মোনায়েম সরকার: ভাষার উৎপত্তি কেমন করে হলো তার কোনো সঠিক ইতিহাস নেই। যে যেভাবে পেরেছে সে সেভাবেই একটা যৌক্তিক অনুমানের ভিত্তি থেকে ভাষার উৎপত্তি নির্ণয়ের চেষ্টা করেছে। পৃথিবীর ধর্মগ্রন্থগুলো দাবি করে ভাষার সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। কথাটা এক অর্থে সত্য হলেও বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণে এ কথা খুব একটা খাটে না। বরং ভাষা সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মাধ্যমে এই মতের পক্ষেই ভাষাবিদদের জোর সমর্থন মেলে।
পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, যেই মানুষের কোনো ভাষা নেই বা ভাষা ব্যবহার করে না। আধুনিক কালের ভাষা বিজ্ঞানীরা বলার চেষ্টা করেছেন যে মূলভাষা থেকে পৃথিবীর ভাষাগুলো সৃষ্টি হয়েছে তার নাম ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ মূলভাষা। খ্রিস্টপূর্ব আড়ার হাজার বছর পূর্বে মধ্য-এশিয়ায় একদল লোক বসবাস করত। এই লোকগুলো প্রথম যে ভাষা ব্যবহার করত সেই ভাষাই ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ মূলভাষা। এই মূল ভাষা থেকেই বিভিন্ন বাঁক পেরিয়ে জন্ম নিয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা, ‘বাংলা ভাষা’।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৬ হাজারের মতো ভাষা আছে। এই ছয় হাজার ভাষার মধ্যে এমন ভাষা আছে প্রায় পঞ্চাশের অধিক যে ভাষায় মাত্র একজন লোক কথা বলে। কোনো কোনো ভাষায় কথা বলে মাত্র ১০০ জন মানুষ। প্রায় দেড় হাজার ভাষা এখন চালু আছে যে দেড় হাজার ভাষায় কথা বলে ১০০০ জনেরও কম মানুষ। বর্তমান পৃথিবীতে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো যে ভাষায় ৩০ কোটি মানুষ তাদের ভাব বিনিময় করে সেই ভাষাকেই একদিন হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তার চেয়েও আশ্চর্য বিষয় হলো, যেই বাংলা ভাষাকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, সেই বাংলা ভাষা তো বেঁচে রইলই পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন-একটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিল এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার গৌরব অর্জন করল।
বাংলা ভাষার আন্দোলন দুই পর্যায়ে হয়েছিল। প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একবছর পর। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, তারা ভাষার জন্য জীবন দিতেও পিছপা হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে অত বড় আন্দোলন বাঙালি জাতি ছাড়া আর কোনো জাতি করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটন এর প্রস্তাবিত ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রকাশ করা হলে ঠিক তার অব্যবহিত পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মদ দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদ রাজ্যের সেকেন্দ্রবাদ শহরে আয়োজিত এক উর্দু সম্মেলনে এই মর্মে ভাষণ দেন যে, প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ‘একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা’। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে কলকাতা থেকে লিখিত প্রতিবাদ পেশ করেন ভাষাবিদ ও জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুুল্লাহ। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুুল্লাহর এই জ্ঞানগর্ভ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
এই নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’। এই নিবন্ধেই প্রথম বলা হয়, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী। এরপরে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ যখন করাচিতে গণপরিষদে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ মর্মে প্রস্তাব পাশ করা হয় তখন কুমিুল্লার অকুতোভয় রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সোচ্চার কণ্ঠে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার ইতিহাসে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম অমর হয়ে থাকবে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে এদেশের ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। পাকিস্তানি জুলুমবাজ সরকার রাষ্ট্র ভাষার এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য নির্বিচারে গুলি চালায় নিরীহ বাঙালি জাতির উপর। বাঙালির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে যায়। শহিদ হয় আবুল বরকত, জব্বার, রফিক উদ্দিন, সালাম ও আরো কয়েকজন, আহত হয় প্রায় শতাধিক ভাষাসৈনিক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চাকরিরত ছিলেন ইংরেজ চিকিৎসক এলিংসন। এলিংসন সেদিন আহত ভাষাযোদ্ধাদের যেভাবে পরম যতেœ অপারেশন করেছেন তা চিরদিন বাঙালি জাতির মনে থাকবে। কেউ কেউ মনে করেন ডাক্তার এলিংসন না থাকলে সেদিন নিহতের সংখ্যা আরো বেড়ে যেত।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর ঢাকা নগরী এক ভয়াল রূপ ধারণ করে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্ররা মাইক লাগিয়ে বক্তৃতা শুরু করে এবং ছাত্রদের সমর্থনে মহুল্লার অধিবাসীরা দলে দলে এগিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি অফিস-আদালত থেকে শুরু করে দোকানপাট-যানবাহন চলাচল সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ এগিয়ে আসে হাসপাতালের দিকে। হাসপাতালে আগত সব মানুষের মুখে তখন শোকের কালো ছায়া, সবার চোখেই ক্রোধের আগুন।
২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে যারা শহিদ হয়েছিল তাদের লাশ রাখা হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। কথা ছিল এই লাশ নিয়ে পরদিন শোক মিছিল বের করা হবে। কিন্তু রাত আনুমানিক দুই-আড়াইটার সময় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী একদল পাঞ্জাবি সৈন্যের সাহায্যে হাসপাতাল ঘেরাও করে। শেষ পর্যন্ত সৈন্যরা জোর করেই হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশগুলো নিয়ে যায়। তখন কারফিউ চলছিল। সেই কারফিউয়ের মধ্যেই দুইজন ছাত্র সৈন্যদের পিছু নেয়। শুধু তাই নয় সৈন্যরা লাশগুলো আজিমপুর কবরস্থানে কবর দিয়ে চলে যাওয়ার পর এই দুইজন ছাত্রই ভাষা শহিদদের কবর শনাক্ত করে আসে। সেদিন যদি ওই দুই ছাত্র ভাষা শহিদদের কবর শনাক্ত করে না আসতো আজ আমরা প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহিদদের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম কিনা কে জানে।
২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণের খবর শুনে সেদিন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন তিনি হচ্ছেন তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব বাংলার প্রথম উপ-নির্বাচনে (টাঙ্গাইল) বিজয়ী নেতা জনাব শামছুল হক। একদিকে শামছুল হক সাহেব হতাহত ছাত্র-জনতাকে দেখতে হাসপাতালে যান, অন্যদিকে সশস্ত্র পাহারায় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ঢাকা বেতর থেকে অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় লড়াকু ছাত্র সমাজকে তিরস্কার করেন। নূরুল আমিনের বক্তৃতা থেকেই মুসলিম লীগের ফ্যাসিস্ট চেহারা বাঙালির কাছে ধরা পড়ে যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত হত্যাকা-ের পর পাকিস্তানি সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। অতঃপর ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সরকার বাংলাকে অন্যতর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
১৯৬৪ সালে আমরা পূর্ব পাকিস্তান বাংলা প্রচলন সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি। ড. মাহফুজুল বারী সভাপতি, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কোষাধ্যক্ষ, সাধারণ সম্পাদক ফকির আশরাফের অনুপস্থিতিতে আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। আমরা মাতৃভাষা নামে একটি সংকলন বের করি এবং একটা পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করি, যার বক্তব্য ছিল, ‘বাংলা বলুন, বাংলা লিখুন, অন্যকেও বাংলা বলতে সাহায্য করুন, অন্যতর রাষ্ট্রভাষা বাংলার পূর্ণ মর্যাদা দিন, শহীদের রক্তদান স্বার্থক করে তুলুন।’ আমরাই প্রথম শুধু বাংলা বইয়ের মেলা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ১৯৭০ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের রেওয়াজ প্রচলন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর আমরা খালি পায়ে প্রভাত-ফেরি করি ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা পর্যন্ত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ অমর একুশের গান গেয়ে। যার রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। আজ এ অমর একুশের গান গাওয়া হয় ১৮৮ দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)-র সাধারণ পরিষদ তার ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থনে সর্বসম্মতভাবে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয়, ‘১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্যে বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এই দিনের শহিদদের স্মৃতিকে সারাবিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হবে।’ ইউনেস্কোর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী প্রথম পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।’
একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দী এবং ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলেই একুশে ফেব্রুয়ারি লাভ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অসামান্য গৌরব। শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার এই কৃতিত্ব বাঙালি জাতি কোনোদিনই ভুলতে পারবে না।
বাংলা ভাষা আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতি মৃত্যুর ভয়কে জয় করে ফেলে। ভাষা আন্দোলনের সাহস থেকে বাঙালি জাতি সোচ্চার হয়ে ওঠে জঙ্গি পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে। তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ সাহসী বাঙালিরা। বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তাই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার ইতিহাসও বটে।
৩১ জানুয়ারি, ২০১৮