ড. জ্যাকিল ও মি. হাইড : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ড. জ্যাকিল ও মি. হাইড : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মোনায়েম সরকার: স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, কবি ও ভ্রমণকাহিনী লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন (১৮৫০-১৮৯৪) একটি সাড়া জাগানো রহস্য উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ড. জ্যাকিল অ্যান্ড মি. হাইড’ নামে। সংক্ষেপে এটাকে ‘ড. জ্যাকিল অ্যান্ড মি. হাইড’ বলা হয়। এই উপন্যাসে দেখা যায় ড. জ্যাকিল এক ধরনের ঔষধ আবিষ্কার করেন যেটি ব্যবহার করে তিনি বিপরীত চরিত্রের মানুষে পরিণত হয়ে যান, আবার আর একটি ঔষধ প্রয়োগ করে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। এভাবে ড. জ্যাকিল এক দেহে ভালো ও মন্দ দুটি বিপরীত চরিত্র লালন করতে থাকেন। ড. জ্যাকিল তার মন্দ স্বভাবের মানুষটির নাম দেন মি. হাইড। দিনের বেলায় যাকে মানুষ ড. জ্যাকিল বলে জানতো রাতের বেলা সেই ড. জ্যাকিলই হতেন মি. হাইড। ক্রমাগত ঔষধ ব্যবহারের ফলে এক সময় পরিস্থিতি এমন হলো তিনি না চাইলেও মি. হাইডে রূপান্তরিত হতে লাগলেন এবং তার দ্বিতীয় ঔষধ প্রয়োগ করেও তিনি আর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারছেন না। এক পর্যায়ে আত্মগ্লানিতে আত্মহননের পথ বেছে নেন ড. জ্যাকিল। দারুণ এক রোমাঞ্চকর উপন্যাস ‘ড. জ্যাকিল অ্যান্ড মি. হাইড’।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কয়েকটি চরিত্র আমার কাছে ড. জ্যাকিল অ্যান্ড মি. হাইড বলে মনে হয়। এই রাজনৈতিক ও সামাজিক চরিত্রগুলো দিনের বেলা অর্থাৎ জনসমক্ষে এক রকমের মুখোশ পরে থাকে, রাতের বেলা বা গোপনে এরা হয় অন্য মানুষ। এদের চিনতে গেলে সারাক্ষণ এদের পিছনে পিছনে লেগে থাকতে হয়। না হলে এদের আসল চরিত্র উদ্ঘাটন করা কিছুতেই সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের একজন ড. আছেন তিনি গরিব চোষার অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করে সম্মানিত নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। নোবেল কমিটি কেন তার গলায় এই দামি পুরস্কার ঝুলিয়ে দিয়েছেন সেই সময় তা বোঝা না গেলেও আজ মানুষ বুঝতে পারছে এর পেছনে ছিল বিরাট অংকের নগদ টাকার লেনদেন। নোবেল জয়ী এই ড. সাহেব দিনের বেলা সারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করে বেড়ান, বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সম্মানিতদের সঙ্গে ছবি তোলেন এবং তাঁর পোষ্য পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক প্রচার মাধ্যমে তা প্রচার করে বেড়ান। তিনি বাস করেন রাজ-রাজাদের প্রাসাদে প্রাসাদে আর মুখে পরিচয় দেন গরিবের ত্রাণকর্তা বলে। দিনের আলোকে যেমন রাতের অন্ধকারে এই লোকটি ঠিক তার বিপরীত। এই ড. সাহেবের শোষণ ক্ষেত্র গরিব বাংলাদেশ কিন্তু তিনি সারাক্ষণই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করায় ব্যস্ত। তার চিঠির কারণে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয় বিশ্বব্যাংক (উইকিলিক্সে প্রকাশ)। মাইনাস টু ফর্মুলার ভয়ঙ্কর নায়কদেরও তিনি অন্যতম। গরিবদের শোষণ করে তার খায়েশ মেটেনি, পুরো দেশটাকেই তিনি শোষণ করার পাঁয়তারা করেছিলেন। ভাগ্যিস বাংলাদেশের মানুষ ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ড. হুমায়ুন আজাদ স্পষ্টবাদী লোক ছিলেন। তার বুকের পাটা এদেশের অনেকের চেয়েই বড় ছিল। তিনি এমন কিছু কথা বলে গেছেন, যা অনেকের পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। তার একটি প্রবচনে পড়েছিলাম, ‘একজন রাজাকার চিরদিনের জন্য রাজাকার কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরদিন মুক্তিযোদ্ধা নন।’ কথাটি যে সত্য তার প্রমাণ এদেশের আরেক ড. সাহেব। সংবিধান প্রণেতা বলে তিনি বিখ্যাত হলেও তার ভেতরে রয়েছে মি. হাইডের চরিত্র। তিনি যখন যেখানে সুবিধা পান সেখানেই হাজির হয়ে জয়ধ্বনি দেন। নিজেকে তিনি এতটাই বড় এবং বুদ্ধিমান ভাবেন যে, ভোটে দাঁড়ালে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। তিনি এক সময় প্রগতির পক্ষে ছিলেন কিন্তু এখন তার পদক্ষেপ বিপরীত ধর্মী। তার ইহুদি জামাতা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে যেভাবে নগ্ন হয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের মানুষ তাতে অবাক হয়ে গেছেন। অনেকেই বলাবলি করেছে, এ ক্ষেত্রে আমাদের এই ড. সাহেবেরও মৌন সম্মতি ছিল। যদিও কথাটি আমার বিশ্বাস হয় না, আবার জনরব উড়িয়ে দেয়ার শক্তিও আমার নাই। এই আইন বিশেষজ্ঞ ড. সাহেব এখন বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তার দল কেউ না গুনলেও তাকে অনেকেই গোনে। কারণ তার কাছে এমন টনিক আছে যা দিয়ে মি. হাইড তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশের মি. হাইডরা কোথায়, কখনো কোনো মানুষের উপকার করেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু মানুষের দুরবস্থাকে আরো শোচনীয় করতে এদের তুলনা নেই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন ডাক্তার আছেন, তিনি আগে জাতীয়তাবাদী ছিলেন, এখন নিজেই দল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার দলে কতজন কর্মী আছে সেটা বড় কথা নয়, তবে তিনি নিজেকে এদেশের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর বলে মনে করেন। যেখানে সুবিধা সেখানেই এই ডাক্তার সাহেব তার সহযোগী চেলাচামুন্ডা নিয়ে হাজির হন। ঈশ্বর এদের দিয়ে অনেক কিছু করাতে পারেন, শুধু বাংলাদেশের উন্নয়ন রোধ করাতে পারেন না। বর্তমান বাংলাদেশে যদি এই ধরনের মি. হাইডরা না থাকতো, তাহলে দেশ আরো অনেক দূরে এগিয়ে যেতো। এরা দেশের মঙ্গল করতে না পারলেও দেশের প্রচ- ক্ষতি করার সামর্থ্য রাখেন।

এই ড. জ্যাকিল ও মি. হাইডরা চোরাপথের অপেক্ষায় আছে এখন। কখনো এরা আর্মিদের সঙ্গে আঁতাত করে, কখনো রাজাকার-মৌলবাদীদের কালো হাতে হাত মিলায়। কখনো বিদেশি শক্তির পায়ে চুমু খায়, কখনো জোট করে, কখনো জিকির তোলে একলা চলার। মাতাল হলে মানুষ যা করে, এরা ঠিক সেই প্রকৃতির।

আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এখনই ভোটের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। ইসলামী ভোট ব্যাংক, ড. জ্যাকিল ও মি. হাইডদের পরমাণুসদৃশ দল ও বিভ্রান্ত বামদলগুলোকে নিয়ে অনেকেই এর মধ্যে মনগড়া পরিসংখ্যান দিতে শুরু করেছেন। তাদের পরিসংখ্যান যদি সত্যিই হয়, তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশ ৪৬ বছরেও শিক্ষিত হয়নি, অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল হয়নি, মধ্যযুগের বর্বরতায়ই আটকে আছে।

বাংলাদেশ স্মরণকালের সর্বোত্তম অবস্থানে আছে বর্তমান সময়ে এবং সেটা আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে। যারা শেখ হাসিনার সমস্ত উন্নয়নকে ছোট করে দেখতে চায় বা দেখে, যারা শেখ হাসিনার সমালোচনায় মুখর তারা এই সময়ের ‘ডেড হর্স’। তাদের পরামর্শ দিবো নিজেদের চেহারা আয়নায় ভালো করে দেখার জন্য।  

আমি আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক নই, বরং তীব্র সমালোচক। আওয়ামী লীগ যে সাত ধোয়া তুলসীপাতা সে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু এ কথা আজ না বললেই নয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের যে ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেছে কার সাথে তার তুলনা করা চলে? তার এই সাফল্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃকও স্বীকৃত ও পুরস্কৃত হয়েছে। এগুলো কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব সত্য। আজ বলার চেষ্টা করা হচ্ছে শেখ হাসিনা ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে আপস করছেন। বিষয়টি খালি চোখে দেখে যারা মন্তব্য করছেন তাদের উদ্দেশ্যে শুধু এটাই বলবো, হেফাজতের ডাকে যখন শাপলা চত্বরে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল তখন কারা বিরিয়ানি, তরমুজ, শরবত খাইয়েছিল? ভোটের ও জোটের রাজনীতিতে তারা যদি হেফাজতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন, তাহলে আওয়ামী লীগ করলে দোষ কি? হেফাজত নিয়ে আওয়ামী বিদ্বেষীরা অনেক রকম মিথ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে, হাজার হাজার হেফাজতি হত্যা করা হয়েছে এমন কথাও প্রচার করা হয়েছে (পরে সব মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে)। আজ সেই হেফাজতকে যখন মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় একীভূত করার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা, তখনই একদল নিন্দাকারী তার বিরুদ্ধে আজগুবি সব কথা বলা শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, লড়াকু চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু, তিনি আপসকামী ও সুযোগসন্ধানী নন। শেখ হাসিনা ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে আপস করেননি বরং ধর্মীয় রাজনীতির দোহাই দিয়ে যারা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে অন্ধকারে বন্দি করে রেখেছিল শেখ হাসিনাই সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে তাদের অসাম্প্রদায়িক-আলোকিত জীবন উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছেন। আগামী দিনের আওয়ামী লীগ যদি দুর্বৃত্তপনা, দলীয় কোন্দল, যোগ্য কর্মীর মূল্যায়ন ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে জয় তাদের সুনিশ্চিত। তবে ড. জ্যাকিল ও মি. হাইডের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। এই ইঁদুরগুলো দাঁড় বাইতে না পারলেও পাল কাটতে ভীষণ ওস্তাদ।   

১০ মে, ২০১৭

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.