শুভ জন্মদিন ঋদ্ধিমান মোনায়েম সরকার

শুভ জন্মদিন ঋদ্ধিমান মোনায়েম সরকার

সৈয়দ জাহিদ হাসান: তখন চলছে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কাল। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের চিরসুন্দর জনপদ বাংলাদেশ। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার স্বনামখ্যাত, অন্যতম উর্বরভূমি কুমিল্লা। গোমতি-বিধৌত সাম্যবাদী-কবি কাজী নজরুল ইসলামের পদধূলি ধন্য এই কুমিল্লা জেলার, দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ গ্রামে ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এক স্বাপ্নিক সন্তান যাঁর নাম মোহাম্মদ আবদুল মোনায়েম সরকার। সময়ের পরিক্রমায় সর্পখোলসের মতো একদিন ‘মোহাম্মদ আবদুল’ শব্দবন্ধটি খসে পড়ে তাঁর মূল নাম থেকে। তিনি পরিবার ও পরিচিতজনের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেন মোনায়েম সরকার নামে। মোনায়েম সরকার স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এখন একটি কিংবদন্তি নাম। এই নাম ধারণ করে আছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের অনেক দুর্লভ ইতিহাস। রক্তাক্ত সংগ্রামের অশ্রুস্নাত পথ পাড়ি দিয়ে এই নাম এখন এমন এক ‘লাইট হাউজ’ বহুদূর সমুদ্রের পার থেকেও যাকে সনাক্ত করা যায় বিনা বিভ্রমে।

মাত্র সাত বছর বয়সে আজন্ম বিপ্লবী এই মানুষটি ভাষা মিছিলে অংশগ্রহণ করেন তাঁর সেজভাই আবদুল খালেক সরকারের হাত ধরে। অগ্রজের হাত ধরে শৈশবের মাহেন্দ্রক্ষণে সেই যে তাঁর পথচলা শুরু এখনো তিনি পথেই আছেন। তাঁর সতীর্থ, সহযোদ্ধারা অনেকেই আজ রাজপথ পেছনে ফেলে, আন্দোলনের আবেগ থেকে সরে গিয়ে আপন নীড়ে অবসাদ যাপন করছেন, কিন্তু মোনায়েম সরকার রাজপথ ছেড়ে ঘরে ফিরে যাননি। আন্দোলনের মোহনীয় হাতছানি উপেক্ষা করে ব্যস্ত হয়ে উঠেননি ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে। একদিন শৈশবের সোনালি সকালে মানবমুক্তির যে মন্ত্র উচ্চারণ করে তিনি লড়াইয়ের মাঠে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, এখনো তিনি সদর্পে সম্মুখে ধাবমান। ক্লান্তি তাঁকে দমাতে পারেনি, লোভ তাঁকে বাঁধতে পারেনি, প্রলোভন তাঁকে টলাতে পারেনি আদর্শ থেকে। চারপাশের ধুধু প্রান্তরে তাকিয়ে আজ তিনি সহজেই বলতে পারেন,

‘সবাই যখন আত্মসুখে মগ্ন

সবাই যখন করছে কেবল স্বার্থের সন্ধান,

আমি তখন যুদ্ধের মাঠে একা

কণ্ঠে আমার মুক্তির স্লোগান।’

কিন্তু এ কথা তিনি কিছুতেই বলবেন না; কেননা মানুষের মর্যাদা বিনষ্ট করতে নয়, প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি বদ্ধ পরিকর। মা, মাটি, মানুষের জন্য ধূপের মতো নিজেকে নিঃশেষ করেও যিনি বিজয়ীর হাসি হাসতে পারেন তাঁর-ই নাম মোনায়েম সরকার।

মোনায়েম সরকার শিক্ষিত, অভিজাত বংশের সন্তান, কিন্তু নিজেকে তিনি সমর্পিত করেছেন সাম্যবাদের পতাকাতলে। যৌবনের তারুণ্যদীপ্ত দিনে, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন প্রগতিশীল বাম আন্দোলনে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা শুধু দেশের মানুষের দৃষ্টিকেই ধাঁধিয়ে দেয় না, অন্তরে বিস্ময়বোধও জাগ্রত করে। স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে এমন কোনো আন্দোলন নেই যেখানে মোনায়েম সরকার অংশগ্রহণ করেননি, এমন কোনো স্লোগানমুখর ঝাঁঝালো মিছিল নেই যেই মিছিলে সমুদ্র গভীর জনতার সঙ্গে তিনিও বজ্রমুষ্টি হাত তুলে সংক্ষুব্ধ স্লোগানমন্ত্র উচ্চারণ করেননি। আন্দোলনের অপূর্ব আবেগ মোনায়েম সরকারের রক্তে মিশে আছে। মিছিলের নন্দনতত্ত্ব মিশে আছে তাঁর বিপ্লবী মানসিকতার রোম্যান্টিকতায়। এখানেই মোনায়েম সরকার একক, অদ্বিতীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা মহাকাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে যারা আদর্শ দিয়ে, ত্যাগের মহিমা দিয়ে ভাস্বর করে তুলেছেন তাঁদের অন্যতম মোনায়েম সরকার। ’৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মোনায়েম সরকার যে ভূমিকা রাখেন ইতিহাসে তা সোনালি অক্ষরে চিরকাল লেখা থাকবে। যেখানে শোষণ, অনিয়ম সেখানেই কণ্ঠ সোচ্চার মোনায়েম সরকারের। রাজপথের ৬-দফা আন্দোলনে হাতের শিরা ছিঁড়ে রক্ত দিয়েছেন, কখনো বা চোখ বাঁধা অবস্থায় বন্দি থেকেছেন ক্যান্টনমেন্টের রাক্ষসপুরীতে; কিন্তু কিছুতেই তিনি মাথা নত করেননি, হার মানেননি অপশক্তির অমানবিক অত্যাচারের কাছে। বাংলাদেশের যা কিছু উজ্জ্বল অর্জন সবকিছুতেই লেগে আছে মোনায়েম সরকারের মেধা আর শ্রমের স্পর্শ। এ কথা যারা অস্বীকার করতে চায় তারা যেন প্রকারান্তরে সত্যকেই এড়িয়ে যেতে চায়।

১৯৭৫ সালে জাতির জনকের মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর দেশ যখন চলে যায় দানবীয় শক্তির বুটের তলে তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা বিশ্বে মুজিব হন্তারকের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন মোনায়েম সরকার। তাঁর এই দুঃসাহসিক কাজে সেদিন যারা তাঁর সঙ্গে প্রাণান্ত শ্রম স্বীকার করেছেন তাঁদের মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল, রুহুল কুদ্দুস, প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর নুরুল ইসলাম অন্যতম। পলাতক জীবন নিয়ে বিদেশের মাটিতে বসে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করা তখনকার দিনে যে কত বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তা আজ সহজেই অনুমেয়। প্রচ্ছন্ন কূটনৈতিক মোনায়েম সরকারের দূরদর্শিতার কারণেই তৎকালীন এলোমেলো আওয়ামী লীগ আজ সুশৃঙ্খল দলে রূপান্তরিত হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলীয় প্রধান করার প্রস্তাব মোনায়েম সরকারই প্রথম উত্থাপন করেছিলেন পিএন হাকসার ও আবদুর রাজ্জাকের কাছে, তা না-হলে আজ হয়তো আওয়ামী লীগের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। অন্যরকম হতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

বর্তমানে মোনায়েম সরকার সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। কেন এই লড়াকু মানুষটি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে পর্দার আড়ালে চলে গেলেন জনমনে এ প্রশ্ন জাগা অসম্ভব নয়। আজ যাঁরা রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁদের সঙ্গে মোনায়েম সরকারের বিরোধ কেবল মত আর পথেরই নয়, আদর্শিক ও চারিত্রিক বিরোধও বটে। গণমানুষের মুক্তির জন্য, দেশ-মাতৃকার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যেই মানুষটি অকৃতদার রয়ে গেলেন, পরিবার পরিজন থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়লেন, তাঁর পক্ষে কি সম্ভব ছদ্মবেশ বা ভ-ামির আশ্রয় নেওয়া? চারপাশে কাপুরুষ আর ফেরেববাজদের দেখে, সত্য কথা বলার লোকের অভাব দেখে মোনায়েম সরকার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন অন্যপথে। যে-পথ লেখালেখি ও গবেষণার পথ, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানবিতরণের পথ। তিনি এখন দু’হাতে লিখছেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা একাশিটি। লেখালেখির পাশাপাশি নিষ্ঠার সঙ্গে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চে।

একরাশ অনুপম মানবিক গুণাবলির নাম মোনায়েম সরকার। তিনি বন্ধু বৎসল, সদালাপী, প্রগতিশীল, পরোপকারী, শিশুপ্রিয়, বিজ্ঞানমনস্ক ও আধুনিক। তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, পি এন হাকসার, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ইলা মিত্র, কমরেড মুজাফফর আহমদের মতো বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের। তাঁর বন্ধুত্বের তালিকায় আছেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মাজহারুল ইসলাম, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শওকত ওসমান, আবু সাইয়িদ আইয়ুব, সত্যেন বোস, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ।

মোনায়েম সরকারের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের আশ্রয়ের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। বাংলা সাহিত্যের প্রতিদিনের সূর্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ আড়ম্বরে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব উদ্যাপন করা হয় কলকাতার টাউন হলে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকবর্গ কর্তৃক ‘কবি সার্বভৌম’ উপাধিও কবিকে সত্তর বছর বয়সেই প্রদান করা হয়। এ সবের চেয়েও বড় কথা হলো ‘গোল্ডেন বুক অন টেগোর’ প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সত্তর বছর বয়সে। যেখানে তৎকালীন দুনিয়ার সকল খ্যাতিমান-শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবী-কবিকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মোনায়েম সরকারের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষেও প্রকাশিত হয় দৃষ্টিনন্দন ও সুপাঠ্য পুস্তক ‘মোনায়েম সরকার জন্মদিন সম্মাননা গ্রন্থ’। এই গ্রন্থেও স্থান পায় দেশ-বিদেশের বরেণ্য শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-কলামিস্টের মূল্যবান লেখা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তাঁর ৭০তম জন্মোৎসব ছিল একগুচ্ছ বর্ণিল অনুষ্ঠানের সমাহার।

মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের প্রমিথিউস রাজনীতিক। প্রমিথিউস যেমন স্বর্গ থেকে বুকের ভেতরে ভরে আগুন নিয়ে এসেছিলেন মানুষের মঙ্গলার্থে, মোনায়েম সরকারও আজীবন বুকের ভেতর লালন করছেন মানবপ্রেমের মাধুরীময় মহত্ত্ব। দেশপ্রেমিক এই অনির্বাণ ধ্রুবতারার ৭৪তম জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। কোনো প্রশংসাই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। ‘বকুল সরকার’ ছদ্মনামের এই ঋদ্ধিমানের জন্য আজ শুধু এটুকুই বলি,

‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।’

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.