ছাত্র-রাজনীতির সেকাল-একাল

ছাত্র-রাজনীতির সেকাল-একাল

মোনায়েম সরকার: বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হচ্ছে বুয়েটের প্রতিভাবান ছাত্র আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকা-। দেশের সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখন এই হত্যাকা- নিয়ে নানারকম গুঞ্জন চলছে। ছাত্রহত্যা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫১ জন মেধাবী ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, একটি হত্যাকা-ের বিচারেও কারো শাস্তি হয়নি। ঘাতকরা বাংলাদেশে শাস্তি পায় না বরং পুরস্কৃত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে যারা সপরিবারে হত্যা করেছিল, তাদের যেমন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। ঘাতক ছাত্রনেতারা সেভাবে বিভিন্ন সময়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছে। অপরাধীর শাস্তি না হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়, এই সত্য যতদিন পর্যন্ত আমরা স্বীকার করে না নিব ততদিন অপরাধ কমবে বলে মনে হয় না।

১৯৬৩ সালে আমি প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ষাটের দশক ছিল বাংলাদেশের ছাত্র-রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়। এ সময়ে যারা ছাত্র রাজনীতি করেছেন তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সে সময়ের অনেক ছাত্রনেতাই আজ বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর স্বনামধন্য নেতা। এ প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ এফ.এইচ. হলের প্রাক্তন ভিপি ড. ওয়াজেদ মিয়া ও ড. মাহাবুব হোসেনের কথা উল্লেখ করতে চাই। উপরিউক্ত দুজনই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছিলেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হন ওয়াজেদ মিয়া। জেলখানায় ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয় এবং মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলেই তিনি ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভ পরিণয় সম্পন্ন করেন।

আমাদের সময়ে ছাত্রনেতারা কেমন ছিলেন, সে সম্পর্কে বলতে গেলে বলতেই হয়, আমাদের সময়ের ছাত্রনেতারা সত্যিকার অর্থেই দেশপ্রেমিক ছিলেন। তারা সব সময়ই মনে করতেন, এদেশ আমাদের দেশ, এদেশের মানুষকে সেবা করাই আমাদের প্রধান কাজ। সে সময়ের ছাত্রনেতারা টেন্ডারবাজি বুঝতেন না, তারা কেউই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তারা কেউ জুয়া, ক্যাসিনো, এগুলোর ধারে কাছেও ভিড়তেন না। সে সময়ের ছাত্ররা লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী ছিল। বেশিরভাগ ছাত্রনেতাই তার ক্লাসের উজ্জ্বল, মেধাবী ছাত্র ছিলেন।

আজকের দিনে কোনো ভালো ছাত্র ছাত্র-রাজনীতি করেন কিনা তা আমার জানা নেই। একজন ভালো ছাত্র সে একজন ভালো মানুষও। একজন দরদি মানুষ কখনোই তার সহপাঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে না, সে কখনোই অস্ত্র হাতে মিছিলে-মিটিংয়ে শো-ডাউন করতে পারে না। যারা অস্ত্র নিয়ে নিরীহ মানুষকে আঘাত করে তারা সন্ত্রাসী ছাড়া আর কিছুই নয়। সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্রের আবর্জনা। তাদের জন্য কোনো ক্ষমা প্রদর্শন করা শোভন কাজ নয়। যথার্থ শাস্তিই এদের একমাত্র প্রাপ্তি। ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের শাস্তিই আজ ষোলো কোটি মানুষের একমাত্র দাবি।

পাকিস্তান আমলে এনএসএফের গু-ারা আমাদের ছাত্রদের উপরে মাঝে মাঝেই আক্রমণ চালাতো। তখন আমরাও তাদের মাঝে মাঝে মারধর করতাম। সামান্য হাতাহাতি ছাড়া তখন গোলাগুলির রেওয়াজ ছিল না। তখন বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ছিল না, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা বুয়েটের হলগুলো আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতাম। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা হলই এক-একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট। সেখানে অস্ত্র, মাদক, জুয়া সমানে চলে। ছাত্ররা পড়ার টেবিলে না বসে জুয়ার টেবিলে সময় কাটায়। কলম নয়, আজ তাদের পকেটে পাওয়া যায় পিস্তল। এটা খুবই দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী, সে হবে একটি দেশের সবচেয়ে আলোকিত, মানবিক মানুষ। তাদের কাছে দেশ আশা করে সর্বোত্তম সেবা। অথচ আজকের বাংলাদেশে যদি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকাই, তাহলে সেখানে দেখি, দিনে-দুপুরে শিক্ষককে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ (সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের আক্রমণের কথা স্মর্তব্য), টেন্ডার বাণিজ্যের জন্য উপাচার্যকে হুমকি (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কথা মনে করুন), ভিন্ন মতের ছাত্র বন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা, জুনিয়র ছাত্রদের অশ্লীল র‌্যাগিং ইত্যাদি। ছাত্রদের প্রত্যেকটি কার্যকলাপই আজ বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ করছে। আজ পিতা-মাতারা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে হত্যার মহড়া চলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সন্তানদের পাঠাতে চাই না। 

আমাদের অতীত ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলনে, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও ছাত্রদের ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের ছাত্ররা যে অবদান রেখেছেন তা জাতি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের ছাত্রদের যে অসামান্য ভূমিকা তাও আমরা কোনোদিন ভুলব না। নব্বই দশকের পরে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি অনেকাংশেই অপরাজনীতির শিকার হয়। সেই ধারা এখনও চলমান আছে। আজ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের স্কুল-কলেজেও ছাত্র রাজনীতি রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে।

সিলেটের এম.সি. কলেজ ক্যাম্পাসে জনসম্মুখে আক্রান্ত হয় খাদিজা। সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বেঁচে যায়। বরগুনা কলেজের রিফাত শরীফ হত্যাকা-ও কিছুদিন আগে দেশের শীর্ষ সংবাদ হয়েছিল। আজ পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, ছাত্ররা জড়িত হয়ে পড়ছে ধর্ষণ, খুন, মাদকে। ছাত্রদের এই বিপথগামিতা দেশের জন্য অশনিসংকেত বলেই মনে করছেন মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিশ্লেষকগণ।

একজন ছাত্রকে মনে রাখা দরকার, বুয়েট, মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করতে তার পেছনে রাষ্ট্র লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ টাকা সরকার এ কারণেই খরচ করে যাতে তারা ভবিষ্যতে দেশের সেবা করতে পারে। সন্ত্রাসীদের আরো বড় সন্ত্রাসী বানানোর জন্য সরকার হাজার হাজার কোটি খরচ করেন না। এ কথা ছাত্রদের আজ উপলব্ধি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার না করে শিক্ষার্থীদের উচিত লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বিশ্বে স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করা।

আজকের বাংলাদেশে যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবেন, তারা অনেকেই হতাশা প্রকাশ করছেন ছাত্রদের নৈতিক স্খলনের ভয়াবহ চিত্র দেখে। এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে উন্নয়নশীল বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা।

দেশের মূলধারার রাজনীতি কলুষিত হলে ছাত্র রাজনীতিতেও তার কুপ্রভাব পড়ে। আজকের বাংলাদেশে মূলধারার রাজনীতিতে চলছে লুটপাট আর দুর্নীতির মহোৎসব। এ সব লুটপাটের ভাগ নিতে ছাত্রনেতারাও স্বেচ্ছায় ধরা দিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ গডফাদারদের হাতে। গডফাদারদের নির্দেশেই নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্র-রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতিকে এই অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিকল্প কিছু নেই বলেই অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি।

গত ১১ অক্টোবর, ২০১৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রেস কনফারেন্সে ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে যেসব কথা বলেছেন তা আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। তিনি বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপরই ছেড়ে দিতে চাই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই বিবেচনা করবেন তারা ছাত্র রাজনীতি রাখবেন নাকি নিষিদ্ধ করবেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চান, তাহলে তারা তা করতে পারবেন। আমি মনে করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছাত্র রাজনীতি বন্ধের এই পরোক্ষ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার এখনই উপযুক্ত সময়।

একটি প্রচলিত কথা আছে, “অধ্যয়নই ছাত্রদের তপস্যা”। অর্থাৎ ছাত্রদের কাজ হলো কঠিন অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলা। কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কুসুমকুমারী দাশের মতো এই কথা বলে আমরা আর কত আক্ষেপ করব, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।/মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,/মানুষ হইতে হবে এই যার পণ।” একজন ভালো ছাত্র শুধু একটি পরিবারেরই অমূল্য সম্পদ নয়, সে রাষ্ট্রেরও সম্পদ। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ তাদের অতীত গৌরবের দিকে তাকিয়ে দেশ-জাতির কল্যাণে জীবনোৎসর্গ করবে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

১৩ অক্টোবর, ২০১৯

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.