গণহত্যা-১৯৭১

গণহত্যা-১৯৭১

মোনায়েম সরকার: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের দিন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সাথে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা সেদিনের ভাষণটি ক্যাসেট প্লে¬য়ারে রেকর্ড করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে বলা হয়েছিল ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো।’ এ ভাষণে অনুপ্রণিত হয়ে ৮ মার্চ হাতবোমা, পেট্রোলবোমা ইত্যাদি তৈরি এবং ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। গ্রেনেড তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, নটরডেম কলেজের আইরিশ অধ্যাপক চার্লস টাকার। বন্ধু হিসেবে সাথে ছিলেন অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্র, অধ্যাপক নূরুল আমিন ও ড. আবদুল্ল¬াহ। বোমা বানানোর স্থান ছিল বুয়েটের আহসান উল্ল¬াহ হল। বোমা কার্যকর কি-না তা পরীক্ষা করার স্থান ছিল চারুকলার পুকুর।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ১ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট স্থগিত করে দেন। সমগ্র দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। জনতা পথে নেমে আসে। রাজনৈতিক- অরাজনৈতিক সকল স্তরের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলে। এমনি সময়ে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে ন্যাপের সভায় আমি উপস্থাপকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বলি, এখন বক্তৃতা করবেনÑ ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।’ বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করায়, সে সময় আমি দল কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছিলাম। যদিও তখন পূর্ব পাকিস্তানের সকল জনগণ ‘বাংলাদেশ’ শব্দের সাথে প্রবলভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছে এবং মনেপ্রাণে বাংলাদেশ শব্দটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। 

সমগ্র দেশ উত্তপ্ত। পাকিস্তানি সৈন্যরা গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা ক্যান্টমেন্টে এসে অবস্থান করছে। রাজপথে সৈন্যবাহিনীর টহল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কিছুতেই বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বাঙালিও পাকিস্তানি শাসন কিছুতেই মেনে নিবে না। শহরে গুজব রটে গেছে সামরিক বাহিনী শহরে বাঙালিদের ওপর হামলা চালাবে। সমগ্র শহরে বিভিন্ন স্থানে বাঙালি-ছাত্র-যুবক-শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য হামলার প্রতিরক্ষা ব্যূহ হিসেবে হাতিরপুলে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের সাথে প্রতিরোধ ব্যারিকেডে আমিও অংশগ্রহণ করি।

ঢাকায় জনরব শোনা যাচ্ছিল, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজপথে নেমে আসবে। সমগ্র শহর স্তব্ধ। শংকা সারা দেশবাসীর মনে। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে আছেন, কিন্তু তাঁর কি অবস্থা তা সরেজমিনে পরখ করার জন্যে সন্ধ্যার পরপর শোভা আপার ৩২ নম্বর সড়কের দ্বিতীয় বাড়ি থেকে বের হয়ে জনশূন্যহীন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করতে থাকি। আবদুর রাজ্জাক এবং শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক  আবদুল মান্নানের একটি লাল গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু বাড়ি থেকে চলে গেলেন কি রয়ে গেলেন এ সম্পর্কে উৎসুক এবং উদ্বিগ্ন আমি কিছুই স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছিলাম না। অনেকটা হতাশ হয়ে ধানম-ি ২৪ নং রোডে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বাড়িতে গমন। সেখানে তাঁর পরামর্শে শ্যুটিং ক্লাবের কিছু অস্ত্র তাঁর বাসা থেকে মাজহারুল ইসলামের স্ত্রী বেবী আপার বড়ভাই কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় গোপনে গাড়িতে করে পৌঁছে দিই স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এবং আমিÑ কারণ যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে এসব প্রয়োজন হবে বাঙালির। এমনই মানসিক প্রস্তুতি ছিল আমার। এই রাতেই শুরু হয়ে যায় বাঙালি নিধনের রক্তাক্ত অধ্যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশÑবিজিবি) ব্যারাক আক্রমণের শিকার হয়। শুরু হয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির স্বাধিকারের লড়াই। স্বাধীনতার লড়াই।

২ দিনের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানিরা কারফিউ শিথিল করে শুক্রবার ২৭ মার্চ। এইদিন বন্ধু অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্রের মোটর সাইকেলে করে শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রদক্ষিণ করি। তাঁর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের হত্যাযজ্ঞ পরিদর্শন ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে নির্মম। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মতোই ছিল এই সেনাবাহিনীর নিমর্মতা। চারদিকে শুধু ধ্বংস¯তূপ আর মানুষের লাশ। বিভিন্ন জায়গায় রক্তের দাগ, গুলির চিহ্ন। এক জায়গায় দেখি মাটি ঢিপি দিয়ে রাখা। তখন গণকবর শব্দটি আমার মাথায় ছিল না। পরে জেনেছি যেটাকে আমি প্রথম মাটির ঢিপি ভেবেছিলামÑ ওটা ছিল জগন্নাথ হলের শহিদদের গণকবর। জগন্নাথ হল থেকে উত্তর পাশের গেট দিয়ে বের হয়ে দেখি নালার পাশে মোটাসোটা একজন মানুষের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। তার লাশ অতিক্রম করে রোকেয়া হলের কাছে আসতেই কয়েকজন লোক আমার দৃষ্টি আকষর্ণের চেষ্টা করে দূর থেকে। আমি তাদের ইঙ্গিত অনুসারে পেছনে তাকিয়ে দেখি পাকিস্তানি আর্মি জিপ। আমরা আর দেরি না করে সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়ি।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর পরিকল্পিত গণহত্যা চালায় তখন আমি তা স্বচক্ষে দেখেছি। সেই রাতে আমি উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সাইন্স ল্যাবরেটরি (এলিফ্যান্ট রোড) এলাকাতে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে বাধ্য ছিলাম। মধ্যরাতে গুলির আওয়াজ আর আগুনের আলোতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও তার আশেপাশের বস্তিতে সেদিন কী তা-ব চলছিল তা আমার বুঝে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে অনেকেই চেনেন। পাকিস্তান আর্মিরা কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে বলেছিলÑ ‘বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মোয়াজ্জেম বলেছিলেনÑ ‘জয় বাংলা’। যতবার তিনি ‘জয় বাংলা’ বলেছিলেন ততবারই তাকে গুলি করা হয়। তারপর তার লাশ ছেচড়িয়ে আর্মি জিপে তোলা হয়। আমি পাশের গলিতে রাস্তার ওপর কমান্ডার মোয়াজ্জেমের রক্ত রঞ্জিত আল্পনা দেখেছি। আমি দেখেছি সাইন্স ল্যাবরেটরি মসজিদের মুয়াজ্জিনের লাশ পড়ে থাকতে। প্রিন্সিপ্যাল ওয়াহিদ বকশের কাজের লোক কৌতূহলবশত বাড়ির দুইতলার জানালা দিয়ে দেখছিল পাকিস্তানিদের তা-বলীলা। পাকিস্তানিরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। সেই কাজের লোকের লাশ দেখারও দুর্ভাগ্য হয় আমার।

২৫ মার্চ রাতে পুরো ঢাকা শহর এক মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছিল। বিনা কারণে একটি ঘুমন্ত জাতির উপর পৃথিবীর আর কোনো দেশে এ রকম পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছে কিনা তা আমার অজানা। বাংলাদেশের গণহত্যার পক্ষে প্রথম যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়ানÑ তার নাম পদগোর্নি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতবর্ষের ঋণ মনে রেখেও বলা যায়Ñ তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিমান নেতা যখন পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে বললেনÑ ÔStop GenosideÕ তখন বিশ্ববাসী বাংলাদেশের গণহত্যাকে সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শুরু করে। ‘জেনোসাইড’ বলতে যে ভয়ংকর নৃশংসতা বোঝায়, তা মোকাবিলায় বিশ্বসমাজের অবস্থান প্রকাশ পায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের কঠোরতায়। গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণ ও গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘ ২০১৫ সালে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জেনেভায় জেনোসাইড কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল, সেই দিনটিকে তাই জাতিসংঘ বেছে নিয়েছে বিশ্বব্যাপী গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধের দিন হিসেবে। পাশাপাশি জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করছে গণহত্যার শিকার কয়েকটি জাতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংঘটিত হলোকাস্ট, আর্মেনিয়া কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যা স্মরণে রয়েছে আলাদা জাতীয় দিবস।

২০১৭ সালে জাতীয় গণহত্যা দিবস বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পালিত হয়। এখন বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধ বাংলাদেশের গণহত্যায় ভূমিকা রাখে। আমেরিকার সঙ্গে চীনও সুর মেলায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে। শক্তিশালী ওই দুই দেশ যদি পাকিস্তানিদের অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে, বন্ধুত্বের খাতিরে পাকিস্তানিদের এত আস্কারা না দিত তাহলে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের বুকে এভাবে গণহত্যা চালাতে পারতো না। আমেরিকার সপ্তম নৌবহর যদি রাশিয়ার হুমকির মুখে না ফিরে যেতোÑ তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা কত ভয়াবহ হতো তা চিন্তা করতেও শরীর শিউরে ওঠে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা বাঙালি জাতি ও হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। গণহত্যার একেবারে সূচনায়, যখন এর লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, সেই সময় ২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্লাড ওয়াশিংটনে প্রেরিত তাঁর গোপন বার্তার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ বা ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’। বাংলাদেশের গণহত্যার সংবাদ ও ছবি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য ওয়াশিংটন পোস্টের যে সাংবাদিককে ধন্যবাদ দিতেই হয়, তার নাম সাইমন ড্রিং। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার কথা বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচার করেছেন এবং জনমত সৃষ্টি করতে সহযোগিতা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। বাঙালি জাতি তার কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবে। মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল ঘুরে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ভয়াবহতার যে ছবি মেলে ধরেছিলেন বিলেতের সানডে টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় সেই লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘জেনোসাইড’, সে প্রতিবেদন আলোড়ন তুলেছিল দুনিয়াব্যাপী। নয় মাসজুড়ে আরও অনেক প্রতিবেদনে গণহত্যার মর্মস্পর্শী বহু বিবরণ প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সংবাদের প্রাক্কালে পাওয়া গেল বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের মতো নিষ্ঠুরতার বিবরণ, যা ছিল জাতি ধ্বংসের লক্ষ্যে চূড়ান্ত আঘাত।

অজ¯্র তথ্য-প্রমাণ-সংবাদ রয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যা ঘিরে, নানাভাবে আলোচিত হয়েছে এর নৃশংসতা। এই গণহত্যা অস্বীকারের কোনো উপায় ছিল না, তারপরও অস্বীকারের চেষ্টা নানাভাবে দেখা গিয়েছিল এবং এখনো তার দেখা মেলে। একাত্তরের বাংলাদেশ তৎকালীন বিশ্ব গণমাধ্যমে, সিনেটে পার্লামেন্টে, সভা-সমাবেশ-মিছিলে বড়ভাবে জায়গা পেলেও বিজয়ের পর খুব দ্রুতই আলোচনা থেকে হারিয়ে যায় বাংলাদেশ, গণহত্যা তলিয়ে যায় বিস্মৃতিতে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একাত্তরের গণহত্যার পুনঃপ্রতিষ্ঠা খুব জরুরি। তবে তার চেয়ে গুরুত্ববহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আমাদের মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসের আরেকটি ঐতিহাসিক ক্ষণ, যখন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট’। গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য প্রথম বিধিবদ্ধ আইন। সেদিন সংসদে প্রদত্ত সমাপনী ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব তুলে ধরে আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেছিলেন, ‘আমরা এদের (যুদ্ধাপরাধীদের) মনে করি শুধু বাংলাদেশের শত্রু নয়, মানবতার শত্রু। সেই হিসেবে আমরা তাদের বিচার করতে যাচ্ছি। সেই দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের সভ্য মানবসমাজের কর্তব্য এদের নিন্দা করা, ঘৃণা করা, ধিক্কার দেওয়া।’

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অ্যাডহক ভিত্তিতে গঠিত দুই বিচারশালা, নুরেমবার্গ ও টোকিও আদালত ছিল মানবজাতি ও মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহ ও ব্যাপক পাশবিকতার বিচারে অভিনব পদক্ষেপ। এই অভিজ্ঞতার নির্যাস মেলে ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে, যেখানে অপরাধসমূহ সংজ্ঞায়িত হয় জেনোসাইড, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে। আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি বিধি অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠা পাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতÑ এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। তবে নানা কারণে সেই প্রত্যাশা-পূরণ আর ঘটেনি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে বিশ্বসমাজের করার কিছু ছিল না। সেই সময় গণহত্যা বিচারে না ছিল আইন, না ছিল আদালত, না ছিল গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগ। তাই বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল বিতর্ক হয়েছে, শরণার্থী দুর্গতির মানবিক দিক নিয়ে ছিল আলোচনা ও উদ্যোগ, কিন্তু গণহত্যা ও তা প্রতিরোধ নিয়ে জাতিসংঘ ছিল নিশ্চুপ। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে গণহত্যা অধ্যয়নে অগ্রণী অধ্যাপক অ্যাডাম জোন্সের উক্তি, যিনি দ্য স্কোর্জ অব জেনোসাইডসহ আরও বহু বইয়ের প্রণেতা। যা দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে স্বীকৃত। ২০১৪ সালে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গুরুত্ব মেলে ধরে বলেন, ‘এটা (আইসিটি-বিডি) ছিল গণহত্যার বিচারের বিধিবদ্ধ প্রয়াসে অগ্রগণ্য, ইতিহাসের প্রথম পদক্ষেপ যেখানে ‘জেনোসাইড’ শব্দবন্ধ মুখ্য ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে জোন্স বলেন, ‘যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া ও সিয়েরা লিওনে প্রতিষ্ঠিত অ্যাডহক ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর আগে নয়, কয়েক যুগ আগে বাংলাদেশ এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আইসিটি (বাংলাদেশ) খুব স্বল্পই পরিচিতি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের গণহত্যা তুলনামূলক গণহত্যা অধ্যয়ন বিশেষজ্ঞ, বিশেষভাবে আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা খুব সামান্যই বিবেচিত হয়েছে।’

বাংলাদেশের গণহত্যা যে বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পায়নি, সেটা নিয়ে গণহত্যার শিকার জাতি হিসেবে আমাদের খেদ থাকাটা স্বাভাবিক। এখানে স্মরণ করতে হবে এই সমস্যা যতটা না বাংলাদেশের তার চেয়ে বেশি মানবসভ্যতার। গণহত্যার শিকার মানুষদের প্রতি বিশ্বসমাজ দায়বদ্ধ, এই দায়মোচনে বিশ্বসমাজের ব্যর্থতার বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি। তবে কোনো উচ্চ মহল বা সংস্থায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দেন-দরবারের চেয়েও বড় দিক হলো বিশ্বসমাজকে তাদের দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া।

গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতার অবসান ঘটেছে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে। ট্রাইব্যুনালে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিধিবদ্ধভাবে একের পর এক বিচার সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর হচ্ছে। প্রায় চার দশক পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের বিচারে বাংলাদেশ তৈরি করল উদাহরণ।

বাংলাদেশ বহু বাধা পেরিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে বহু পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বিচার গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই বিচারের আওতামুক্ত রয়েছে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা। পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগনামা তৈরি হয়েছিল তাদের ছাড়িয়ে নিতে প্রবল চাপ তৈরি করেছিল পশ্চিমা ক্ষমতাবান মহল, চীনা নেতৃত্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল রাজন্যবর্গ। বস্তুত তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অশুভ আঁতাত। আর এর ফলে পার পেয়ে যায় গণহত্যাকারীরা। আজ তাই তলিয়ে দেখতে হবে কেন নয় মাসজুড়ে বাংলাদেশে অবাধে গণহত্যা পরিচালনা করতে পারল পাকিস্তানিরা, কেন পরাজিত হয়ে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের পরও গণহত্যাকারীদের বিচার করা গেল না। গণহত্যার বিচার যদি হয় বিশ্বসমাজের অঙ্গীকার তবে এ ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা ও নতুন পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।

গণহত্যার সূত্র ধরে জেগে উঠছে মার্কিন প্রশাসন তথা নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভূমিকা। আমরা যদি অতীত থেকে শিক্ষা নিতে চাই তবে এই ভূমিকার আরও গভীর বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন হবে। দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে ক্রিস্টোফার হিচেন্স দেখিয়েছেন কিসিঞ্জারের হাতে কেবল বাংলাদেশের গণহত্যার রক্ত লেগে নেই, পূর্ব তিমুর, চিলি, আর্জেন্টিনাসহ কয়েকটি দেশের মানবতাবিরোধী নৃশংসতার পেছনেও কাজ করেছে তাঁর অমানবিক ইন্ধন ও মদদ।

গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণে কোটি দীপ প্রজ্বলিত হয়েছে বাংলাদেশে। এই অগ্নিশিখা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায়। আমাদের প্রত্যাশা, গণহত্যাকারীরা যেন পার পেয়ে না যায়, বিশ্ব সম্প্রদায় যেন তাদের নিন্দাবাদে মুখর হয়, তাদের ঘৃণা করতে শেখে, তাদের প্রতি ধিক্কার জানাতে পারে। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বইপত্র গবেষণাকর্মে আবার ফিরে আসছে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি, কেন কীভাবে এই গণহত্যা সংঘটিত হতে পারল, সেটা নিয়ে উঠছে বিতর্ক এবং মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নানাভাবে।

বিশ্বের অনেকেই যেমনÑ গ্যারি জে ব্যাস, শ্রীনাথ রাঘবন, সলিল ত্রিপাঠী, বীণা দি কস্তা, নয়নিকা মুখার্জি প্রমুখ বাংলাদেশের গণহত্যা উপজীব্য করে তথ্যসমৃদ্ধ বই আমাদের উপহার দিয়েছেন। এর আগে লিও কুপার, আর. জে. রামেল, স্যামুয়েল টোটেন প্রমুখের বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার সবিস্তার উল্লেখ আমরা দেখতে পেয়েছি। তবে সেসব ছিল ব্যতিক্রম। গণহত্যা-বিষয়ক বহু তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশনায় বাংলাদেশের গণহত্যা হয় একেবারে উপেক্ষিত হয়েছিল, কিংবা সামান্যই উল্লিখিত হয়েছিল। সে অবস্থার অবসান ঘটিয়ে গবেষক-মহলে একাত্তরের গণহত্যা ক্রমে স্বীকৃতি অর্জন করছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বেশ কয়েক বছর যাবৎ তিন-চারটি গবেষণাপত্রে উদ্দিষ্ট হয়েছে একাত্তরের গণহত্যা। ইয়েল ল’ স্কুলের হিউম্যান রাইটস ক্লিনিক ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচার আয়োজনের আইনগত বৈধতার প্রশ্নে অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অবস্থান বিশ্লেষণ করে তাদের ইতিবাচক পর্যবেক্ষণ মেলে ধরেছেন। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির আইন বিভাগ নারী নির্যাতনের বিচারকালে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রেজিস্ট্রারের কাছে মেলে ধরেছিল। এ মুহূর্তে কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানির খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী বাংলাদেশের গণহত্যা ও বিচার বিষয়ে গবেষণার কাজ করছেন। একাত্তরের গণহত্যা আবার নতুন করে বিশ্বসমাজের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হচ্ছে। ইতিহাসের এই স্বীকৃতি অর্থময় করে তুলতে আমাদের অনেক কাজ রয়েছে। বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে নিবিড় অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ, গবেষণা, পর্যালোচনা থেকে এর মূল শিক্ষা অনুধাবন এবং তার ভিত্তিতে গণহত্যার মতো নিষ্ঠুরতার চির-অবসান ঘটিয়ে সভ্যতার অগ্রগমনে আমাদেরও যোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায় বাংলাদেশ। জাতিসংঘ ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দেবে এটাই বাঙালি জাতি আশা করছে।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.