মান্যবর গুড সিস্টার, সুবর্ণ সত্তরে স্বাগত

মান্যবর গুড সিস্টার, সুবর্ণ সত্তরে স্বাগত

মোনায়েম সরকার: মাত্র আটাশ বছর বয়সে পিতৃ-মাতৃ-ভ্রাতৃহীন হন শেখ হাসিনা। একজন সাধারণ গৃহবধূ আর মুজিব কন্যা ছাড়া  তখন তার অন্য কোনো পরিচয় ছিল না। তার জীবন ছিল খুবই সাধারণ, এ কথা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের বিচারে যেমন সত্য সামাজিকতার বিচারেও তাই। আমি শেখ হাসিনার জীবনের অনেক করুণ মুহূর্তের সাক্ষী। সেই কথাগুলো এখন হয়তো গল্পের মতো শোনাবে, কিš‘ ১৯৭৫ সালের পরে যে বিপর্যপ্ত, দিকভ্রান্ত, ক্লান্ত, আশ্রয়হীন, অসহায়, শেখ হাসিনাকে আমি দেখেছি তার সাথে আজকের দিনের শেখ হাসিনার আকাশ-পাতাল প্রভেদ। একজন সাধারণ গৃহবধূ আজ অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক। দারিদ্রের শৃঙ্খল ভেঙে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন স্বচ্ছলতার দিকে। এই মুহূর্তে তিনি যা কিছু স্পর্শ করছেন, তা-ই তার হাতের ছোঁয়ায় সোনা হয়ে যাচ্ছে।

ত্যাগে, দয়ায়, ক্ষমায় ও সাহসের মহিমায় শেখ হাসিনা আজ বিশ্বের বিস্ময়। মাত্র ৩৬ বছরের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক জীবনের তিনি অনেক কিছু উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে। আজ আমি এই মাহেন্দ্রক্ষণে তার অর্জনের দুই-একটি বিষয় অবতারণা করতে চাই। শেখ হাসিনাকে আমি ‘গুড সিস্টার’ বলে ডাকি। তিনি আজ সুবর্ণ সত্তরের পদার্পণ করেছেন, সত্তরে তাঁকে সানন্দে স্বাগত জানাই।

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যারা একটু সময় ব্যয় করেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, শেখ হাসিনা নিজের ই”ছায় রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হননি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পরে বাংলাদেশ চলে যায় পাকিস্তানি ধারায় ক্ষমতালোভী সামরিক চক্রের হাতে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করার পরে আওয়ামী লীগের নেতাদের উপর নেমে আসে ভয়াবহ অত্যাচার ও নির্যাতন। এ সময় চলতে থাকে হত্যাকা-, গুম ও অকারণ জেল-জুলুম। সামরিক চক্রের ই”ছায় হতে থাকে ক্যু। যেই বঙ্গবন্ধু বর্ণনাতীত লড়াই-সংগ্রাম করে বাঙালি জাতিকে এনে দেন বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা, তার নাম উ”চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমনই এক ভয়াল মুহূর্তে দল ও জাতির স্বার্থে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, সে কথা দেশবাসী আজ সম্পূর্ণভাবে অবগত।

আওয়ামী লীগে রক্তক্ষরণ বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই অনেক প্রবীণ নেতা দল থেকে সরে গিয়ে নতুন দল গঠন করে যদিও সে সব দলের অস্তিত্ব আজ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা কষ্টকর। তবু ভাঙনের বিপর্যয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ একটু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আমেনা বেগম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সময়েই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন,  কে. এম. ওবায়দুর রহমান, কুরবান আলীসহ বহু নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পর দলত্যাগ করেছেন। কিš‘ শেখ হাসিনা অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে আওয়ামী লীগের হাল ধরার মুহূর্ত থেকে একাই দলকে টেনে নিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাও যে দলের ভাঙনের মুখে পড়েননি এ কথা বলা যাবে না। ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতারাও তাকে কম আঘাত করেননি। কলঙ্কিত ওয়ান-ইলাভেনের সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও জেল খেটেছেন, তিনি উপলব্ধি করেছেন সুবিধাবাদীদের বিষদাঁতের কামড়। তবু তিনি সবকিছু সামলে নিয়েছেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। এখনো তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গেই সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যান।

শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় গুণ তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। যে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার তাকে নানাভাবে নির্যাতন করেছেন, হয়রানি করেছেন, আজ তাকেই তিনি দিয়েছেন উপদেষ্টার মর্যাদা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদীয় জোট সরকারের আমলে যেভাবে তাকে একের পর এক হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই বিএনপিকেও তিনি আক্রোশবশত আঘাত করেননি, বিশ্বের ইতিহাসে উদারতার এমন নজির খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।

শেখ হাসিনা আজ শুধু আওয়ামী লীগেরই নেতা নন, তিনি আজ দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। ইতিহাস যদি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নাম বুকে ধারণ করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার নামটি স্বর্ণাক্ষরেই লেখা হয়ে থাকবে। তার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পন্ন হতে চলেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। আজ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবোজ্জল নতুন অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। অকুতোভয় সাহসী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে উন্নয়নের মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদ-ে ও উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে।  

জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের জনগণের আস্তার প্রতীক। তিনি দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ যেভাবে বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তিনি দৃঢ় মনোবলে সে সব কিছু বাংলার মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাও তিনি সামাল দিয়েছেন দক্ষ হাতে। দুর্নীতি দমনে তার অর্জন মোটেই খাটো করে দেখার মতো নয়। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রাদর্শ যেমন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, শেখ হাসিনার স্বপ্নও তা-ই। সেই লক্ষ্যেই তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। পিছিয়ে পড়া বাংলার জনপদে আজ তিনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আন্দোলনের স্লোগান তুলে দেশের চেহারা বদলে দিয়েছেন। দেশের মানুষ প্রথম দিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের মমার্থ বুঝতে দেরি করলেও আজ সকলেই স্বীকার করছে বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ জরুরি কাজ সমাধা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

দুর্বলের উপর সবলের খবরদারি এক ঐতিহাসিক সত্য। এই কথা দুর্বল দেশের বেলায়ও সমানভাবে প্রযুক্ত। বাংলাদেশের উপর অনেকেই অযৌক্তিক অভিভাবকত্ব প্রদর্শন করেছে এবং এখনো করতে চাচ্ছে। এদেশে নির্বাচন হলে আমেরিকা পর্যবেক্ষণ করতে আসে, আসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। কিš‘ তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা সকলেই জানি, আমেরিকাতেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তারাও খামখেয়ালের বশে এবং নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্য দেশের উপর চাপিয়ে দেয় অন্যায় যুদ্ধ। ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন গরিব দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন না, তারা ধনীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন এতটাই মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে যে, আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রক্তচক্ষুকেও আর ভয় পায় না। বিগত কয়েক বছরে শেখ হাসিনা এ কথার প্রমাণ বহুবার বাংলাদেশের মানুষের সামনে রেখেছেন।

কারও কাছে নতজানু হয়ে নয়, আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েই এখন দেশ শাসন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। যারা ভারতবিদ্বেষী আছে, তারা বহুবার বলার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশ ভারতের হাতে চলে যাবে। তাদের এমন অর্বাচীন প্রলাপের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে  ২৫ বছর মেয়াদি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি বাতিল করা। তার সময়েই বাস্তবায়িত হলো ৬৮ বছরের কষ্ট আর ৪১ বছরের প্রতীক্ষিত সীমান্ত চুক্তি। ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সীমান্ত চুক্তির বিল পাস করানো কতটা কূটনীতিক দূরদর্শিতার ফল, তা আজ আর কারও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। এমনকি মায়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা বিজয়ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

ছাত্র জীবনেও তিনি রাজনীতি করেছেন এবং ইডেন কলেজের ভিপি ছিলেন। তবু বলবো, শেখ হাসিনার সক্রিয় রাজনীতির বয়স মাত্র ৩৬ বছর। এই ৩৬ বছরে তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার মৃত্যু ঝুঁকিতে পতিত হয়েছেন, এতবার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা রাজনীতিক পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই আছে। এ বিষয়ে কেবল কিউবার বিপ্লবী রাজনীতিক ফিডেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গেই তার তুলনা চলে। রাজনীতিতে পা দিয়েই তিনি গৃহে অন্তরীণ, কারানির্যাতন ভোগ, মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ বিচিত্র জুলুমের মুখোমুখি হন। তবু তার অপ্রতিরোধ্য গতি কেউ থামাতে পারেনি। বরং যারা তার গতিরোধ করতে চেয়েছে তারাই নিক্ষেপিত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।

গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে তিনি সাধ্যের চেয়েও বেশি কিছু দিয়েছেন, সীমাহীন প্রতিকূলতার মুখে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু যোগাযোগ ব্যবহার যুগান্তকারী উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি তারই সুযোগ্য নেতৃত্বের ফসল। উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালনার জন্য শেখ হাসিনা আজ সংবর্ধিত হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা দিয়েছেন অনেক কিছুই, কিন্তু বাংলাদেশ তাকে রক্তাক্ত-ক্ষত-বিক্ষত করা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। আজ বাংলাদেশের সামনে সময় এসেছে নির্ভীক এই দেশপ্রেমীকে যথার্থ মর্যাদায় শুভে”ছা জানানো।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উত্তাল জনস্রোত এসে আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। লক্ষ লক্ষ নিরাশ্রয় রোহিঙ্গাদের মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে নিরলসভাবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত সৃষ্টির জন্য ছুটে যাচ্ছেন একপ্রান্ত থেকে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। আজ আমরা তাকে চিনতে পারছি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে। তার নাম নোবেল শান্তি কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছেন বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞগণ। মাদার অব হিউম্যানিটি শেখ হাসিনা এবার শান্তিতে নোবেল পেয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করবেন, এই উ”চাকাক্সক্ষা মনে-প্রাণে লালন করি। তার সত্তরতম জন্মদিনে দীর্ঘায়ু, সুস্থ জীবন প্রত্যাশা করছি।

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.