নতুন বছর: চ্যালেঞ্জও নতুন

নতুন বছর: চ্যালেঞ্জও নতুন

মোনায়েম সরকার: আরও একটি বছর পার করে ইতোমধ্যে আমরা নতুন বছরে পদার্পণ করেছি। পেছনে তাকালে দেখতে পাই, সবকিছু মিলে আমরা সংকট মোকাবিলা করে সম্ভাবনার দিকেই এগিয়ে চলেছি। বিগত বছরে করোনা মহামারি আমাদের আগের মতো ভোগায়নি, তবে এর রেশ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনা মোকাবিলায় আমরা সাফল্যও কম পাইনি। এক্ষেত্রে নানা ধরনের শঙ্কা ও প্রচারণা মোকাবিলা করে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিকাদানে সরকারের কার্যক্রম গেল বছরেও অব্যাহত ছিল। আন্তর্জাতিকভাবেও এ কাজে সফলতার স্বীকৃতি মিলিছে। গেল বছর বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কাও ছিল। তাতে ফসলহানি হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেই শঙ্কা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন অবনতি হয়নি। হলেও বন্যা মোকাবিলায় আমাদের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, তা দিয়ে নতুন পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে পারতাম। এর মধ্যেই বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু করে দেওয়ার কাজটি সরকার করতে পেরেছে।

এটি আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প। এটি শুধু একটি প্রকল্প নয়, স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আমরা সবাই জানি, কত প্রতিকূলতার মধ্যে সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে এগিয়েছে এবং অবশেষে তা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। বছরের শুরুতে তিক্ত আলোচনা করতে চাই না বলে এখানে আর সে অভিজ্ঞতার পুনরুল্লেখ করছি না। শুধু এটুকু বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মার মতো একটি অবাধ্য নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করেছে এবং তা সম্ভব হতো না পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর সাহস, দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টি না থাকলে। পদ্মা সেতু চালু হয়ে যাওয়ার ফলে শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার জনজীবনে নয়, সারা দেশের অর্থনীতিতেই পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। এ প্রকল্পে রেললাইন সংযোজনের কাজও এগিয়ে চলেছে।

গেল বছর সরকার অবশ্য কিছু অর্থ সংকটে পড়ে। আমাদের মতো দেশের পক্ষে উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সময় অর্থ সংকট দেখা দিতে পারে। রাজস্ব আদায়ে সব সরকারের আমলেই ব্যর্থতা লক্ষ করা গেছে। তবে কোনো সময়েই বিদেশি অর্থ সহায়তা পেতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। কারণ, এ ধরনের ঋণ পরিশোধে আমাদের ব্যর্থতার নজির নেই। বছর শেষে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে কিছু সংকট দেখা দেয় মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে।

জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে, বিশ্ববাজারে খাদ্যের দামও বেড়ে যায় আকস্মিকভাবে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ না হওয়ায়। ইউক্রেন ঘিরে রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাবের পাশাপাশি আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের উসকানিও এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। এর মূল্য দিতে শুরু করেছে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো। বিগত বছরে আমাদের অর্থনীতি ও জনজীবনে যে সংকট দেখা দেয়, তার জন্য দেশের বাইরের ঘটনাগুলোই বেশি দায়ী। এর মধ্যেও সরকার চেষ্টা করছে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। বছরের শেষদিকে এখানে যে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছিল, সেটিও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে সরকার। বিদ্যুতের বেড়ে চলা চাহিদা পূরণে সরকার কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে উত্তরণের দিকে যেতে থাকার সময় কেন এমন সংকট দেখা দিল, তা অবশ্য অনুসন্ধানের বিষয়। বিদ্যুৎ খাতে অপচয়-দুর্নীতির কথা অনেকে বলে থাকেন এবং গেল বছর এ সমালোচনা আরও বেড়েছিল স্বভাবতই। বেসরকারি খাতের সঙ্গে অনেক আগে করা চুক্তিগুলো নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয় সরকারকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেই তার জবাব দিতে হবে। মানুষ সরকারের গৃহীত উদ্যোগের সুফল পেলে বিগত দিনের ক্ষতির কথাও ভুলে যায়, এটি অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে। নতুন বছরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া ও অন্যান্য উদ্যোগ সফল করতে পারলে এ খাতে অবশ্যই আস্থা ফিরে আসবে। গেল বছরটি সরকার অবশ্য শেষ করেছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণকাজ এগিয়ে নিয়ে এবং রাজধানীতে বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল উদ্বোধন করে। উপমহাদেশে টানেলের অভিজ্ঞতা এই প্রথম হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে এবং মেট্রোরেলও এ সরকারের মাধ্যমেই জনগণের একটি অর্জন। সড়ক যোগাযোগ সহজ করার মাধ্যমে জনজীবনে গতি সঞ্চারের চেষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার করে যাচ্ছে দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই। গেল বছরে এক্ষেত্রে অর্জনগুলো দৃশ্যমান হয়েছে কেবল।

নতুন যে বছর এসেছে, তার পরের বছরের শুরুতেই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তার আগে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম আরও দৃশ্যমান হবে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সে নির্বাচন সফলভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে। গেল বছরের শেষদিকে দলের কাউন্সিল সম্পন্ন করা এরই অংশ। এতে পুরোনো নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখেছেন সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ নেতৃত্বকেই আগামী নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। গেল বছরের মধ্যভাগ থেকে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো আবার রাজনীতির মাঠ গরম করতেও তৎপর হয়ে উঠেছে। বিএনপির সঙ্গে তার সবসময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামীসহ মৌলবাদী দলগুলো রয়েছে-প্রকাশ্যে ততটা না হলেও কৌশলে। দলটির সঙ্গে নতুন করে যোগ দিয়েছে সাবেক বাম, মধ্যবাম কিছু গ্রুপ। অনলাইনে দেশে-বিদেশে সক্রিয় একটি গোষ্ঠীও সরকারের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছে। সমালোচনায় কারও আপত্তি হওয়ার কথা নয়, তবে অপপ্রচারে আপত্তি রয়েছে। গেল বছর আমরা লক্ষ করেছি, জনজীবনে সৃষ্টি হওয়া কিছু সমস্যা নিয়ে দেশে যেমন বিরোধী দলগুলো সক্রিয় হয়ে উঠতে চেয়েছে, তেমনি অনলাইনে সক্রিয় একটি গোষ্ঠী মেতে উঠেছে অপপ্রচারে। রিজার্ভ পরিস্থিতি ও ব্যাংক খাতের কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিয়ে তারা এত অপপ্রচার চালায়, যা মোকাবিলা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।

দেশ অচিরেই শ্রীলংকা হয়ে যাবে বলে প্রচারণা চালিয়ে অবশ্য কোনো সুফল তারা পায়নি। দেশ শ্রীলংকা হয়নি, বরং এরই মধ্যে আইএমএফের একটি মিশন এসে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্ত হয়ে বড় অঙ্কের ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। এটি বিদ্যমান সংকটে যত না, তার চেয়ে বেশি সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় আমাদের সহায়তা করবে। তবে একথা ঠিক, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কোনো কোনো ব্যাংকে সংকট তৈরি করছে এবং তারা দেশ থেকে অর্থ পাচারেও জড়িত। এদের দমনে প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগী হতে হবে। নতুন বছরে যত দ্রুত এ পদক্ষেপ নেওয়া হবে, ততই আস্থা ফিরে আসবে মানুষের মনে। এর প্রভাব বিরোধী দলের আন্দোলন রচনার মধ্যেও গিয়ে পড়বে। তাদের আন্দোলনের সুযোগ আসে প্রধানত সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা থেকে এবং বাংলাদেশ ঘিরে তৎপর প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে। গেল বছর শেষে আমরা একটি প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতের অতি তৎপরতা দেখে চিন্তিত হয়েছি। এর প্রতিক্রিয়ায় আবার একটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের তৎপরতাও দেখতে পেয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকারের মতো বিষয়ে বাইরের কোনো দেশের রীতিবিরুদ্ধ কথাবার্তা ও কার্যকলাপ বাংলাদেশ পছন্দ করে না। তাদের কূটনৈতিক রীতিনীতি মান্য করে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরকে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও সতর্ক থাকতে হবে। অনেকে মনে করেন, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো পরস্পরের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের একটি ক্ষেত্র করে তুলতে চায় বাংলাদেশকে। বলাই বাহুল্য, দীর্ঘদিন ধরে সচেষ্ট থেকেও কার্যকর আন্দোলন রচনায় ব্যর্থ বিরোধী দল এর সুযোগ নিতে চাইবে। নতুন বছরে সে বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে সরকারকে। এটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের জন্যও একটি পরীক্ষা। সামনে তাদের কেবল নির্বাচন নয়, সম্ভাব্য আন্দোলনও মোকাবিলা করতে হবে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর কোনো জনসমর্থন নেই, তা নয়। আওয়ামী লীগ নজিরবিহীনভাবে টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকায় তার জন্য কিছু জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং সেটা স্বাভাবিকও বৈকি। সম্প্রতি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হয়তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা; কিন্তু সতর্ক সংকেতও। ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে আবার পাঁচটির মধ্যে চারটিতে জিতেছে আওয়ামী লীগ।

প্রধানমন্ত্রীসহ দলের প্রথম সারির নেতারা প্রকাশ্যে একাধিকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন আগেকার মতো সহজ হবে না। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকালে যে ধরনের সরকারের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে, তেমন ব্যবস্থা না হলেও আগামীতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনের দাবি আন্তর্জাতিকভাবেও জোরালো হয়ে উঠছে। সরকারও চায় সবার অংশগ্রহণে একটি অর্থবহ নির্বাচন। সে নির্বাচনে জয়ী হয়ে উন্নয়নের চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ করার উচ্চাভিলাষের কথা সামনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটি অর্জনের জন্য স্মার্ট সরকার ও প্রশাসন প্রয়োজন হবে এবং দলকেও সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নে নিয়োজিত থাকলে চলবে না; জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ ও তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে হবে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে।

সংগঠনকে সচল করাসহ রাজনৈতিক কর্মসূচিভিত্তিক কাজ বাড়াতে হবে তৃণমূল পর্যন্ত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে জনগণ কেন ভোট দিয়ে আরেক দফায় ক্ষমতায় আনবে, তা স্পষ্ট করতে হবে শুধু কথায় নয়-কাজে। বিরোধী দল তাদের মনমতো নির্বাচনের দাবিতে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইলে সেটা যেমন হতে দেওয়া যাবে না, তেমনি তাদের সমালোচনা ও অপপ্রচারের যুক্তিপূর্ণ জবাব দিতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন ও সুশাসন নিশ্চিত করে জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে জনকল্যাণের বিষয়ে। অর্থনীতিতে যেসব সংকট রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলার পদক্ষেপও আরও জোরালো করা চাই। বেকারত্ব হ্রাস ও আয়-বৈষম্য কমিয়ে আনা গেলে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসতে সময় লাগবে না। তাতে সরকারের ওপর আস্থাও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত আরও শক্তিশালী হবে এতে।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক ও লেখক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.