মানুষ হইতে হবে, মানুষ যখন

মানুষ হইতে হবে, মানুষ যখন

মোনায়েম সরকার: একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুতেই একের পর এক সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে পৃথিবী। মহামারী, জলবায়ুদূষণ, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, পৃথিবীর মানুষগুলোকে দিশেহারা করে তুলছে। পুঁজিবাদের সম্পদলিপ্সা মেটাতে গিয়ে সুখপাখি পালিয়ে গেছে মানুষের বাসগৃহ থেকে। এখন মানুষের স্থির হওয়া প্রয়োজন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বিপদ সংকুল পথে হেঁটে বিপদ না বাড়িয়ে, আলোর জন্য প্রতীক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যুক্তির আলো, বিজ্ঞানের মঙ্গলশক্তি কাজে লাগিয়ে আবার মানবজাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আত্মসমালোচনা করে, ভুলগুলো স্বীকার করে নিয়ে, সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

স্বার্থের লোভে এক মানুষ যেমন আরেক মানুষকে শোষণ করছে, তেমনি এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে বাঁধিয়ে দিচ্ছে অন্যায় যুদ্ধ। যে যুগে আইন-কানুন তৈরি হয়নি, সে-যুগের বর্বরতা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আধুনিক সভ্য সমাজে অন্যায় কিভাবে ন্যায়ের পথকে রুদ্ধ করে দাঁড়াবার সাহস পায়? ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক প্লেট যখন গতিপথ বদল করে, তখন পৃথিবীর উপরিভাগে তীব্র পরিবর্তন সাধিত হয়। রাজনৈতিক পরাশক্তিও যখন এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে স্থানান্তরিত হয়, তখনো পৃথিবীর উপরিভাগে পরিবর্তন আসে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত ইউরোপ-আমেরিকা দীর্ঘকাল গোটা মানবজাতিকে শাসন করেছে। অধিক সম্পদের পাহাড় তাদের অকর্মণ্য, দুবৃত্ত করে তুলেছে। পক্ষান্তরে জনসংখ্যার ভারে নত এশিয়া কোটি কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে সতত সংগ্রামে রত। জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম করতে করতে আজ তারা পৃথিবীকে জয় করার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আমরা একটি সুন্দর পৃথিবী চাই। যাদের নেতৃত্বে পৃথিবী সুন্দর, শান্তিপূর্ণ থাকবে, আমরা চাই তারাই হোক মানব জাতির অভিভাবক।

মানব জাতির সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহ আজ যেন বিশ্বনেতাদের ভাষণমঞ্চ হয়ে পড়েছে। যেন কিছু লোক দেখানো ভাষণ, বিবৃতি, বৈঠকের জন্যই পৃথিবীর সব মানুষ ওই প্রতিষ্ঠানটি দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর সৃষ্টি করেছিলেন। বিচারের সর্বোচ্চ স্তর যখন ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, অন্যায়ের প্রতিরোধ করা তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। জাতিসংঘকে সজীব করে তুলতে না পারলে মানুষের দুর্দশা সহজে লাঘব হওয়ার নয়। পরাশক্তি হিসেবে এখন যারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছেন, তাদের উচিত হবে, এককেন্দ্রিক ক্ষমতা বলয় তৈরি না করে দ্বি-কেন্দ্রিক ক্ষমতা বলয়ের মাধ্যমে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা। এ ছাড়া মানবজাতির কল্যাণ করা সম্ভব নয়।

সুদূর অতীত এবং নিকট অতীতের ঘটনাবলি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, যখন পৃথিবীতে আসুরিক শক্তির আস্ফালন বেড়েছে তখনই নেমে এসেছে অভূতপূর্ব সব বিপর্যয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন কীভাবে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। ফ্রান্স ফেনো তার দুঃসাহসী লেখায় দেখিয়েছেন শোষিত মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস। গগণচুম্বী সম্পদ-আকাক্সক্ষীর শ্যেন দৃষ্টি কখনো মানুষের অন্তর দেখে না, ওরা দেখে মানুষের উষ্ণ, তাজা রক্ত। মানুষের রক্তে ওদের ব্যাংকগুলো ভরে ওঠে, বাড়ে মুনাফা।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সম্ভবত পুঁজিবাদী পরাশক্তির সর্বশেষ সেনাপতি। একবিংশ শতাব্দীতে যদি এই পুঁজিপতি মোড়লের পরাজয় ঘটে, তবে পৃথিবীতে আর কখনো পুঁজিবাদ এমন ভয়ঙ্কর চেহারায় দাঁড়াবে কিনা তা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। সাম্রাবাদী মার্কিন নেতৃত্ব, নিজস্ব শক্তি সংহত রাখতে এমন কোনো ষড়যন্ত্র নেই না করছে। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে যত যুদ্ধ লেগে আছে প্রত্যেকটি যুদ্ধে আমেরিকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ আছে। যতগুলো দেশে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর শক্তিশালী ঘাঁটি আছে সেগুলোর সঙ্গেও আমেরিকার রয়েছে সরাসরি যোগাযোগ।

আমেরিকা একদিকে গণতন্ত্রের প্রলোভন দেখিয়ে, অন্যদিকে বশংবদ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে। বিশ্ববাসীর সামনে মানবতার কথা বলে, আড়ালে করছে বিশ্বমানবতার চরম সর্বনাশ। এদের মুনাফালোভী দ্বিমুখী নীতিতে বিশ্ব এখন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। আমেরিকার স্বৈরাচারী মনোভাবকে যারা অস্বীকার করে বা করতে চায়, তারাই আগামীতে জোটবদ্ধ হয়ে নয়া অর্থনৈতিক ও মানবিক সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে। যারা ভাবছেন সমাজতন্ত্রের সকল আয়োজন ফুরিয়ে গেছে, তারা আশায় বুক বাঁধতে পারেন এই ভেবে যে, মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম কখনোই শেষ হয়ে যায় না। উপনিবেশ বিস্তার করে, যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কিংবা মৌলবাদ-বর্ণবাদ ছড়িয়ে দিয়ে হয়তো ক্ষুধিত মানুষকে কিছুদনি ভ্রান্তিতে রাখা যায়, কিন্তু ভ্রান্তিমোচন হলে মানুষ আবার ঠিকই বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ-আফ্রিকায় জিইয়ে রেখেছে বর্ণবাদের গভীর গহিন কুয়াশা আর এশিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে মৌলবাদ। বর্ণবাদ ও মৌলবাদ দুটোই বর্তমান পৃথিবীর জন্য অভিশাপ স্বরূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানবসভ্যতা বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা তারাই প্রথম নিক্ষেপ করেছিল হিরোশিমা-নাগাসাকির উপর। তাদের রক্তলোলুপ আগ্রাসী মনোভাবের কাছে এক সময় পুরো পৃথিবী জিম্মি হয়ে পড়েছিল।

বর্তমানে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো দেশ শক্তি সঞ্চয় করে আমেরিকার চেয়েও শক্তিশালী মারণাস্ত্র উদ্ভাবন করেছে। উত্তর কোরিয়া যে সকল ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে তাতে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ বিস্মিত হয়েছেন। আমেরিকার মাটিতে আঘাত করার শক্তি চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া অনেক আগেই অর্জন করে ফেলেছে। তাছাড়া করোনা মহামারী চোখে আঙ্গুল দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে আমেরিকার বড়ত্বের গর্ব আসলেই কতটা ফাঁপা। লক্ষ লক্ষ মানুষের চিকিৎসাহীন মৃত্যু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেউই প্রত্যাশা করেননি, অথচ সেটাই তাদের মেনে নিতে হয়েছে। বুশ, ওবামা, ট্রাম্পের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্টগণ পুরো পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকারও বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। পুঁজিবাদকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা এখন তার খুব একটা নেই। তবু স্বীকার করতেই হবে আমেরিকা এক মহাশক্তির দেশ। তার সকল শক্তি যদি বিশ্ব মানবতার কল্যাণে ব্যয় হবে এবং তার সঙ্গে অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্র এই মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করে, তাহলে সহজেই পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে। আফগানিস্তানের যুদ্ধে আমেরিকা যেসব ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করেছে তার একটি বোমার মূল্য দিয়ে বাংলাদেশের একটি প্রাইমারি স্কুল তৈরি করা সম্ভব। দীর্ঘ কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে আমেরিকা কোটি কোটি বোমা ফেলেছে। এসব বোমার মূল্যমান দিয়ে সারা পৃথিবীতে কী পরিমাণ কল্যাণ কাজ করা যেতো তা সহজেই অনুমান করা যায়। আমেরিকার একটি বোমা হিরোশিমা নগরী ধ্বংস করেছিল। রাশিয়ার কাছে এমন পারমাণবিক বোমা রয়েছে যার একটি দিয়ে হিরোশিমার মতো ৫২০টি শহর মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। মানব বিধ্বংসী এসব মারণাস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করে মানবতার কল্যাণে আজ সবার আত্মনিয়োগ করা দরকার। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়ন হোক বিশ্ববাসীর মঙ্গলার্থে। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে মানুষকে আজ নতুন শপথে জেগে উঠতে হবে, বিদ্বেষ ভুলে সবাইকে শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গীত গাইতে হবে।

দুনিয়ার বিপদগ্রস্ত মানুষ আজ মনে প্রাণে মানবিক বিশ্বব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বিরত থাকতে হবে। এমনিতেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও মহাজাগতিক গতি-প্রকৃতির কারণে পৃথিবী হুমকির মুখে আছে। এমন নাজুক মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হলে এবং সেই মহাযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হলে পৃথিবী জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাবে। মানুষের মঙ্গলের জন্যই আজ মানুষকে সাবধান হতে হবে। অনেক রক্তপাত, অনেক শোষণ-বঞ্চনা পৃথিবীর ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। পৃথিবীতে আর কোনো কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করা মানুষের জন্য সমীচীন হবে না। আমাদের সুন্দর পৃথিবীকে আজ আমাদেরই বাঁচাতে হবে। এই মুহূর্তে বিশ্বনেতৃবৃন্দ মিলিত হয়েছেন জলবায়ু সম্মেলনে, তাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা পৃথিবীকে নতুন পথের সন্ধান দেবে এটাই প্রত্যাশা করে বিশ্বাসী।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কবি কুসুমকুমারী দাশ তাঁর বিখ্যাত ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় আগামী প্রজন্মের মানুষদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সাদা প্রাণে হাসি মুখে কর এই পণ/মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’ কবির কথার রেশ ধরেই বলতে চাই, একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ মনুষ্যত্বের  পরিচয় দেবে, শান্তির শপথ নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে, এমনটাই হোক আমাদের সবার কামনা।

-মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.