দেশের সংকটকালে ষড়যন্ত্রকারীদের উল্লাস দেশদ্রোহিতার শামিল

দেশের সংকটকালে ষড়যন্ত্রকারীদের উল্লাস দেশদ্রোহিতার শামিল

সৈয়দ জাহিদ হাসান: বাংলাদেশকে নিয়ে ঘরে-বাইরে অপপ্রচার চলছে। এই অপপ্রচারে ক্রমাগত বাতাস দিয়ে যাচ্ছেন দেশের চিহ্নিত ষড়যন্ত্রকারীরা। তারা চাচ্ছেন দ্রæত বাংলাদেশ দেউলিয়া হোক। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে ভালোয় ভালোয় পদত্যাগ করুন। এটা যারা চাচ্ছেন, তারা বাংলাদেশের মঙ্গল চান বলেই এই অলীক প্রত্যাশায় বুক বেঁধে আছেন তা নয়, তারা দেশের মঙ্গল চাইলে দেশের এই সংকটকালে সরকারকে নিশ্চয়ই সুপরামর্শ দিতেন, কী করলে সংকট থেকে দেশ-জাতি উদ্ধার পাবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করতেন, কিন্তু দেশবিরোধী গোষ্ঠী সেসব পথে না হেঁটে তারা মনে প্রাণে আশা করছেন বাংলাদেশ কেন দেউলিয়া হচ্ছে না। তাদের প্রত্যাশার পারদ বাড়িয়ে দিচ্ছে কতিপয় সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের আতঙ্কজনক শিরোনাম।

দেশের ভেতরে বসে যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, যারা ভাবছেন, বাংলাদেশ দেউলিয়া হলে কিংবা শ্রীলংকার মতো কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে তারা ক্ষমতায় বসবেন, এটা যে আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়, তারা তা বুঝতে পারছেন না। বাংলাদেশের মানুষ আগেও গরিব ছিল, এখনও গরিব আছে। শিক্ষার হার আগের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা এদেশে তেমন বাড়েনি, গরিব, অশিক্ষিত মানুষ ক্ষুধার্ত বাঘের চেয়েও ভয়ংকর। বাঘ হয়তো ক্ষুধার জন্য একটা-দুটো প্রাণী হত্যা করে ক্ষান্ত হয়, কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষ শুধু হত্যা সংঘটিত করেই ক্ষান্ত হয় না, তারা ধ্বংস করে শহর, বন্দর, জনপদ। অগ্নিসংযোগ করে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবানদের সুখের স্বর্গে।

ক্ষুধার্ত মানুষের আবেগ একবার উন্মাদনায় রূপ নিলে তা কত ভয়ংকর হয়, সেই দৃশ্য আমরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি। দেখেছি আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার দখলবাহিনী প্রত্যাবর্তনের সময় কাবুল বিমানবন্দরে, এমনকি শ্রীলঙ্কার দুর্নীতিবাজ সরকারকে উৎখাত করার সময় সেখানে যেসব নজিরবিহীন দুর্ঘটনা ঘটেছে তাও ইতিহাসে বিরল। এসব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেও যারা দেশের সংকটকালে, সংকট থেকে উত্তরণের পথ না বাতলে দিয়ে কেবল সংকটকে আরো তীব্র করতে চান, তারাও জনরোষ থেকে রক্ষা পাবেন না। কেন এই অপ্রত্যাশিত বৈশ্বিক সংকট তা একটু তলিয়ে দেখা দরকার।

করোনা ভাইরাস ঘটিত মহামারী থেকে পৃথিবী যখন ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময় সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকার ক‚টকৌশলের কারণে ইউরোপে শুরু হয় যুদ্ধের পরিকল্পনা। এশিয়া, আফ্রিকার গরিব দেশগুলোকে আমেরিকা শোষণ করে করে অনেক আগেই দেউলিয়া করে ছেড়েছে। এখন তাদের দানবীয় ক্ষুধা মেটাতে তারা হাত বাড়িয়েছে সম্পদশালী ইউরোপের দিকে। ইউরোপ আমেরিকার ছদ্মবেশী আচরণ প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝেছে আমেরিকা তাদেরকে যুদ্ধের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ইউরোপের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো ইচ্ছে করলেই থামাতে পারতেন এমনকি এখনও পারেন। কিন্তু আমেরিকার জন্যই ইউরোপের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রনায়কগণ এই যুদ্ধকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। আজ যখন এই যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশে দেশে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে তেল, গ্যাসসহ অন্যান্য সংকট তখন তারা বাধ্য হচ্ছেন যুদ্ধবিরোধী দিতে। শক্তিশালী রাশিয়া আজ ইউরোপের যুদ্ধবিরোধী কান না দিয়ে বরং ইউরোপকে উল্টো শায়েস্তা করার অনমনীয় মনোভাব ব্যক্ত করছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন যেভাবে রণহুংকার দিচ্ছেন, তাতে ধরেই নেওয়া যায়, এই যুদ্ধে রাশিয়া পরিপূর্ণ বিজয় ছাড়া ইউক্রেন থেকে ফিরে আসবে না।

ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের অর্ধ-উন্মাদ প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে উদ্ভ‚ত দৈশিক সংকট সমাধান করতে না পেরে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, ইতালির প্রধানমন্ত্রীও অনুসরণ করেছেন সদ্যবিদায়ী বরিস জনসনের পদাঙ্ক। ওদিকে কানাডা, ফ্রান্সেও গুঞ্জন উঠেছে রাষ্ট্রপ্রধানদের পদত্যাগের। এমন সব খবরের ভিড়ে বাংলাদেশের দেউলিয়া হওয়া না হওয়া খুব একটা গুরুত্ব বহন করে কি? ধনীরা ভাতের অভাবে মরতে বসেছে, আমাদের মতো হা-ভাতের দুঃখ কেন?

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে বাংলাদেশ কী অবস্থায় ছিল সেটা একটু ভেবে দেখা দরকার। তখন বিদ্যুতের কী অবস্থা ছিল, বৈদেশিক রিজার্ভ কত ছিল, কেমন ছিল আমাদের জিডিপির সূচক কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা? এসব যারা দেখেও না দেখার ভান করেন, তারা কিছুতেই রাষ্ট্রের মঙ্গল আকাক্সক্ষা করেন না। আমরা অনেকখানি উন্নতি করেছি বটে, তবে এই উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। একটি রাষ্ট্রে যেকোনো সময়ই দুর্যোগ এসে হানা দিতে পারে। সেই দুরন্ত দুর্যোগে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেতে পারে, যেমন হয়েছে শ্রীলঙ্কায়, কিন্তু সবকিছুর পরেও আবার সেই বিপদগ্রস্ত রাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়াতে পারে যদি সেই রাষ্ট্রের জনতার মধ্যে দেশপ্রেম থাকে, থাকে জাতীয় ঐক্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই দেশপ্রেমের ধার ধারে না, জাতীয় ঐক্য বলতেও এদের কিছু নেই। এদেশের নিরক্ষর মানুষের মধ্যে একবার একটি ভ্রান্তবিশ্বাস জন্ম নিলে সেই অপবিশ্বাস সহজে আর অপসৃত হয় না। যারা সাধারণ জনতাকে ক্ষেপিয়ে ফায়দা লুটতে চাইছেন, তারা কি ভেবেছেন, এই জনগণ অতীতে বহুবার তাদেরকেও নাস্তানাবুদ করেছিল?

বাংলাদেশে দুর্নীতি হয় এবং ব্যাপক হারেই হয়। এদেশে কারা দুর্নীতিবাজ জনগণ তা জানে। এদেশের ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতাহীন দুই দলের লোকেরাই দুর্নীতির মূল হোতা। কৃষক শ্রমিকের ঘামে ভেজা টাকা কারা নিয়ে সুইজ ব্যাংকে রাখে? হাওয়া-ভবনে, খোয়াব ভবনে কাদের টাকায় রঙিন জলসার আয়োজন হতো এদেশের মানুষ সে কথাও জানে।

দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট দেশের উত্থান দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। অনেকেই  হিসাব-নিকাশ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো হবে না, তবু এদেশের একদল ষড়যন্ত্রকারী বলছেন, দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। মানুষের মনে অকারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে যারা ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চান, তারা একদিন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। এ দেশের জনগণই এসব দেশদ্রোহীদের সবার আগে শাস্তি দিবে। দুঃসময়ে বিভেদ না বাড়িয়ে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখুন।

বিশ্বের অনেক দেশই দেউলিয়া হয়েছে, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ দেউলিয়া হলেও চিরকালের জন্য বিলীন হবে না। ভস্মস্ত‚পের ভেতর থেকেই আবার জেগে উঠবে লড়াকু বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনা দিয়েছেন মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি। বৈশ্বিক কারণে সাময়িক সময়ের জন্য বাংলাদেশ কিছুটা সংকটের মধ্যে পড়লেও এই সংকট শেখ হাসিনার সরকার সামাল দেবেন বলেই এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে। শেখ হাসিনা তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ে তার নেতৃত্বের সক্ষমতা প্রমাণ করেছেন। পূর্বের যেকোনো সরকারের চেয়েই শেখ হাসিনার সরকার দক্ষ, যোগ্য এবং উন্নয়নমুখী। দৈশিক-বৈশ্বিক কারণে বাংলাদেশের সংকট আরো তীব্রতর হলেও এদেশের মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বিশ্বাস রাখবেন বলে ভাবার অনেক কারণ আছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠী ছাড়া কেউ চায় না, বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে পথে বসে যাক। বাংলাদেশ দেউলিয়া হলে জনগণের কোনো লাভ নেই, লাভ হবে দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোভীদের। সুতরাং সংকটকালে আমরা যদি একটু কৃচ্ছ্রসাধন করে মনোবল ধরে রেখে এগিয়ে যাই, আশা করি যেকোনো বিপদ থেকেই বাংলাদেশ নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। বুক ফুলিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে বাংলাদেশ বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করবেÑ আমরা যারা দেশকে ভালোবাসি তারা সেই প্রত্যাশাই করি।       

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.