সৈয়দ জাহিদ হাসান: গত বর্ষায় হাওড় অঞ্চল প্লাবিত হয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এবার বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টিকারী শীত এসেছে। এমন শীত অর্ধ-শতাব্দীতে আর কখনো হানা দেয়নি দুর্বৃত্ত কবলিত নিরীহ বাংলায়। বাংলার জাগরণকে শুধু শত্রুরাষ্ট্রই স্তব্ধ করার চেষ্টা করেনি, প্রকৃতিও কখনো কখনো আপত্তি জানিয়েছে বাংলার জাগরণে। একাত্তরে বাঙালি আশ্চর্য যুদ্ধে মুক্তির তাজ মস্তকে পরে। অথচ সত্তর সালে তার উপকূল শোক সঙ্গীতে ভারাতুর হয়ে ওঠে। বেদনায় নুব্জ্য হয়ে পড়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। বাহাত্তর সাল থেকে খোঁড়া বাংলাকে জোড়া দেওয়ার কাজে হাত দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশে অনেকের গণ উপাধি নিয়েই কম-বেশি আপত্তি আছে। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। আমি অনেক জাতীয়তাবাদী নেতাকেই দেখেছি, তারা শেখ মুজিব বলতে দ্বিধান্বিত হন অথচ ‘বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করেন অবলীলায়। ‘বঙ্গবন্ধু’ সমস্ত বাঙালির দেওয়া ও নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া ‘পবিত্র উপাধি’। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বাংলা ও বাংলাজাত সবকিছু বুট জুতোর কালো অন্ধকারে ঢুকে যায়। শিফন-হিজাবে আবৃত হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে বঙ্গ জননী নিজে এসে ভার নেন এই দুর্দশাগ্রস্ত সংসারের। বাংলা বদলে যেতে থাকে। দৌড়প্রতিযোগিতার ছুটন্ত ঘোড়ার মতো উন্নয়নের সড়কে এগিয়ে থেকে থাকে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল। অর্থাৎ নয় বছর যেতে না যেতেই উন্নয়নের কলকব্জায় ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। এই ত্রুটি বড় বিপদের লক্ষণ। এই বিপদ সাহসের সঙ্গে সামাল দেওয়া দরকার। দশভুজা মায়ের মতোই এখন নির্মম হওয়া প্রয়োজন বাংলার শাসক লক্ষ্মীকে। অসুর দমনে তার রুদ্রমূর্তি ধারণ করা জরুরি।
প্রশ্ন হতে পারে, এতক্ষণ যে বিপদের কথা বললাম সেই বিপদের নাম কি? সেই বিপদ হলো ‘দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্যের’ বিপদ। ‘দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্য’ বাংলাদেশের ভেতর কাঠামোকে একেবারে শূন্য করে দিচ্ছে। বাহ্যিক উন্নয়ন মানবিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানবিক উন্নয়ন ধ্বংস করে শুধু রড-কংক্রিট-সিমেন্ট উন্নয়ন (আরসিসি উন্নয়ন) আকস্মিক তোড়ে অতলে তলিয়ে যাবে। দৃশ্যমান উন্নয়নের পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো অদৃশ্য উন্নয়নের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে রোগটি সর্বস্থলে প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করেছে তার নাম ‘দুর্নীতি’। দুর্নীতির সঙ্গে ঔদ্ধত্য যুক্ত হয়ে দুর্নীতিকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ দুর্নীতির লীলাক্ষেত্র। এখানে দিনদুপুরে ঊর্ধ্বতন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বস্তাভর্তি সরকারি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সাহস পায়। সংসদ সদস্য নিয়োগ বাণিজ্য করেন, যুবলীগ, ছাত্রলীগ টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে রক্ত ঝরায়। ফাইল নড়াচড়া করে টাকার শক্তিতে। দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতারেও প্রশাসনের গড়িমসি জনমনে প্রশ্ন তৈরি করার সুযোগ করে দিয়েছে। সরকারের যারা পদস্থ কর্মকর্তা আছেন, সকলেই সীমাহীন ধনসম্পদের মালিক। এই অবৈধ ধনসম্পদ তাদের শুধু ধনীই করেনি, অহংকারী করে তুলেছে। অহংকার পতনের মূল কারণ বলেই এতদিন বিশ্বাস করতাম। কিন্তু এই মুহূর্তের বাংলাদেশে চিরন্তন এই প্রবাদ বাক্যের উল্টোটাই দেখছি। বাংলাদেশে অহংকারীদের পতন হয় না উত্থান হয়, পদোন্নতি হয়, মিল-ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে মন্ত্রিত্ব জুটে।
বাংলাদেশে এমন কোনো সংসদ সদস্য নেই যে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। হয়তো তিনি নিজে সরাসরি দুর্নীতি করেন না কিন্তু তাকে আশ্রয় করে তার কাছের মানুষেরা নিয়মিত দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। এমন একটি প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে আমার এলাকার প্রাক্তন সংসদ সদস্য কাজী জাফর উল্লাহকে দিয়ে। তিনি ভাঙ্গা-চরভদ্রাসন-সদরপুর এলাকার কোনো মানুষের কাছ থেকে একটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন এমন নজির নেই। কিন্তু জাফর উল্লার আশেপাশের চেলা চামুন্ডারা এমনভাবে এই তিন এলাকার মানুষকে শোষণ করেছে যে, গত নির্বাচনে জাফর উল্লাহর পরাজয় শতভাগ নিশ্চিত করেছে। আগামী নির্বাচনেও তাকে সীমাহীন বেগ পেতে হবে জয়ের জন্য। এখানে একটি কথা বলে রাখি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন যে ছেলেখেলা বা চোখে ধুলো দেওয়ার নির্বাচন ছিল নাÑ তা ফরিদপুর-৪ আসনের নির্বাচন দেখে বুঝা যায়। এই আসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে গিয়ে নৌকার পক্ষে কাজী জাফর উল্লাহর জন্য ভাঙ্গা-সদরপুরের মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। ওই এলাকার জনগণ শেখ হাসিনার আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। জনগণ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেন এমন হলো? হলো এই কারণে যে, ‘দুর্নীতি আর ঔদ্ধত্য’ আওয়ামী লীগের কর্মীদের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। কথায় কথায় ঘুষ গ্রহণ, অনৈতিক কর্মকা- সম্পাদন, জনতার সঙ্গে তীব্র অহংকার প্রদর্শনই কাল হয়েছে আওয়ামী প্রার্থীর। এরকম যন্ত্রণা শুধু ফরিদপুর-৪ আসনের মানুষের মনেই নয়, আরো অনেক আসনের মানুষের মনেই আছে। মানুষের মন থেকে এখন যন্ত্রণার কালো দাগ ভালোবাসার শুভ্র সাবান দিয়ে ধুয়ে মুছে দিতে হবে। জনগণের কাছে বারবার ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। দলীয় দালাল দিয়ে নয়, মাথা পচা প্রশাসন দিয়ে নয়, নেতাকেই এখন অপারেশন থিয়েটারে যেতে হবে। নেতার নিজস্ব উপস্থিতি ছাড়া ‘দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্যের’ ক্যান্সারাক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এখন অসম্ভব।
বিশাল টাইটানিক জাহাজ শান্ত-শীতল বরফের ধাক্কায় সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল। নানাভাবে চেষ্টা করেও সেই জাহাজ বাঁচানো যায়নি। টাইটানিক সদৃশ আওয়ামী লীগ দলীয় নেতৃবৃন্দের দুর্নীতির ধাক্কায় ডুবে যেতে বসেছে। এখনই এসব ফাটল বন্ধ করতে হবে। ঔদ্ধত্য পরিহার করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের জনতার কাতারে দাঁড়াতে হবে। কেননা জনতাই ক্ষমতার উৎস। জনতাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। জনতার পেট ক্ষুধার্ত রেখে নিজের পেট ভরাতে চেষ্টা করলে বিদ্রোহী জনতা নেতার মুখের খাবার কেড়ে নিবেই।
অনেক সময় সতেজ পাতা দেখে বৃক্ষের ভেতরের ব্যাধি উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু ব্যবচ্ছেদ করলেই চোখে পড়ে পোকায় কাটা ফাঁকা জায়গা। দুর্নীতি হলো অদৃশ্য পোকা। এই পোকা এমন পোকা যা মৃত্যু নিশ্চিত না করে ছাড়ে না, কিন্তু চোরা কি শুনবে ধর্মের কাহিনী?
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী।