সৈয়দ জাহিদ হাসান: আধুনিক যুগে রাষ্ট্রই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি নাগরিকের জীবন-যাপন প্রণালি। ব্যক্তি মানুষের একক আকাক্সক্ষা রাষ্ট্রের কাছে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদি রাষ্ট্র সেই আকাক্সক্ষাকে দরকারি মনে না-করে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য রাষ্ট্রকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেননা, বর্তমানে রাষ্ট্রের কাছে একক ব্যক্তির অতটা সমাদর নেই। গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় সমষ্টিকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি পূজার আচার-পদ্ধতি অনেক আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে। এটা অবশ্য এক অর্থে ভালোই হয়েছে। কোনো একক ব্যক্তিকে বেশি মনোযোগ না দিয়ে সমষ্টিকে মনোযোগ দিলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়, সম্পদেরও সুষমবণ্টন নিশ্চিত হয়। জনরোষের সম্ভাবনা তাতে দেখা যায় না, বরং জনতুষ্টির প্রশংসায় সরকার অন্যরকম সুখানুভ‚তি অনুভব করে।
‘বাক-স্বাধীনতা’ শব্দযুগলের মূল্য আমার কাছে মামুলি বিষয় নয়। ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এসব শব্দের চেয়ে ‘বাক-স্বাধীনতা’ শব্দ-যুগল আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আরো বেশি আশাব্যঞ্জক। ‘গণতন্ত্র’ আছে কিন্তু ‘বাক-স্বাধীনতা’ নেই, তাহলে সেই ‘গণতন্ত্র’ অকালে মৃত্যুবরণ করবে এটাই ধ্রæবসত্য। ‘সমাজতন্ত্র’ বলি আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলি কোনো কিছুই স্থায়ী হয় না, যদি ‘বাক-স্বাধীনতা’ হরণ করা হয়। এ জন্যই আমরা দেখি মিলিটারি শাসিত রাষ্ট্রে প্রথমেই ‘বাক-স্বাধীনতা’, ‘বুলেটগালা’ (‘সিলগালা’ শব্দ অনুসারে গঠিত) করা হয়। কারাগারে প্রেরণ করা হয়, বাক-স্বাধীনতার মহান যোদ্ধাদের। কেন ‘বাক-স্বাধীনতা’ এত বিপজ্জনক? এর অনেকগুলো কারণ আছে। বাক-স্বাধীনতা থাকলে মানুষ যা চায় তা সব পায়। না-পেলেও তা পাওয়ার একটা বিরাট সম্ভাবনা থাকে।
বাক-স্বাধীনতা থাকলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রসহ সব তন্ত্রই ঠিক থাকে। এমনকি প্রয়োজনে নতুন মতবাদও জন্ম দিতে পারে বাক-স্বাধীনতা। এত যার ক্ষমতা, এত যার সর্বব্যাপী আধিপত্য, তাকে কে না ভয় পায়? ‘বাক-স্বাধীনতা’ সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। কথাটি শুনে কেউ কেউ হয়তো আঁতকে উঠতে পারেন কিন্তু এটাই সত্য। যিনি ‘বোবা’, যিনি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, যিনি উন্মাদ, তার জন্য বাক-স্বাধীনতা নয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধীকে বাক-স্বাধীনতার ক্ষমতা দিলে এবং উন্মাদকে ‘বাক-স্বাধীনতা’ প্রচারের মঞ্চ বানিয়ে দিলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের অবস্থ কী হবে আশা করি তা আর ব্যাখ্যা করার দরকার হবে না। সুস্থ মানুষও কখনো কখনো বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী হয়, উন্মাদ হয়। স্বার্থে অন্ধ হলে এরকমটি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। সুতরাং বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুস্থ হলেও অন্তর স্বার্থ-ব্যাধিগ্রস্ত হলে তার ‘বাক-স্বাধীনতা’ না-থাকাই ভালো। তাহলে ‘বাক-স্বাধীনতা’ কে ভোগ করবে? ‘বাক-স্বাধীনতা’ তিনিই ভোগ করবেন, যে এই অমৃতভোগকে চেনা-অচেনা সব মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে জানেন।
মহামতি টলস্টয়ের ‘বাক-স্বাধীনতা’ দাবি আর মিথ্যাবাদী আল্লামা সাহেবদের দাবি কি এক জিনিস হতে পারে? ‘বাক-স্বাধীনতা’ অপশাসকের জন্য ভীতির কারণ। তাই অপশাসকগণ বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নে সবসময়ই একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। যে-শাসক জনগণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন, তিনি নিজেই বাক-স্বাধীনতার পথ কুসুমাস্তীর্ণ করে দেন। বিবেককে জাগ্রত রাখতে বাºেবীকে করেন বিনীত বন্দনা। ‘বাক-স্বাধীনতা’ সেই মানুষগুলোর জন্য সুরক্ষিত যারা এর সঠিক ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সমষ্টির স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। একজন শিল্পী, একজন সাংবাদিক, একজন প্রজ্ঞাবান বিদ্বানই কেবল এই স্বাধীনতার যোগ্য। যাদের কথায় সমাজে সুপরিবর্তন আসবে, শান্তি, সাম্য বজায় থাকবে, মানুষের সার্বিক মুক্তির বাণী প্রতিধ্বনিত হবে, শোষণ-বঞ্চনা নিপাত যাবে, রাষ্ট্রে কেবল তারাই পাবে ‘বাক-স্বাধীনতা’। ‘জনমত’ আর ‘বাক-স্বাধীনতা’কে গুলিয়ে ফেলে বাক-স্বাধীনতার মহান উদ্দেশ্য খর্ব করার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। যদিও ‘জনমত’ আর ‘বাক-স্বাধীনতা’ এক নয়। ‘বাক-স্বাধীনতা’ জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে কিন্তু ‘জনমত’ কখনোই ‘বাক-স্বাধীনতা’কে প্রভাবিত করতে পারে না।
‘বাগ্যন্ত্র’ ঈশ্বর প্রদত্ত স্বয়ংক্রিয়। ‘কথা’ও ঈশ্বরের দান। ‘বাক-স্বাধীনতা’কে এই অর্থে ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা বলাই বেশি সমীচীন। ঈশ্বরের উৎকৃষ্ট বিধান, ব্যক্তিস্বার্থে লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে অনেক আছে। অনেক জাতি, অনেক রাষ্ট্রই ঈশ্বরের পবিত্র আইনভঙ্গ করে ধ্বংস হয়েছে। ‘বাক-স্বাধীনতা’ হরণ করা হচ্ছে বললেই ‘হরণ’ করা যায় না। কার বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হলো, সেই ব্যক্তির জ্ঞান-গরিমা-আচরণ-প্রকৃতির দিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার। যোগ্য লোকের ‘বাক-স্বাধীনতা’ রাষ্ট্র যদি হীনস্বার্থে অবরুদ্ধ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘বাক-স্বাধীনতা’ হরণের দোহাই কতটা যৌক্তিক?
রাষ্ট্র দুই কারণে ‘বাক-স্বাধীনতা’ হরণ করতে উদ্যোগী হয়। এক. ক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার স্বার্থে, দুই. জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে। কারো বাক-স্বাধীনতা যদি সাধারণ মানুষের শান্তি ভঙ্গের কারণ হয়, তাহলে জনস্বার্থে সেই ব্যক্তির বাক-স্বাধীনতা হরণ করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটিও এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অপরাধ, তবে তা গ্রহণীয়। অভিধানের অপ্রচলিত শব্দের মতোই ব্যবহার যোগ্য। অপর পক্ষে, জনতার স্বার্থ-ভ‚লুণ্ঠিত করে সরকার যদি নিজের স্বার্থের জন্য বাক-স্বাধীনতা হত্যা করার চেষ্টা করে, এর চেয়ে জঘন্য কিছু আর হতে পারে না। কেননা, বাক-স্বাধীনতা চড়ায় আটকা পড়লে প্রগতি মুখ থুবড়ে পড়ে, অনাচার দখল করে সুন্দরের আসন।
‘বাক-স্বাধীনতা’ হরণ-পূরণের বিষয় নয়, এটা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিষয়ও। ব্যক্তিত্ব কখনো রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত হতে পারে না। ব্যক্তিত্ব স্বয়ম্ভূ, ঐশ্বরিক। যার ব্যক্তিত্ব সুন্দর, মার্জিত ও জনস্বার্থমুখী নয়, তার ‘বাক-স্বাধীনতা’ নিয়ে চিৎকার করার অধিকার থাকা ঠিক নয়। রাষ্ট্র ব্যক্তি নয়, তবে রাষ্ট্রের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করা যায়। নাগরিকের সুন্দর ব্যক্তিত্বই সুন্দর রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত। সুন্দর চিন্তা মধ্যযুগে নিন্দিত হলেও তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তা নন্দিত হয়ে উঠছে। আগের যুগে দেখা গেছে ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে বিজ্ঞানের সূত্রপ্রণেতাকে হত্যা বা কারাগারে প্রেরণ করা হতো। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রই হতো পীড়নের মূল কারণ। তখন রাষ্ট্র ধর্মের নীতি অনুসরণ করে পরিচালিত হতো বলে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটতো। কিন্তু এখন স্বাধীনতার চেতনায় সম্পূর্ণভাবে আস্থাবান ব্যক্তির বাক-স্বাধীনতা কখনোই কেউ হরণ করতে পারে না। আকস্মিক বাধা আসতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাক-স্বাধীনতাই জয়ী হয়। ‘প্রলাপ বকা’কে যারা ‘বাক-স্বাধীনতা’র সমর্থক মনে করেন, তাদের বাক-স্বাধীনতা না থাকাই উত্তম। প্রজ্ঞাবানগণ চিরদিনই বাক-স্বাধীন। মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে কিংবা অন্য কোনো শাস্তির ভয়ে ভীত না হয়ে মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই প্রজ্ঞাবানগণ এই স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখেন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।