ভোটের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপসকামিতা

ভোটের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপসকামিতা

মোনায়েম সরকার: টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী বলেই সবাই জানে। দুঃখের কথা হলো, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ছে। ভোটের রাজনীতির কথা বলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে আপস করে দেশটাকে একটু একটু করে উগ্র ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক মানুষের দেশ বানানো হচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। ২২ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ১৪ দলীয় জোট সম্প্রসারণ সংক্রান্ত একটি খবর পড়ে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছি। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিএনপি দেশের অসংখ্য ছোট ছোট দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। এর পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগও নতুন নতুন মিত্র খুঁজছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ১৪ দলীয় জোট আছে তাকে সম্প্রসারিত করার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ।

নতুন মিত্র হিসেবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপি ছাড়াও ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ ও ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ নামের দুটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ হয়েছে বলে খবরে বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই উদ্যোগে ১৪ দলের জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি যে উৎসাহবোধ করবে না সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু আওয়ামী লীগ কেন ইসলামী দলগুলোর প্রতি লোভের দৃষ্টি দিচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। এটা কি পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে টেক্কা দেয়ার কৌশল? যদি তাই হয়, তাহলে আমার স্পষ্ট বক্তব্য, এই কৌশল আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য শেষ বিচারে সুফল নাও দিতে পারে।


বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর চারটি বিষয় জাতীয় নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। জাতীয়তাবোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য জরুরি। আজ বাংলাদেশ এই মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’- এই বিতর্ক তুলে আমাদের জাতিসত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আজ হুমকির মুখে। আমরা ভুলে গেছি যে, নিয়মিত চর্চার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়। আমরা সেই চর্চা থেকেই যেন ছুটি নিয়েছি। সামাজিক ন্যায্যতার প্রতিফলন দেখা যায় না। আমাদের চিন্তায়, কাজে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আবার জেঁকে বসেছে রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে। এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যার দোসর হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে ইতিহাস বিকৃত করেছিল। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ এবং যে কোনো মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এই অপশক্তি এক বিরাট হুমকি।


ধর্মের স্বাধীনতা, পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা, নিজের মতো চলাফেরার স্বাধীনতা আমাদের সংবিধান নাগরিকদের দিয়েছে। সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে- ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আরো আছে : (১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’, (২) ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, শুধু ভিন্ন ধর্মের নারী নয়, মুসলিম নারীদেরও নিজের রুচি ও পছন্দের পোশাক পরে রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে হয়রানি-অপমান-কুমন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে। কেন এই পশ্চাৎমুখিতা? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীনতা এবং তার সঙ্গে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র এবং অবশ্যই সাংস্কৃতিক মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এবং তাতে অংশীদার হয়েছিলেন মুষ্টিমেয় কুলাঙ্গার ছাড়া মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী সব মানুষ। তাদের অনেকে প্রাণ দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, হতাহত হয়েছেন। তাই আমরা বলি, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দয়ায় পাওয়া নয়’। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে রাজনীতির পটপরিবর্তন হয়, তার ফলেই পাকিস্তানি ভূত এসে মাঝেমধ্যেই আমাদের উল্টো পথে ঠেলছে, অনেকেই এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এই পাকিভূতদের প্রতিরোধ করতে না পারলে আমাদের এত রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার চেতনাকে রক্ষা করা যাবে না। স্বাধীনতার পর আমরা ধরে নিয়েছিলাম, যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় হয়েছে সেহেতু পাকিস্তানি ধ্যানধারণা, প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎপদ চিন্তাধারারও বুঝি পরাজয় ঘটেছে। আমরা তখন এটা উপলব্ধিতে নিইনি যে, দৃশ্যমান শাসকগোষ্ঠীকে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত করা সহজ হলেও ভেতরে থাকা, দীর্ঘদিন লালন করা চিন্তাধারা সশস্ত্র লড়াইয়ে পরাভূত হয় না। চিন্তার জড়তা থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষা-সংস্কৃতির মশাল হাতে এগিয়ে যেতে হয়।


অথচ স্বাধীনতার এত বছর পর এসেও আমরা দেখছি অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ অনেকটা এগিয়ে গেলেও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ফাঁক তৈরি হয়েছে। অর্থবিত্তের দিকে যতটা মনোযোগ বেড়েছে, মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের ক্ষেত্রে ততটাই সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সে জন্য আমাদের এখন সবার আগে দরকার শিক্ষা আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা নতুন জাগরণ, নতুন চিন্তা আর দিকদর্শন। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ তথা চেতনা ফিরিয়ে আনতে জোড়াতালির শিক্ষার খোলনলচে বদলে বাঙালির জাতীয় চেতনার সঠিক ইতিহাস আর সাংস্কৃতিক পরিচয় নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলেও সাংস্কৃতিক, মানসিক আর বৌদ্ধিক মুক্তি থেকে এখনো দূরেই আছি। এই দূরত্ব ঘোচাতে হবে।


রাজনীতিতে নীতির প্রশ্নে আপসহীন হতে হয়। আর কৌশলে হতে হয় নমনীয়। আজকাল দেখা যায়, উল্টো চিত্র। এখন নীতির সঙ্গে আপস করে কৌশলে অনমনীয় থাকার রাজনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলেই রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকছে। আমরা ভুলে যেতে বসেছি যে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় থেকে শুরু করে আমাদের সব অর্জন কিন্তু ঐক্যবদ্ধ শক্তির ফল। আমরা এক সঙ্গে আন্দোলন করেছি, সবাই মিলে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের সমাজের মূল শক্তিই ছিল যূথবদ্ধতা। মনে রাখা দরকার, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও তা থেকে রক্ষা পায় না। শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমার বৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে তা অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলা হয়েছে। সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটেছে। সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। যে কোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করা হয়। পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তির পথ ধরেই এসেছে অস্ত্র, সহিংসতা আর সন্ত্রাস।


এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে নীতির প্রশ্নটিকে গুরুত্বহীন না ভাবাটাই সমীচীন হবে। মানুষকে অগ্রসর রাজনৈতিক চিন্তার অনুগামী করে তোলার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। অসচেতন জনগণ কখনো কখনো হুজুগে মেতে ওঠে। আওয়ামী লীগ যেহেতু মানুষের কল্যাণ চিন্তাতেই অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করে, সেহেতু আওয়ামী লীগের নির্বাচন কৌশলেও কোনো কিছুর সঙ্গে আপস না করে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকাই হবে উচিত কাজ। মনে রাখতে হবে, ধর্মভিত্তিক দল নিজেদের স্বার্থেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জুটি বাঁধতে চাইবে, আওয়ামী লীগের স্বার্থে অবশ্যই নয়।


-মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.