সৈয়দ জাহিদ হাসান: মানুষ সভ্য হলে মানুষের প্রতি দয়াশীল হয়, সেবাপরায়ণ হয়, এতদিন এটাই শুনেছি। শিক্ষার বিস্তার আমরা এ কারণেই আশা করি যে, শিক্ষার আলো জ্বলে ওঠলে অশিক্ষার অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। মানুষ মানবিক হবে, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও অন্যকে ভালোবাসবে। আজকের দুনিয়ায় সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে সেবকের চেয়ে শোষকের সংখ্যা বাড়ছে। সুরের চেয়ে অসুরই আজ সবখানে সংখ্যাগুরু। একবিংশ শতাব্দীর এই অত্যাশ্চর্য যুগে দাঁড়িয়ে শোষণের অভিনব কায়দা-কৌশল দেখছি আর ভাবছি মানুষ কি অবশেষে পশুত্ব অর্জনের দিকেই যাত্রা করল?
সরকারি-বেসরকারি যেকোনো সেবা প্রতিষ্ঠানে গেলেই দেখা যায় সেবার চেয়ে শোষণের প্রতিই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বেশি অনুরক্ত। একটি কাজ বা একটি তথ্য হয়তো এক-দুই মিনিটেই একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী করে দিতে পারেন, কিন্তু তিনি তা না করে হাইকোর্ট দেখানো শুরু করেন, সেবাগ্রাহক যত বেশি আতঙ্কিত হয়, শোষণ করা তত সুবিধা হয়। এ কারণে সমস্যা না থাকলেও সমস্যা খুঁজে বের করার জন্য রাষ্ট্রের সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুব বেশি আগ্রহী থাকে। শোষণের ফাঁদ পাতা আজ আমাদের চারপাশে। কোথাও সেবক দেখা যাচ্ছে না, সবখানেই শোষক আর শাসক দেখা যাচ্ছে। আত্মতৃপ্ত কেউ নয়, প্রত্যেকেই অতৃপ্ত, হাহাকার করে করে যাপন করছে ঘণ্টা, দিন, মাস। ত্যাগেই যদি সুখ হয়, সেবাই যদি পরম ধর্ম হয়, তাহলে ভোগ আর সীমাহীন শোষণকে কেন গুরুত্ব দিচ্ছে বিভ্রান্ত মানবসমাজ? আমাদের প্রত্যেকের গন্তব্যই মূলত মহাশূন্যতার গহ্বরে। অন্ধকার-আবর্তেই যেহেতু আমাদের বিনাশ ও চিরবিশ্রাম নির্ধারিত, তাহলে সেবার সৌন্দর্য দিয়ে পৃথিবীকে স্বর্গ না বানিয়ে আমরা সবাই শোষণের কদর্য দিয়ে পৃথিবীকে নরক বানাতে চাইছি কেন?
একজন ডাক্তার রোজ এক লক্ষ টাকা আয় করলেও তার মন ভরে না, অথচ ওই টাকা খাওয়ার মতো লোক তার ঘরে নেই। একজন নার্স নিঃসন্তান বা একা, তবু দুই হাত ভরে টিপস মা পেলে তার ঠোঁটে হাসি দেখা যায় না। থানায় ধর্ষিত হয়ে গেলেও টাকার দরকার, ধর্ষণ করে গেলেও টাকা দরকার। ন্যায়বিচারও আজকাল আর বিনা পয়সায় পাওয়া যায় না। রাস্তা-ঘাটে চলতে গেলেও অনর্থক হয়রানি হতে হয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর হাতে। কোথাও আজ সেবার অধিকার নেই মানুষের, মানুষ আজ শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে অবিরাম। প্রেসক্লাবের সামনে গেলে আনসার বা পুলিশ মাঝে মাঝে রিকশা আটকিয়ে দেয়। একবার আমার এক ছাত্র তার বৃদ্ধ মাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছিল আউটডোরে ডাক্তার দেখাতে। প্রেসক্লাবের সামনে যথারীতি বৃদ্ধ মাকে বহনকারী রিকসা আটকে দিল, আমার যুবক ছাত্র ও তার মা কিছুক্ষণ অনুরোধ করে পুলিশকে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হলো, অবশেষে রিকসাওয়ালা পাঁচ টাকা ঘুষের বিনিময়ে রিকসা পার করার সুযোগ পেয়ে সেই ঝামেলা থেকে রক্ষা পেল। যেখানে একজন মায়ের অনুরোধ গুরুত্ব পায় না, ছোট ভাইয়ের কচি মুখ দয়া জাগায় না, অথচ পাঁচ টাকায় বিক্রি হয় বিবেক, সেখানে শোষণের মাত্রা কি ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে তা বোঝার জন্য আর কোনো উদাহরণ দরকার আছে বলে মনে হয় না।
গত মাসে আমার পাশের বাসার ফোরকান সাহেবের বিদ্যুৎ বিল এসেছে আটত্রিশ হাজার টাকা। বিল হাতে পেয়ে ফোরকান সাহেবের হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা। এতদিন আটশ-নয়শ-হাজার পর্যন্ত তার বিল উঠেছে, এবার তিন বছরের বিল উঠেছে এক মাসে। ফোরকান সাহেব কাগজপত্র নিয়ে ছুটলেন বিদ্যুৎ অফিসে। বহু ঘোরাঘুরি করে বিল তিনি কিছুটা কমালেন বটে তবে চোরাপথে তাকে যে টাকা ঢালতে হয়েছে তার পরিমাণও একেবারে কম নয়। উচিত কাজে ঝামেলা সৃষ্টি করা আমাদের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা বিশ্রী প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোনো তদারকি নেই বলেই হয়তো ‘মগের মুল্লুকের আইন এদেশে চলছে। যে সমাজে আদরের চেয়ে আক্রমণ, সেবার চেয়ে শোষণ, দয়ার চেয়ে দমন-দংশন লক্ষণীয় সে সমাজ মানুষের সমাজ হতে পারে না। মানুষের সমাজ হবে মানবিক, সৌহার্দ্যপূর্ণও প্রেমময়। দুরাচারী স্বভাবের মানুষে ভরে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ। অর্থলোভ আর নিয়মহীন উচ্ছৃঙ্খলতায় ডুবে আছে সেবকের সেবাদানকারী মন। সেবার সৌন্দর্য, ত্যাগের মহিমা সৃষ্টি করতে না পারলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। আমাদের পৃথিবীতে দিন দিন ধর্মালয় বাড়ছে, ধার্মিকও বাড়ছে; সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্নীতি আর শোষণ। এমনটি হবার কথা ছিল না। তবু এমনটিই হচ্ছে। সাইনবোর্ডে সেবার কথা থাকলেও অন্দরে গিয়ে পরিচয় পাচ্ছি শোষণের। আমরা সাইনবোর্ড সর্বস্ব সেবা চাই না, অন্দর মহলের ও অন্তর মহলের শুদ্ধতা কামনা করছি।
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী।