরাধের জন্য আসামি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন। এ জন্য আসামি সাকা চৌধুরীর সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত এবং তাঁকে বিন্দুমাত্র দয়া দেখানো ঠিক হবে না।

 

যুক্তি খণ্ডন শেষে রাষ্ট্রপক্ষের অপর কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম ট্রাইব্যুনালের বিচারক, দুই পক্ষের আইনজীবী, সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এ সময় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমিও ট্রাইব্যুনালের কাছে কৃতজ্ঞ। পৌনে তিন বছর ধরে এখানে থেকে নিজের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে গেছি, অন্যদের সীমাবদ্ধতাও বুঝতে পেরেছি। ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা অনেক ধৈর্যের পরিচয় দেখিয়েছেন, মাঝেমধ্যে দয়া দেখিয়েছেন। রায় যা হওয়ার হবে, তবে আমার কৃতজ্ঞতা থাকল।’

 

এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা আইনের মধ্যে থেকে সব কাজ করেছি, এখানে দয়া দেখানোর কোনো বিষয় নেই।’ এরপর এই মামলার প্রায় দেড় বছরের বিচারিক কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘রায় প্রস্তুত হলে তা ঘোষণা করা হবে। জাজমেন্ট সিএভি (কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট)।’

 

সাকা’র বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে শুরু

২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ১৭ নভেম্বর তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। ওই বছরের ১৪ মে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এরপর দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস ধরে চলা সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় চলতি বছরের ২৪ জুলাই। এ সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ৪১ জন, আসামিপক্ষে চারজন। ২৮ জুলাই থেকে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়, গতকাল তা শেষ হলো।

 

সাকা’র বিরুদ্ধে উথ্থাপিত তেইশ অভিযোগ

সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলায় ২৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একাত্তরের ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ড; চট্টগ্রামের মধ্য গহিরা, জগৎমল্লপাড়া, সুলতানপুর বণিকপাড়া, ঊনসত্তরপাড়া, শাকপুরা প্রভৃতি গ্রামে গণহত্যার অভিযোগ। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অনুসারে, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন সাকা চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি গুডস হিল একাত্তরে ছিল একটি নির্যাতন কেন্দ্র। অনেক ব্যক্তিকে সেখানে ধরে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এ ছাড়া হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নিপীড়নে পাকিস্তানি সেনাদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।

 

অপেক্ষার প্রহর গুণছে দেশবাসী

এদিকে সাকা’র বিচারের রায় শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছে দেশবাসী। দেশ-প্রেমিক প্রতিটি বাঙ্গালী মনে করে, সাকা’র ফাঁসি হওযা উচিত। কাউকে কাউকে আবার আশঙ্কার কথাও বলতে শোনা যায়, ইতিপর্বে হওয়া গোলাম আজম ও কাদের মোল্লার রায়ের ওপর আলোকপাত করে। অনেকে বলছেন, রহস্যজনক কারণে সাকা’র রায় যদি উল্টে যায় তবে সেটা হবে আরো বেশী দুঃখজনক।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.