বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ ও বাঙালিসত্তাই আমাদের অহঙ্কার

বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ ও বাঙালিসত্তাই আমাদের অহঙ্কার

মোনায়েম সরকার: ১৪২৫ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভার আয়োজন করা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। এর কারণ কোটা-বিরোধী আন্দোলনের সময় কতিপয় দুষ্কৃতি চারুকলায় প্রবেশ করে সব কিছু তছনছ করে দেয়। কিন্তু চারুকলার সাহসী ও পরিশ্রমী নবীনেরা রাতদিন পরিশ্রম করে ঠিকই পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রার আয়োজন করতে সক্ষম হয়। তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে যেকোনো বিপর্যয়ের মধ্যেও বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি রাখে। বাংলাদেশের শক্তি-সামর্থ্য এখন মোটেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এদেশে যখন ঋতু বদল হয় তখন প্রকৃতিতে লাগে রঙের ছোঁয়া। এক এক ঋতুতে বাংলার প্রকৃতি এক একভাবে সাজে। গ্রীষ্মের যে রূপ, বর্ষায় আমরা সেই রূপ দেখি না। আবার শরতের সঙ্গে হেমন্তের আছে সুস্পষ্ট পার্থক্য। তেমনি শীত আর বসন্তেরও আছে ভিন্ন রূপ, ভিন্ন সৌন্দর্য। বাংলার রূপবৈচিত্র্য বাংলার মানুষকে শুধু ভাবুক আর ঘরছাড়াই করেনি, কর্মী হতেও প্রেরণা জুগিয়েছে। প্রাচীনকালের ইতিহাসে তো বটেই আধুনিক কালের ইতিহাসেও তার ভূরি ভূরি নজির মেলে।

বাংলাদেশের রূপের মতো বাঙালি জাতি সত্তাও নানান রঙে রঙিন। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস মূলত সে কথাই বলে। এখানে আর্য-অনার্যের রক্ত যেমন একই ধমনীতে প্রবাহিত, তেমনি ধর্মীয় সংস্কারের বেলায়ও আছে বৈচিত্র্যের স্পষ্ট চিহ্ন। বঙ্গভূমিতে বসবাসকারী সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মগ-বা ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক-বাহক হলেও তারা বঙ্গসন্তানই। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বলে তারা পর নয়Ñ তারাও আমাদের স্বজন। কিন্তু এত ভিন্নতার পরেও আমরা সবাই বাঙালি, এটাই আমাদের সব থেকে বড় ও সত্য পরিচয়। এই পরিচয় যদি আমরা ভুলতে চেষ্টা করি, তাহলে আমরা কেবল আত্মবিস্মতই হবো না, জাতি হিসেবে আমরা রসাতলে যাবো। বাঙালি সত্তাই বাঙালির অহঙ্কার, উন্নতির প্রথম সোপান। আমরা যখনই আমাদের জাতি সত্তা বিসর্জন দিয়েছি তখনি আমরা ভিনদেশি শাসকের দাসে পরিণত হয়েছি, অতীতে আমাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হবে। অতীতের শিক্ষা বিস্মৃত হলেই জাতি দিকভ্রান্ত হয়। তখন সেই জাতিকে ঘিরে ধরে কুসংস্কার আর নানাবিধ অনাচার।

বাংলাদেশের রূপ যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি বাঙালির সংস্কৃতিও বহু বর্ণে বর্ণিল। বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে পৃথিবীর কোনো জাতির সংস্কৃতিই তুলনীয় নয়। বাঙালি সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান হলো সঙ্গীত। সঙ্গীত বাঙালির আনন্দ-বেদনা-বিরহ সবকিছুকেই প্রকাশ করে। বাঙালির সঙ্গীত বিচিত্র সুরের ধারায় সমৃদ্ধ। এর প্রমাণ আছে প্রাচীন চর্যাপদে এবং আধুনিক কালের রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ পঞ্চকবির গীতি ধারায়। বঙ্গভূমি শুধু ছয় রাগ আর ছত্রিশ রাগিনীরই উৎস ভূমি নয়, এ মাটির পরতে পরতে মিশে আছে রাগ-রাগিনীর খেলা। চর্যাপদের কবিগণ চর্যাপদের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে গেঁথে দিয়েছেন রাগ-রাগিনীর সুর মূর্ছনা। তেমনি মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও পাই সঙ্গীতের অপূর্ব স্বাদ। আরাকানের রাজসভায় বসে যেসব বাঙালি কবি তাদের রোম্যান্টিক প্রণয় উপাখ্যান রচনা করেছিলেন, সে সব কাব্যেও পাওয়া যায় সঙ্গীতের সুরধ্বনি। বিশেষ করে আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যে সঙ্গীত বিষয়ক যে পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে তা থেকে সঙ্গীত পাগল বাঙালি মনের একটা অন্যরকম ধারণা লাভ করা যায়। এমন কি মধ্যযুগের পদাবলিতেও সঙ্গীতের লহরী আমাদের মনকে দোলা দিয়ে যায়।

বাঙালির জীবন যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি তার সঙ্গীতও বৈচিত্র্যে ভরপুর। বাঙালির সঙ্গীতে শুধু রাগ-রাগিনীর সুর-বিস্তার, তাল-লয়ের নিখুঁত হিসাব, গমক, মীড় মূর্ছনা আর তেহাইয়ের কারুকার্যই নয়, এর মধ্যে আছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরার প্রয়াস। বাংলার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খ্যাতিমান পুরুষ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ সাহেবরা। এদের সঙ্গে জমিদার তনয় শচীন দেব বর্মনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে।

বাঙালির কীর্তন, পাঁচালী, পদাবলি ও পালাগান অতুলনীয়। নিধুবাবুর টপ্পায় একদিন বাঙালি শুধু প্রণয়ের আর রসের কথাই শ্রবণ করেনি, স্বদেশ ও স্বভাষার মহিমার কথাও কান পেতে শ্রবণ করেছে। নিধুবাবুর পরে অন্য যে টপ্পাকার সুনাম কুড়িয়েছেন তার নাম শ্রীধর কথক। কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ ওস্তাদী গানের রাগ-রাগিনী অমান্য করে যে নিজস্ব ধারা প্রবর্তন করেন তার নাম ‘রামপ্রসাদী সুর’। আজ পর্যন্ত বহু শ্যামা সঙ্গীত ও স্বদেশী সঙ্গীত রামপ্রসাদী সুরে গাওয়া হচ্ছে। শুধু রামপ্রসাদের মধ্যেই রামপ্রসাদী ধারা সীমাবদ্ধ থাকেনি, মুকুন্দ দাস, আজু গোঁসাই, রাম দুলাল এরাও রামপ্রসাদের অনুকরণে অনেক রকমের গান লিখেছেন।

বাংলা ও বাঙালির পরতে পরতে বৈচিত্র্য। এর অভিজাত শ্রেণির জন্য যেমন পৃথক অন্ন আছে, তেমনি সাধারণের জন্যও আছে ভিন্ন ধাঁচের, ভিন্ন মেজাজের দ্রব্যসামগ্রী। বাঙালির মধ্যে যারা প-িত বলে স্বীকৃত তারা যেমন সৃষ্টিশীল, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও সৃজনশীলতার নমুনা দুর্লক্ষ্য নয়। বাংলার লালন ফকির-গগন হরকরা-পাঞ্জু শাহ-দুদ্দু শাহ-হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম-রা বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রবাদপ্রতিম পুরুষ ও শক্তিমান মরমিসাধক। এদের রচিত বাউল, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব গান পৃথিবীর যেকোনো দেশের লোক সাহিত্যের চেয়ে উন্নত ও ভাবসমৃদ্ধ। সাধারণ কৃষক বা নিরক্ষর বাউল-ফকিরের রচিত বলে এসব ভাবপ্রধান বা ভক্তিপ্রধান গানগুলোকে অসম্মান করে দূরে রাখার কোনোই সুযোগ নেই। বাঙালির সঙ্গীত বিশ্লেষণ করলে বাঙালির পুরো মানসিকতার একটা চিত্র পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে বাংলার কবিগানের বিষয়, ছন্দ ও গায়কীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাঙালির তার্কিকতার নিটোল পরিচয় পাওয়া যায় কবিগানের মধ্যে। হরু ঠাকুর, রাম বসু, রঘুনাথ বাংলার দিকপাল কবিয়াল। এ ছাড়া লালু নন্দলাল, কেষ্টা মুচি, ভোলা ময়রা, নীলু ঠাকুর, যজ্ঞেশ্বরী, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, নীলমনি পাটনী, ভবানী বেনে প্রমুখ কবিয়ালের নামও বাঙালির হৃদয় পটে লেখা আছে। বাঙলা ও বাঙালির শক্তিকে বুঝতে হলে বাঙালির সঙ্গীত বিশ্লেষণ করলেই অনেকটা বুঝা যেতে পারে। বাঙালির সঙ্গীত বৈচিত্র্যময় তার কারণ বাংলার প্রকৃতিই বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাঙালির সঙ্গীত শাস্ত্রানুগত আবার একই সাথে নিয়ম-শৃঙ্খলাহীন, এতেও বাঙালির মানসিকতার পরিচয় পরিস্ফুট।

রঙে, রূপে, সুরে, হৃদয়ে, পৃথিবীর আর কোনো দেশ, আর কোনো জাতিই আমাদের সমকক্ষ বা সমগোত্রীয় নয়। আমরা পৃথিবীতে অনন্য ও অতুলনীয় এই কথাটা মনে রাখলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের পদানত ও পরাজিত করতে পারবে না। বাঙালি জাতি আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে, আজ বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই আজ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি রোল মডেল, কিভাবে এটা সম্ভব হলো? সম্ভব হলো এই কারণে যে, ‘বাংলার মাটি নিত্য উর্বর। এই মাটিতে নিত্য সোনা ফলে। এত ধান আর কেন দেশে ফলে না। পাট শুধু একা বাংলার, পৃথিবীর আর কোনো দেশে পাট উৎপন্ন হয় না। এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তাবোধ পৃথিবীর আর কোথাও নেই (বাঙালির বাংলা : কাজী নজরুল ইসলাম)।’ বাংলাদেশ মমতাময়ী, সুন্দর ও পবিত্র। এই সুন্দর স্বদেশকে বিনির্মাণের ক্ষেত্রে দল-মত-জাতি-বর্ণ-ধর্ম- সব কিছু ভুলে একযোগে কাজ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি আমরা ঐক্যের অদৃশ্য সুতোয় সবাই গ্রথিত হবো তত তাড়াতাড়িই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।

১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলাম তাদের আকাক্সক্ষা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক-শোষণ-বঞ্চনাহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা। যে বাংলাদেশ হবে শিল্পে-সাহিত্যে-সঙ্গীতে অতুলনীয়। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই বাংলাদেশকে মৌলবাদী ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা হত্যা করে স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবকে। কারা প্রকোষ্টের অন্ধকারে হত্যা করে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল, এম. কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী-র মতো জাতীয় চার নেতাকে। দেশবিরোধী চক্র উঠে পড়ে লাগে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। ধ্বংস করতে চায় বৈচিত্র্যময় বাঙালি সংস্কৃতি। রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, বাউল ফকিরদের উপর অকথ্য নির্যাতন বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের নীলনকশা। এমনকি একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাও এই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। যারা বাঙালি ও বাঙলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তারা কখনোই টিকে থাকে না। ইতিহাসে এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। লড়াকু বাঙালি প্রয়োজনে অসাধ্যও সাধন করতে পারে। সাম্যবাদী কবি নজরুলের ভাষায় বলতে চাই, “বাঙালীকে, বাঙালীর ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও : / এই পবিত্র বাংলাদেশ / বাঙালীর, আমাদের / … বাঙলা বাঙালীর হোক / বাঙলার জয় হোক / বাঙালীর জয় হোক।” আসুন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তার অগ্রগতির স্বার্থে আমরা অতীত অভিমান ভুলে ঐক্য গড়ে তুলি। বির্নিমাণ করি সুখী, সমৃদ্ধিশালী সুন্দর আগামী।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

১৯ এপ্রিল, ২০১৮

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.