গল্প / আপন পর

গল্প / আপন পর

গল্প-----

 

হন্ হন্ করে সীমা অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শ্যামলের শেষ শব্দের গুঞ্জন বাজতে লাগল কানে। ‘কাজ হচ্ছে না অগ্রিমের টাকা কোথা থেকে আসবে? আকাশ থেকে পড়বে?’এ সব কথা সে নিশ্চয়ই বাবুদের কাছ থেকে শিখেছে। শুনলেই মনে হয় মুখস্ত কথা। এমনভাবে বলল যেন ওর বাপের টাকা কেউ নিতে এসেছে। কিছুক্ষণ আপন মনে গালাগাল দেয়। মুখের ওপর দু’কথা শুনিয়ে আসতে পারলে এত রাগ হত না তার। কিন্তু সে উপায় আছে! ঠিকাদারের চামচা যে। অফিস ঘর পাহারা দিতে দিতে নিজেকে মস্ত ম্যানেজার ভাবে।

 

সীমার বুকে সারা বিশ্বের হতাশা। পাঁচদিন ধরে বৃষ্টি চলছে। ঠিকাদারের কাজ বন্ধ। দু’দিন ধরে এক বেলার বেশি খাওয়া জোটে নি। পেটে কিল মেরে ক’দিন বেঁচে থাকা যায়? মাটি কেটে কেটে এক জায়গায় জড়ো করার পর তার কাজ হলো ঝুড়ি ভর্তি করে মাথায় নিয়ে আরেক জায়গায় ফেলা। এই বৃষ্টির মধ্যে মাটি কাটা যায় না। সকালে এক চিলতে রোদ দেখে মনে আশা জেগেছিল। কাজ করলে নগদ দুশো টাকা পেত। চাল আলু কতকিছু কেনা যেত। মাত্র দুশো টাকায় এক পৃথিবী ভর্তি সুখ।

 

সীমা ক্রদ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টিও মানুষের এত শত্রুতা করে? কাজটা নতুন নিয়েছে সে। এখন মনে হচ্ছে, বেশি টাকার লোভে ভুলই করেছে। আজকাল একটুতেই শিরদাঁড়ায় ব্যথা ওঠে। ঝুঁকে ঘাড়ে ঝুড়ি নিতে একেক সময় মনে হয় আর কোনোদিন বুঝি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। সে যে ঘরের মেয়ে, তার কি এসব করার কথা ছিল? ভাগ্য যে মানুষকে কোথায় নিয়ে ফেলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ঢোক গিলে মাথার মধ্যেই ফিরিয়ে নেয়। এককালে এখানে কারাখান ছিল। কবে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন এখানে ফ্ল্যাট হবে। পার্ক হবে। আরও কত কি! সুন্দর করে সেজে উঠবে ওই বিজ্ঞাপনের হোডিংটার মতো। হলে কি হবে, তার তো এখানে কখনও ঠাঁই হবে না। জল কাদা সরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সীমা ভাবতে থাকে এসব। হাতে পায়ে জোর নেই। ভাত না খেলে কি আর মহাপ্রাণী সুস্থ হয়? এমন সময় দেখে খানিক দূরে পল্টু দাঁড়িয়ে। খালি পা। বৃষ্টির এই ইলশেগুঁড়ি ছাটের মধ্যেও হরিজনের মতো ব্যাকুল চোখে নেড়ি কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে। দশ বছরের পল্টু খাবার দেখলে দুবছরের বালক হয়ে যায়। নেড়ি তার লম্বা থুতনি নিচু করে পাশের বাড়ির বাসি রুি চিবোচ্ছে।

 

পরম আগ্রহে পল্টু এগিয়ে, নেড়ির কোলের কাছে তার ব্যাকুল হাতখানা বাড়াতেই নেড়ি অসন্তুষ্ট হয়ে এমন ভাব দেখাল যেন বিন্দুমাত্র অংশের ভাগ দিতেও সে নারাজ। থাবা উঠিয়ে মুখব্যাদান করে নখ ও দাঁত বের করল এবং মুখে একরকম শব্দ করতে থাকল। তারস্বরে চিৎকার করে উঠল সীমা। ‘অ্যাই… অ্যাই ছেলেটা! কি করছিস, কামড়ে দেবে।

পল্টু ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে কাচুমাচু করে তাকাল ঘাড় ঘুরিয়ে। ‘আয়, বাড়ি আয়, তোর ব্যবস্থা করছি’। নেড়িটার ওপর খুব রাগ হলো পল্টুর। অকৃতজ্ঞতারও একটা সীমা থাকে। এক পাড়ার বাসিন্দা তারা। নেড়ির কাছ থেকে এতটা দুর্ব্যবহার আশা করেনি। তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এক লাথি মেরে নেড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে মার কাছে ছুলে গেল।

 

ঘরের সামনে খানিকটা জল জমে আছে। সীমা সেখানে তার পায়ের কাদা ধুয়ে নিলো। ঘরে ঢুকতেই শচীন তার ঘোলাটে চোখে হাতে দিকে তাকালো। লোভী গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু আনো নাই? খামু কি? ঘরে তো কিছু নাই।’ সীমা তখনই কোনও জবাব দিলো না।  বিছানার কাছে গেল। মেয়েটার জ্বর। গায়ে হাত দিয়ে অনুমান করতে চাইল। এরপর গম্ভীর গলায় বলল, কিছু আনতি পারিনি। আগাম দিলো না।’ শচীনের মুখে কিছু ভাবান্তর দেখা গেল না। গা-সহা হয়ে গেছে। বয়সের তুলনায় শরীরটা তার বেঁকে গেছে। হাড় ক’খানা গোনা যায়। কোনও রকম বেঁচে একজন মানুষ। কিছুক্ষণ বাদে বলল, ‘সাধনের দোকান থিকা ধারেও তো কিছু আনতে পারতা’। বাবার মুখের দিকে চেয়ে তিন্নীর একটু মায়া হয়। বলে, ‘বাবা তো ঠিকই বলেছে। আনতে পারতে তো।’

 

যে মানুষটা সারাদিনের উপার্জনের সম্বল নিয়ে দিনের  শেষে ঘরের উদও ভরতে আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে তার জন্য কারোর ভাবনা নেই। আর যে বিছানায় শুয়ে থেকেও বুকজোড়া খিদে নিয়ে দরজার দিকে চেয়ে সময় কাটায়, তাকে দেখে বুকের ভেতরটা খচ্ করে ওঠে, না? ভেতরে একটা রাগের ঝাঁঝ উঠছিল সীমার। বলল, নিজে গেলেই পারো তো। আগের টাকাই শোধ হয়নি। আবার কোন্ মুখে ধার চাইবো?’

অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না আর। এক সময় তিন্নী বলে উঠল, ‘মা মুড়ি আছে?’

‘সকাল অবধি ছিল যেটুকু, পল্টু খেয়ে নিয়েছে।’

তিন্নী চিৎকার করে উঠল, ‘এই দুই দিনে কিছু খাই নাই, আমার ক্ষিদা পায় না?’

নোংরা ছেঁড়া কাঁথাটা গায়ে দিয়ে শচীন শুয়ে ছিল। সে হঠাৎ উঠে বসল। মেয়ের পক্ষ নিয়ে আলাদা একটা দল পাকাবার চেষ্টা করল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দ্যাখলি তো! নিজেরাই সব খাইলো। তুই যে না খাইয়া আছোস হেডাও ভাবল না!’

সীমা ঘরের কাজ গোছাচ্ছিল। হাত থামিয়ে এবার সে চোখ ঘোরাল। এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকাল যেন দৃষ্টিতেই তাকে ভস্ম করে দেবে। গলায় বিষ ঝরিয়ে বলল, ‘মরণ কালেও তোমার মিথ্যা কথা যাবে না। জিব খসে পড়বে। ছেলেটা খেয়েছে। আমি নিজে একটা কণাও মুখে দিয়েছি? নিজে তো এক বছর ধরে বিছানায়। এতগুলো পেট, ঘর ভাড়া, কি করে চলে একবার ভাবো? সারাদিন কেবল খাই খাই। এত খাওন কোথা থিকা জোগাই?’

 

দুর্বল শচীন সবসময় দল পাকিয়ে চলবার চেষ্টা করে। এগারো বছরের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ দেখলি? ক্যামনো খোডা দেয়? রোজগার যে কোনওদিন করছি, হেইডা তো কারোর মনেই নাই। ক্যান যে মরি না! শালা কত লোক তো বে- ঘোরেও মরে।’ সীমা ঝেঁঝে উঠল, ‘গতর না খেটে আমিই বা কবে এই সংসারে মুখে দানা তুলেছি অ্যাঁ?’

শচীন এক ধমক দিয়ে বলল, ‘চোপ, আর একটা কথা কবিনে।’ কথা বলতে গিয়ে শচীন হাপাচ্ছে। তবু ওইটুকুতেই তার পুরুষত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা। ক্ষুধার্ত থাকাটাই কষ্টকর নয়। ক্ষুধার্তের ফাঁক দিয়ে  তার অক্ষমতার দিকে আঙুল দেখানোটা আরও জ্বালাময়।

 

বাইরে থেকে জল গড়িয়ে ভেতরে আসে বলে, জল আটকাবার জন্য দরজার কাছে একটা ন্যাতা পেতে রাখা আছে। ঘরের ভাবগতি থেকে সেই ভেজা ন্যাতা তুলে পল্টু পায়ের কাদা মুছল। এরপর ঢকঢক করে বোতলের জল খালি করে শুয়ে পড়ল। শচীন তখনও গজ গজ করে যাচ্ছিল। সীমার ইচ্ছে করল,লাথি মেরে এই সংসার থেকে বেরিয়ে যায়। উচিত কথা শুনলে গায়ে ফোস্কা পড়ে। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হলে কাল যদি কাজ শুরু হয়, না খেয়ে সে মাটি টানতে পারবে? খাবার দরকার ছিল তো তার। সে নিজে না বাঁচলে আর  কেউ বাঁচবে? সে-কথা কেউ বোঝে? একরত্তি উপকারে কেউ আসে না, সবাই শুধু হা করে থাকে তার দিকে।

গল্প

দুপুরের পর বৃষ্টিটা আরও জোরে নামায়, একটা কাতর গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। ছেলেমেয়ে দুটো এমন অকাতরে ঘুমোচ্ছে, দেখলে মনে হয় ধড়ে প্রাণ নেই।  সীমার কিছুতেই ঘুম আসে না। খালি পেটে শচীনেরও ঘুম আসার কথা নয়। দরজার বেড়া দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির ছাট আসছে পায়ের দিকে। নিশ্চয়ই কাঁথা-কাপড়ের ঝুড়িটা ভিজছে। ভিজুক। এইভাবে বৃষ্টি চললে বাইরের জল ঘরে ঢুকতেও সময় লাগবে না। শচীনের মুখ থেকে চাপা কোঁ কোঁ শব্দ বের হচ্ছে নি:স্বাসের সঙ্গে। একদমই যে চলাফেরার ক্ষমতা নেই তাতো নয়। পারে না উঠে একবার দেখতে? সব দায় কি তার একার? যাক সব ভেসে। পৃথিবী ধ্বংস হোক। তাহলে মরে সে নিজেও বাঁচে। কোনও ক্ষিদেয় তো জীবনে মিটল না। ক্ষিদে কি শুধু উদরের নিজস্ব জিনিস? সেই কুমারী বয়স থেকে যে পিপাসা তার বুকের মধ্যে ছিল, তা আজও রয়ে গেছে। শচীন মেটাতে পারেনি। সে সাধ্যই তার নেই। সেই কবে একবার অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল… আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে যৌবনের এক দামাল দিনে। যেন ওইটুকুই তার যথার্থ পাওনা ছিল জীবনে। যদিও যা শেষ হয়ে যায় তা শেষই হয়ে যায়। কিন্তু যা সত্যি ছিল সেটা তো মিথ্যে হয় না। পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিতে পুরনো আনন্দগুলোও থেকে যায়, পুরনো কষ্ট গুলোও থেকে যায়। মানুষ চাইলেও কি তা ভুলতে পারে? বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে শুনতে পেল, ‘ চলো সীমা… চলে যাই… অনেক দূরে, আর ফিরব না…। ’ সৈকত তখন উদভ্রান্ত যুবক। দৃষ্টিতে ক্ষ্যাপামির ভাব। বুকের মধ্যে উথাল পাথাল। একপাড়ায় তাদের বড় হওয়া। সৈকত টিউশনি করত। সীমা ক্লাস নাইনে। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে জ্যাঠাইমার ভাইপো এসে উপস্থিত হওয়ায় বাধ সাধল জ্যাঠাইমা। মা-মরা মেয়ের আকুতি কে বা শোনে। সৈকতের দোষ, সে দলিতের ছেলে। বাবা-কাকার হাতে যেদিন মার খেলো সৈকত, কি যেন ঘটে গেল তার ভেতরে। সর্বনাশের নেশায় নেচে উঠল তার হৃদপিন্ডটা। আকাশভাঙা বৃষ্টিতে ধোঁয়াটে চারদিক। সাদা সাদা হয়ে আছে দূরের মাঠ। আমবাগান, সামনের রাস্তা। তার মধ্যে কাদামাখা পিছল পথ বেয়ে বেয়াড়া আকর্ষণ টেনে নিয়ে গেল সৈকতের কাছে। ঘরে ঢুকেই নিজের হাতে আটকে দিয়েছিল দরজাটা। সৈকত খালি গায়ে চমকে তাকিয়েছিল। ওকে দেখে কী যেন একটা হচ্ছিল শরীরের ভেতরে। আচমকা খামচে ধরে সীমা। লোমশ বুকে মুখ গুঁজে, ঢোক গিলে কান্না আটকে বলল, ‘আমাকে জড়িয়ে ধরো, ভীষণ জোরে… এত জোরে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।’

 

বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। ঢেউভরা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে টিনের চালে। সে ঢেউয়েই ঘটে গেল প্রলয়। ওই অপার প্রাপ্তির সুখে বুঁদ হয়ে কতক্ষণ ছিল তারা কে জানে! যেন একঘুম ঘুমানোর পর সে মুখ তুলে সৈকতের মুখের দিকে তাকাল। সৈকত তাকে বুকে জড়িয়ে একইভাবে তাকিয়ে আছে। তার গলায় কাতরতা আর কষ্ট মিশে অদ্ভুত সুর বের হয়। বলে, ‘চলো সীমা, চলে যাই, অনেক দূরে…।’ কিন্তু কোথায় যেত তারা। কতদূর?

 

শচীনের সঙ্গে তার হৃদয়ের সেতু কোনও দিনই জোড়া লাগবার নয়। তাতে কি? পরিবারের সামাজিক মর্যাদা তো রক্ষা পেল। গ্রাম ছেড়ে শচীনের সঙ্গে এলো বটে, কিন্তু বাড়ীর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি। হয়ত এখন আর কারোর উপর রাগ নেই তার। অভিযোগও না। খুব দু:খ হলে শুধু মা’র কথা মনে হয়। মা মারা গেছে তার বারো বছর বয়সে। সেই অভাববোধ তো একটা ছিলই। মনে হয়, মা কি তাকে এই দুর্বিসহ জীবনে ঠেলে দিতে পারত? হয়ত পারত। কিন্তু এখন মা নেই বলে মা’র প্রতি আকুলতায় ভরে ওঠে মন। শচীনের কাশির দমকে ভাবনা ভাঙল সীমার। দেখে, বৃষ্টিটা ধরে আসছে। শচীনের পুরনো কাশিটা আবার বেড়েছে বোধ হয়। উঠে বসল সীমা। জিনিসপত্রের যা দাম তাতে ওষুধ কিনবে, না খাবার কিনবে? তবু তো মাসিমার ¯েœহপ্রবণ মন বলে যখন যা চায়, তাই পায়। যেমন ভালবাসে, তেমন পেট চিনেও খাওয়াতে জানে। তবু দোষের মধ্যে তাঁর— কথা একবার বলতে শুরু করলে আর থামে না। আর ধৈর্য্যশীল শ্রোতা পেলে তো আর কথাই নেই।

‘বুঝলি সীমা, ছেলেমেয়ে আমাকে বিদেশে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এই বাড়ির গাছপালা ঘরদোর দেখলে মনে হয় এখানে ওদের বাবা ঠাকুরদা ছিলেন। এ ছেড়ে আমি কোথায় যাব বলো? তাই এখানে থাকতেই স্বস্তি পাই। আর ক’দিন বা বাঁচব? তবে একটা কথা জি জানিস? মৃত্যুকে ভয় পাই না ঠিকই কিন্তু একাকী বেঘোরে মরতেও বড় ভয় আমার। ভীষণ পিপাসার কালে ক্ষীণ কণ্ঠে জল জল বলে চেঁচালেও কেউ দেখবেনা। এটাই কষ্টের রে!’

সীমা যদি তখন অধৈর্য হয়ে বলে, ‘ও মাসীমা, এই কথা আর কতবার বলবে, বলো তো?’

মাসিমা রেগে ওঠেন, ‘আমার যদি বলতে মুখ ব্যথা না হয়, তোর শুনতে আপত্তি কিসের অ্যাঁ? একটু কথা বলবো বলেই তো তোর অপেক্ষায় থাকি। সকালে ঘুম ভাঙতেই এক চিন্তা। আবার যে সকাল হলো… দুপুর বিকেল সন্ধ্যা, একটা আস্ত দিন। কীভাবে কাটাব, বিছানায় চোখ বুঁজেই তার পরিকল্পনা করতে থাকি। চোখে তো ঘুমও নেই। তা রাতেই আসে না, দিনের কথা তো দূর অস্ত। সারাদিনের মিনিট-সেকেন্ডগুলো পাথরের মতো ঠ্যালতে ঠ্যালতে চলি। তুই কি বুঝবি?’

বুঝি কি আর না, কিন্তু সেই উপায় কি আছে? এই তো এখনই ভাবনা হচ্ছে কতক্ষণে মাসিমার টাকা নিয়ে দোকানে যাব। এও ভাবি, আমার যা আছে বলেই হেলাফেলা করছি, বোঝা ভাবছি। মাসিমার তা নেই বলেই তো এত কাঙালপনা। দুটো কথা বলার জন্য।

গল্প

বৃষ্টি না থাকলেও ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় শরীর শিরশির করছে সীমার। আঁচলটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। দু’একজন ঠিকে ঝি বাড়ির দিকে ফিরছে। বস্তির দিকে যাবার আগে তারা কেউ দু’দন্ড রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করে। আজ সে দৃশ্যও উধাও। রাস্তার আলোগুলো একে একে জ্বলে উঠল। মাসিমার এত বড় বাড়িটা পুরো অন্ধাকার কেন? রাস্তার লাইন কি আলাদা? না কি ঠা-া পেয়ে ঘুমাচ্ছে। ভাবনার মধ্যেই দরজায় টোকা মারল। সঙ্গে সঙ্গে পাল্লাটা খুলে গেল। মাসিমা ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘এসেছিস?’ খাটের পাশে মিটমিট করে একটা বাতি জ্বলছিল। সেই আবছা আলোতে একবার তাকিয়ে সীমা বলল, ‘ ঘোর সন্ধ্যায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছ কেন? শরীর খারাপ?’ মাসিমা বলল, ‘তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এই দুর্যোগে আসবি ভাবিনি। টাকাটা টেবিলের ওপরে দ্যাখ।’ সীমার মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। মুখে একটু অ্যাকটিং করল, ‘ তা মরি-বাঁচি না এসে উপায় কি? তুমি না খেয়ে থাকবে?’ অদ্ভুত আওয়াজে হাসলেন মাসিমা। ‘পৃথিবীতে মনুষ্যত্ব তাহলে আছে, বল?’

‘তা আছে…। কিন্তু কারেন্ট নেই। এই অন্ধকারে কি করে রান্না করবো?’

‘আজ আর কিছু করতে হবে না। খাবো না আমি।’

 

এক ফুঁয়ে নিভে যায় সীমার আশাটুকু। ক’দিন ধরেই রাতের খাবারে মাসিমার রুচি নেই। তবু খাবারটা করলে সে নিজেও তো দুটো খেতে পারত? শুনে ক্ষিদেটা যেন তার আরও বেড়ে গেল। আসার সময় ফুলিদের ঘর থেকে সেই গন্ধটা নাকে এসে লাগামাত্র জিভ তার লকলক করে উঠছিল। মনে মনে ভেবেছিল, ‘ইস ফুলির মা খিঁচুড়ি রাঁধেেছ। কতদিন খিচুড়ি খাইনা। আচ্ছা, মাসিমাকে যদি বলা যায়, ও মাসিমা, বর্ষায় আজ খিচুড়ি খাও। তাহলে কি আর না বলবে? তাকে না দিয়ে খাবে? মানুষের মন বড় ঘাতসহা। একবার আশাভঙ্গ হলেও আবার বলল, ‘ খিচুড়ি খাবে? মুখে স্বাদ আসবে।’

‘না রে।’

এরপর আর নতুন কোনও প্রচেষ্টা সম্ভব নয়। সীমা মনে মনে ভাবল, ‘আর দেরি কেন? সময় নষ্ট করার মতো সময় তো তার হাতে নেই। টাকাটা হাতে নিয়ে বলল, ‘যাই তাহলে।’

‘একটু বোস।  তোর সঙ্গে দুটো কথা আছে। যদি মরে যাই আর তো পাবি না।’

উফ, তার কি এখন কথা শোনার সময়! দেরির জন্য মনে মনে অধৈর্য হয়ে উঠল। ‘এখনি মরার কিছু হয়নি… আগে তোমার ছেলেমেয়ে আসুক।’ চটে উঠলেন মাসিমা, ‘ছেলেমেয়ে এসে কি করবে? যা করার আমিই তো করছি। এগার বছর আগে ওদের বাবা মারা গেছেন। সেই থেকে তো একাই জীবন কাটছে। এখন আর ওরা এলো বা নাইবা  এলো, তাতে কী যায় আসে? ’ মাসিমার স্বর শুনলেই বোঝা যায়, ঢেউয়ের মতন অভিমান এসে ঝাপটা দিলো বুকে। কিন্তু এই মুহূর্তে ক্ষিদের কষ্টই সেরা কষ্ট, সে কি করে এই অভিমানের মর্ম বুঝবে। মনকে জিজ্ঞেস করল, আজ হলোটা কি মাসীমার? শরীরটা না হয় খারাপ। মনেও বুঝলাম কষ্ট। এইজন্য তার কি দোষ? এককাপ চা বানিয়েও যেতে বললেন না। কি করে ভুলে গেলেন এই দশ বছরের অভ্যাস? চোখে জল এসে গেল সীমার। মাসিমা বলে উঠলেন, ‘একটা কাগজ রেখেছি তোর জন্য। নিবি তো?’

 

অন্য কেউ হলে সীমা এখন মা-বাপ তুলে গালি দিত। আরে কাগজ ধুয়ে জল খাবো? পেটের জ্বালা মিটবে? এক এক সময় মানুষের দয়া দেখলেও রাগ হয়। এখন তার যা অবস্থা তাতে শনির দশা বললেও কম বলা হবে। বুঝল, বুড়ি অন্ধকারে একা থাকতে চায় না বলে কথার জালে কথার জালে আটকে রাখার ধান্দা। ধার নেওয়ার এই খেসারত। খুব রাগ হলো। কিন্তু কিছু বলার সাহস হলো না। এদের টাকা আছে। দয়া আছে। আর তার মতো লোকেরা তো হুকুম তামিল করতেই জন্মায়। ইচ্ছে করল নিজেকেই গাল দিতে। নিজের অক্ষমতাকে। ভগবানকেও। আচ্ছা, কারেন্টটা এখন চলে এসে বিশ্ব সংসারে কার কি ক্ষতি হতো? ঘরে আজ কারোর পেটে দানা পড়েনি। মেয়েটা অসুস্থ, এই অবস্থায় আর ধৈর্য রাখতে পারছে না সে। বলল, ‘প্রলাপ বকা বন্ধ করবে এবার?’

মাসিমা একটু থামলেন।  শুরু করলেন আবার, ‘ মরার পরে ওই বাগানোর খোঁজে সবাই আসবে দেখবি। এই জন্যই বলছিলাম।’ হঠাৎ সীমার  শিরদাঁড়াটা ভয়ে কনকন করে উঠল। মুখে বলল, ‘আজই যেন মরতে বসেছ। এর চেয়ে বেশি শরীর খারাপ হয়নি তোমার?’ বলো তো ডাক্তার ডাকি। রাতের শুতে আসতে পারি। কিন্তু এখন আর দেরি করতে পারছি না।’

‘ না না, যা তুই। তাড়াতাড়ি যা। বুড়ির অভিমান হলো বুঝি। দরজার চৌকাঠ ডিঙোতে গিয়ে ফিরে তাকাল একবার। ‘জল টল রেখে যাবো কাছে?’

‘দিবি? একটু দে তাহলে মুখে ঢেলে।’

সীমা জল খাওয়ানোর জন্য মাথাটা সোজা করতে গেল। পর মুহূর্তেই তার সমস্ত দেহ ঘেমে উঠল। বরফের মতো ঠা-া কেন শরীর। শুধু ঠা-া হলে এতখানি আতঙ্কের কারণ হতো না। সে সাহসী। ডাক্তারী শাস্ত্র তার জানা না থাকলেও এইটুকু বুঝতে পারে অনেক আগে মৃত্যু না হলে দেহ এত শক্ত হয় না। মানে কি? স্থিরভাবে কোনও চিন্তা করবার ক্ষমতা আর তার নেই। আতঙ্কে বুকের স্পন্দন পর্যন্ত থেমে আসছে। হঠাৎ বাতিটা দপ করে নেচে উঠল। এই অবস্থায় সীমা দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। বুঝতে পারল, পেছনটা আরও অন্ধকার হয়ে গেছে। অজ্ঞান হয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো। দৌঁড়ে অনেকটা দূরে এসে পড়ে গেল। একটু একটু করে সীমা সজাগ হয়ে ওঠে। পৃথিবীর সব শব্দ ভেসে আসতে থাকে তার কানে। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোখ খোল, সীমা চোখ খোল।’ অমনি সব মনে পড়ে গেল। কিন্তু সেদিন আর তার বাড়ি ফের হলো না। লোকজন সঙ্গে নিয়ে তক্ষুনি ফিরে এলো সেই বাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভরে উঠল আত্মীয়স্বজন, পড়শীতে। মাসীমার এক ভায়ের ছেলে কাকে যেন জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, মেডিকেল থেকে কখন বডি নিতে আসবে?’ আচ্ছন্নতায় আক্রান্ত সীমা কেঁপে উঠল। মাসিমা এখন ‘বডি’ হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে, ‘ কি ভাল গেল, বলতো?’ ভুগলো না, কাউকে কষ্টও দিলো না। ক’দিন ধরে যে বৃষ্টি হচ্ছিল।’ এই কষ্টের মানে কি? সান্ত¦নাও এত যন্ত্রণাদায়ক হয়? যে বোনের দু’বছরেও একবার দেখা মেলেনি, তার কান্না রাতের নি:স্তব্ধতাকে ফালাফালা করে দিচ্ছে। ‘দি-দি’ ! আমাকে ছেড়ে… চলে গেলি…।’ আর তার নিজের তো বিশ্বাস হচ্ছে না। একজন মানুষ বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে, ভাবতে পারে, খেতে পারে, তারপর মুহূর্তের মধ্যেই অবর্তমান, অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। সত্যি সত্যিই আর কোনওদিন সীমা বলে ডেকে উঠবে না মাসীমা। আজ সকালেও তো মানুষটা দিব্যি কথা বলেছেন।

গল্প

ই ভাবনার মধ্যেই সীমা যা যা করার করে যাচ্ছিল। যে যা চাইছে, এনে দিচ্ছিল। এখন সবাই উইলপত্র শোনার আগ্রহে অধীর অপেক্ষায়। এই ফাঁকে সে বাড়ি গেলে বাঁচে। কাউকে বলতে গেলে আটকে দিতে পাওে তাই সাবধানে গেট দিয়ে সবে বের হলো। অমনি পেছন থেকে হুঙ্কার ভেসে এলো।

‘এই মেয়ে, কোথায় যাচ্ছ?’

সীমা সঙ্কুচিত গলায় বলল, ‘আমার তো সব কাজ শেষ, বাড়ি যাচ্ছি।

‘এদিকে এসো।’

সীমা ঘরে ঢুকতেই উকিল বাবু ধমকে উঠলেন, ‘কে বলল তোমার সব কাজ শেষ হয়েছে।’ সেই কড়া  দৃষ্টির সামনে সীমা যেন আরও কুঁকড়ে গিয়ে গেল। উকিল বাবুর সেই চেয়ে থাকা যেন অনন্ত সময়ের জন্য। অমন করে দেখার কি আছে? সে কি চুরি করেছে?  বললেন, ‘ বোসো।’

 

এতো মহা মুশকিল। আত্মীয়-স্বজনরা পালা করে খবর নিচ্ছে কোথায় কি আছে। এক ভাই তো বলেই ফেললেন, ‘সত্যিই কিছু জানিস না? কাছের লোক তো একমাত্র তোকেই ভাবত।’

কেন ভাববে না? অসুস্থর সময় এক রাতও মাসীমাকে সে একা রেখেছে? সে খবর কি এরা কেউ রাখত? না কেউ একবেলা খোঁজ নিতো? মাসিমা নেই বলে এখন সবাই মিলে তাকে অপদস্থ করছে। আর কত অপমান অপেক্ষা করে আছে তার জন্য? গরীব বলে কি তার মান সম্মান নেই? এর জন্য বেঁচে থাকা। তার চেয়ে খুব সহজ রাস্তা তো এক গ্লাস জলের সঙ্গে একটু বিষ গিলে ফেলা! আর ভাবতে ভাল লাগছে না কিছু। সবার পিছনে, ঘরের এক কোণায় জুবুথুবু বসে, চোখ বুঁজে নানারকম দু:স্বপ্ন দেখছিল। হঠাৎ ঘরের গুঞ্জন ছাপিয়ে কানে এলো, ‘সীমাকে ! সুজাতা দেবীর নি:সঙ্গ জীবনকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য বাড়িটা উইল করে দিয়ে গেছেন?’

 

প্রথমটায় তো কিছু বুঝতেই পারেনি। যখন পারল, সেই স্মৃতি ফিরে ফিরে মনে পড়তে লাগল। আর কেবলই একটা ব্যাপার হচ্ছিল ভেতরে। গতকাল সন্ধ্যায় যা ঘটল, তা কি কখনও চোখের ভুল হতে পারে? এর ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। আছে শুধু বাঁধভাঙা চোখের জল। সেই কান্না, আকুলতা মিশিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে ক্রমাগত সে ডাকতে থাকে, ‘মা-সী-মা, মা-সীমা।’

***

 

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.