প্রবাহিকা : প্রবহমান জীবনের আলেখ্য

প্রবাহিকা : প্রবহমান জীবনের আলেখ্য

মোনায়েম সরকার: মানুষের জীবন পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা রহস্যময় বিষয়। জীবনের রহস্য এখন পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি, জীববিজ্ঞান এ বিষয়ে হয়তো কিছু সামান্য তথ্য হাজির করতে পেরেছে, কিন্তু মনোবিজ্ঞান এখনো জীবনরহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেনি, ভবিষ্যতে পারবে বলেও মনে হয় না। যদিও অনাগত অনিশ্চিত, তবু বলব পাঁচশ কোটি বছর আয়ু হলো যেই পৃথিবীর, সেই পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে এখনো বেশি কিছু জানা গেল না এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে।

একেক জন মানুষের জীবন ধারা একেক রকম। প্রতিটি মানুষের জীবনই যেন এক একটি গ্রন্থ। মানবগ্রন্থ পাঠ করলে দেখা যায়- বিচিত্র ঘটনা নিয়ে প্রতিদিনই আমাদের পৃথিবী আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছে। জীবনের এত রঙ, এত রূপ, এত আনন্দ-বেদনা, উত্থান-পতন আসলেই রোমাঞ্চকর। সারা বিশ্বেই এখন কোভিড-১৯ মৃত্যুর জাল ফেলে বসে আছে। মৃত্যুর অনামিশায় ঢেকে গেছে আমাদের পরিচিত পৃথিবী। যদিও আমরা কেউ এমন পৃথিবীর স্বপ্ন কখনো ভুল করেও দেখিনি- অথচ আজ আমাদের সবাইকে এমন একটি মৃত্যুময় পৃথিবীতেই নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর লড়াই করে যেতে হচ্ছে।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সবার মতো আমিও ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছি। লেখালেখি, বইপড়া, টিভি দেখা, পত্র-পত্রিকার পাতায় চোখ রাখা ছাড়া এ সময়ে আমার তেমন কোনো কাজ নেই। অবশ্য কাজ আমার লকডাইনের আগেও যে খুব একটি ছিল এমনটা বলা ঠিক হবে না, তবে লকডাউন-পূর্ব দিনগুলো আড্ডায়-আনন্দে ভরপুর ছিল, এখন ওসব নেই বলে মনটা হাহাকার করে ওঠে।

বন্ধুপ্রতিম প্রশান্ত কুমার লাহিড়ী একজন সুলেখক। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। বয়স আশি-ঊর্ধ্ব। সপরিবারে বসবাস করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে যদিও তিনি জীবন-জীবিকার জন্য পড়ে আছেন, কিন্তু মন তার ঘুরে বেড়ায় কলকাতার অলি-গলিতে। তার লেখার শব্দে শব্দে আছে কলকাতার অনাবিল দৃশ্যপট। দিল্লি, লখনৌসহ অনেক শহরের মনোরম বর্ণনা আছে প্রশান্ত লাহিড়ীর সজীব লেখায়। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘ফিরে আসি দুয়ারে তোমার’ (কবিতা), ‘প্রবাদ সংকলন’, ‘পৃথিবীর এক ঝলক’ (ভ্রমণ কাহিনী)’, ‘মানুষের রং’ (একগুচ্ছ বিদেশি নাটক), ‘ইন্দ্রধনুষ (প্রবন্ধ)’, আমি পড়েছি। পড়ে ভীষণভাবে আবেগতাড়িত হয়েছি।

এবার সারা বিশ্ব যখন লকডাইনে বন্দি, তখন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনমূলক গ্রন্থ ‘প্রবাহিকা’ অবশ্য লকডাউনের মধ্যে আমারও একটি কবিতার বই প্রকাশ হওয়ার কথা। ঘরে বসে বসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইটি পড়লাম। পড়ে মনে হলো আশ্চর্য একটি বই পড়লাম। ‘প্রবাহিকা’ বইটিতে ছয়টি অধ্যায় আছে। প্রতিটি অধ্যায়ের বিভাজন বইটিকে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম- ‘ছেলেবেলা : সেই পুরোনো কলকাতা’। এই অধ্যায়টি পড়ে আমি যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কলকাতাকে আবার নতুন করে অনুভব করলাম। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি কলকাতাতেই ছিলাম। কলকাতার অলি-গলিতে বহুদিন আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। কত অচেনা মানুষ তখন আপন হয়ে উঠেছিল। কত ঘর সেদিন নিজের ঘর বলে ভেবেছি তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। পঁচাত্তরের নির্মম ট্র্যাজেডির পরেও কলকাতায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলাম তিন বছর। সেই তিন বছরের স্মৃতিও আমার জীবনের অমূল্য সঞ্চয়। এখনো চোখ বুজলে আমি আমার সেই ফেলে আসা দিনগুলো অনুভব করতে পারি।

প্রশান্ত লাহিড়ীর জন্ম ১৯৩৭ সালে জামসেদপুরে। তার জন্মের দশ বছর পরে পরাধীন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। লেখক যখন ছোট ছিলেন তখন তার ছেলেবেলায় তিনি কি কি করেছেন আর কি কি দেখেছেন সেগুলোর প্রাণবন্তু বর্ণনা দিয়েছেন ‘প্রবাহিকা’ গ্রন্থে। তার জন্ম সম্পর্কে তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন গ্রন্থে তা থেকে একটু উল্লেখ করি- ‘আমার জন্ম হয় ভারতের তথাকথিত ‘স্টিলটাউন’- জামসেদপুরে। শুনেছি যেদিন আমার জন্ম হয় সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল আর বাড়ির রাঁধুনে ঠাকুর নাকি স্বপ্ন দেখেছিল যে বাড়িতে ছেলে হবে, হলোও তাই। আমার জন্ম হয়েছিল টাটা কোম্পানির বাড়ির রান্নাঘরে। তবে কোনোদিনই সেটা রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার হয়নি। শুধু নামটা রয়ে গেল কোম্পানির রান্নাঘর হিসেবে। এই ঘরেই জন্মেছিল আমার ছোট মাসি, আমার দাদা, আর আমাদের প্রত্যেককেই পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছিল সেই একই ‘দাই-মা’।’

প্রশান্ত লাহিড়ীর লেখায় সরলতা উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। তিনি যখন কোনো ঘটনার বর্ণনা দেন, তখন অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই সেগুলোকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার প্রয়াস দেখান। উত্তর কলকাতার জীবনযাপনের ছবি তার লেখায় একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উত্তর কলকাতার ‘রক’ কালচার সম্পর্কে আমরা অনেকেই কমবেশি জানি। এই ‘রক’ জিনিসটার প্রকৃত পরিচয়ও পাওয়া যায় ‘প্রবাহিকা’ গ্রন্থ থেকে। ‘রক’ প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন, ‘প্রায় বেশিরভাগ বড় রকমের বাড়ির সামনেই ছিল বাড়ি সংলগ্ন ‘রক’। এই রক জিনিসটা বোধহয় তখন নর্থ-ক্যালকাটার বিশেষত্ব ছিল। এইগুলো ছিল বাড়ির প্রধান দরকার পাশেই খোলা বারান্দার মতো। এর উপরেই দেখা দিত দিনের এক রূপ আর সন্ধ্যের পরে আরেক রূপ। দিনের বেলা এসে বিশ্রাম নিত শ্রান্ত ফেরিওয়ালা, ক্লান্ত ভিখারি, দুপুরে কাজের শেষে একটু বিশ্রামের জন্য আশেপাশে বাড়ির চাকর-বাকর। আবার এখানেই দেখেছি ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে পীড়িত অন্নাভাবে ক্লিষ্ট জরাজীর্ণ চেহারার মা কী করুণ কণ্ঠে মিনতি করে ডাকছে ‘মা, এড্ডু ফ্যান দ্যান’। এই রকেই দেখেছিলাম এই দুর্ভিক্ষে মা কোলে ছেলে নিয়ে মরে পড়ে আছে।’ শুধু দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা প্রবাহ উল্লেখ করেই লেখক ক্ষান্ত হননি। পরাধীন ভারতবর্ষে কারণে-অকারণে যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো, তাও তিনি দরদি মন নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সেসময় কী পরিমাণ প্রাণ হানি ঘটিয়েছে সেসবের তথ্যও তিনি যথাসম্ভব উল্লেখ করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার একটি ছোট্ট বিবরণ না দিলেই নয়Ñ ‘শুনলাম পাড়ার মোড়ে নাকি ঠেলাগাড়ি তার দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ধোপা পট্টির সামনে। বড়দের মধ্যে সব গ্রুপ করে সারারাত টহল দেবে। আর সব বাড়ির মেইন দরজায় যেন খিল ঠিক করে দেয় আর অস্ত্র-শস্ত্রের মধ্যে লাঠি (তাও সবার বাড়িতে কই, যেমন আমাদের বাড়ি), দা, বড় বঁটি, কুড়ালÑ এ সবের ব্যবস্থা হলো। তারপর সন্ধ্যে হতেই ছাদে গিয়ে দেখি অবশ্য জানালা দিয়েও দেখছিলাম চারদিকের দিগন্তের কালো ধোঁওয়া আর আগুনের শিখা, তখন দূর থেকে আওয়াজ আসছে ‘বন্দে মাতরাম’ আর ‘আল্লাহু আকবর’। এখন বুঝলাম হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুসলমানরা হিন্দুদের মারছে আর হিন্দুরা মুসলমানকে।’

স্বাধীনতাপূর্ব ভারতের যারা শক্তিমান নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সে সময় মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীও অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। প্রশান্ত লাহিড়ীদের বাড়ির পাশের বিবেকানন্দ রোডে একবার মহাত্মা গান্ধী এসেছিলেন চাঁদা তুলতে। লেখকের বর্ণনায় সেই ঘটনাটা একটু শোনা যাক- ‘খানিকক্ষণ পরে গান্ধীজি এসে সেই মঞ্চে চড়লেন। মনে আছে, খালি গায়ে একটা চাদর জড়ানো। একটা হেঁটো ধুতি পরা। হাতে একটা লম্বা লাঠি ঠিক যেমনটি কাগজে ছবি দেখতাম। সঙ্গে ছিলেন সুরাবর্দি (কিছু ম্যাগাজিনে তাঁকে বলত ছোরাবুদ্ধি)। কেউ কোনো লেকচার দিল না। গান্ধীজি একটা টাকার থলে নিয়ে একটা বড় রকমের নমস্কার ঠুকে নেমে গেলেন, বড়রা তাতেই কী খুশি। কেউ কেউ যেন তাঁকে নিজেদের পাড়ায় দেখে ধন্য হয়ে গেছেন।’

প্রশান্ত লাহিড়ী ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন না। মধ্যবিত্ত একটি পরিবারেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তার বেড়ে ওঠার মধ্যে একটা সংগ্রাম ছিল। ত্যাগ ছিল, পরিশ্রম ছিল। আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে তিনি কোনো কিছু আড়াল করেননি, কোনো কিছু বাড়িয়ে বলে নিজের অহংকার প্রকাশ করেননি। ‘প্রবাহিকা’ গ্রন্থের পরতে পরতে আছে পরাধীন ও স্বাধীন ভারতের কথা, আছে লেখকের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের উপাখ্যান। প্রশান্ত লাহিড়ীর আত্মজীবনীমূলক এই লেখাটার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটা কারো ব্যক্তিগত কথা না হয়ে প্রত্যেকটি সংগ্রামী মানুষের কথা হয়ে উঠেছে। লকডাউনের মধ্যে এমন একটি সুলিখিত সরস গ্রন্থ পাঠ করে সীমাহীন আনন্দ পেয়েছি। যেমন আনন্দ পেয়েছিলাম তাঁরই লেখা ‘পৃথিবীর এক ঝলক’ ভ্রমণকাহিনী পড়ে।       

৩০ জুন, ২০২০

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.