শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ‘পদ্মা’ বিজয়

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ‘পদ্মা’ বিজয়

মোনায়েম সরকার: ছোটবেলায় আবদুল আলীমের একটি গান শুনতাম আর ভাবতাম পদ্মা নদী কী আসলেই এত ভয়ঙ্কর। সত্যিই কি কোনো কূল-কিনারা নেই? এই নদীর প্রবল স্রোতে কত লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়ি বিলীন হয়েছে, জাহাজ ডুবেছে, মানুষ মরেছে। আজো পদ্মায় বাড়িঘর ভাঙে, জাহাজ ডোবে, মানুষ মরে। কিন্তু আবদুল আলীমের গাওয়া গানের প্রমত্তা পদ্মার সঙ্গে শেখ হাসিনার বাংলাদেশের পদ্মা নদীর আকাশ-পাতাল প্রভেদ। জননেত্রী শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের জনগণকেই সুন্দর সোনালী দিন উপহার দেননি। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ নদ-নদীতেও রেখেছেন সাফল্যের স্বাক্ষর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অসংখ্য সাহসিকতার পরিচয় বাংলাদেশের মানুষ পূর্বে বহুবার দেখেছেন। কিন্তু এবার তিনি প্রমত্তা, কীর্তিনামা, পদ্মার বুকে যে মহান কীর্তি স্থাপন করেছেন, তা দেখে শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের অনেক মানুষই ভাবেননি যে এমন একটি ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ তিনি করে দেখাতে পারবেন, কিন্তু সত্যি কথা হলো এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তব সত্য। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বিজয়ের মাসে আরেক বিজয়ের শুভ সূচনা করলেন বলে জাতির পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশে তার নেতৃত্ব একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে তার সোনার বাংলাকে বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা সেপথেই অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে, ধৈর্য ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে শীঘ্রই আমরা উন্নত বাংলাদেশে পরিণত হবো এতে মানুষের মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি বাংলাদেশের মানুষের স্বাবলম্বীতার প্রতীক। এটি আমাদের ঐক্য ও অটল মনোবলের স্মারক। আমরাও নিজের প্রচেষ্টায় বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিতে পারি, এটা তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক নাটক অভিনীত হয়েছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের উপর অনেক অন্যায় করা সত্ত্বেও আমরা সেই সব বিদেশি প্রভুদের আপত্তি কিছুটা মেনে নিয়েও তা করতে রাজি ছিলাম। কিন্তু যখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারলেন তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা অপরাধ না করেও অপরাধী হয়ে যাচ্ছেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ পশ্চিমা দাতাসংস্থাগুলো তাদের খামখেয়ালি বাস্তবায়ন করে শেখ হাসিনার সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাচ্ছে, তখন শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা দিয়ে এমন এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে বসলেন, যা শুনে বাংলার মানুষ আশ্চর্য হয়ে গেল। তিনি পরিষ্কার করে বলে দিলেন, ‘পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নেই হবে।’ এই ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের মানুষের মনে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই রকমের চিন্তাই উঁকি দিতে থাকে। আস্তে আস্তে প্রমত্তা পদ্মার বুকে একটি একটি পিলার উঠতে থাকে আর তার স্প্র্যান বসতে থাকে।

এভাবেই মানুষের মনে ধীরে ধীরে স্বপ্ন নিয়ে জেগে ওঠে পদ্মা সেতু। ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে শেষ স্প্যানটা বসলে বাস্তবেই পুরো সেতুটি দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এর ফলে নতুন আশায় বুক ভরে ওঠে পদ্মা নদীর দুই পারের মানুষের। সীমাহীন দুর্ভোগ ছিল এতদিন তাদের। এই ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে। এই সেতু শুধু তো সেতুই নয়। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ সকল বাধা অতিক্রম করে দুর্বার বেগে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে অবিচলÑ এই সেতু তারই বিস্ময়কর ঘোষণা।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পাঁচ বছরের নিরলস শ্রমে মাথা তুলে দাঁড়াল এর পরিপূর্ণ কাঠামো। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গাড়ি চলবে, ট্রেন চলবে ২০২৪ সাল নাগাদ। এখন পর্যন্ত এই সেতুর পেছনে ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫.২ কোটি টাকা। এই সেতু চালু হলে দক্ষিণের ২৯টি অবহেলিত জেলা যুক্ত হবে সমগ্র বাংলাদেশের সঙ্গে। প্রকৃত পক্ষেই এটা বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাস যদি আমরা একটু ভালো করে খেয়াল করি, তাহলে দেখবো এই ইতিহাসের সঙ্গে এমন কিছু ঘটনা যুক্ত হয়ে আছে যা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যা যা ঘটেছিল তা-ই হয়েছে। আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণের সৈনিক ছিলাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র কিভাবে বাংলাদেশের বিজয়কে রুদ্ধ করার গোপন চেষ্টায় সর্বদা ব্যস্ত ছিল তা কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টা দূরত্বে ছিল সপ্তম নৌবহর। আমেরিকার পরিকল্পিত যুদ্ধ বিরতির পরিবর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন বার বার ভেটো দিচ্ছিল।

পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটে। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রাথমিকভাবে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়, সেগুলো ভিত্তিহীন ছিল। বাংলাদেশের নোবেল জয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস এই সেতু যেন নির্মাণ হতে না পারে তার জন্য বিদেশি প্রভুদের কাছে বার বার অনুরোধ ও আবদার করেছেন। তার দুষ্কর্মের সব তথ্য সে সময় প্রকাশ করে উইকিলিক্স। যারা উইকিলিক্সের ফাঁস করা সেই তথ্যগুলো দেখেছিলেন তারা সেদিন বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলেন। তার মতো একজন সম্মানী মানুষ কেন পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন?

বাংলার বিরুদ্ধে বাঙালির ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়, একদল বাঙালি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে, আরেক দল বাঙালি সেই জীবনজয়ী যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে বরং ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এটা আমরা পলাশীর প্রাঙ্গণে দেখেছি, দেখেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও। সে সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও সেসব বুদ্ধিহীন কথাবার্তা বলেছেন, তাতেও দুঃখ পেয়েছে দক্ষিণ বাংলার অবহেলিত মানুষ। ‘জোড়াতালি’ দিয়ে যে পৃথিবীর কোনো ‘মেগা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হয় না, এটা সম্ভবত অষ্টমশ্রেণিজ্ঞান খালেদা জিয়ার নেই। থাকলে অমন বুদ্ধিহীন কথা বলে তিনি আজ হাস্যকর হয়ে উঠতেন না।

পদ্মা সেতুর নির্মাণের ফলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরো সবল হবে। অর্থনীতিবিদরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কিভাবে আমাদের জিডিপি ১.৫ থেকে ২ পর্যন্ত উন্নতি হতে পারে। এই সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ বঙ্গের চেহারাই বদলে যাবে, কর্মসংস্থান হবে অসংখ্য মানুষের, ব্যবসা-বাণিজ্যে আসবে নবযুগ। জাতির পিতার সমাধিক্ষেত্রও নির্ঝঞ্ঝাটে দর্শন করতে পারবেন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ। একটি সেতু কিভাবে একটি দেশের এত কিছু বদলে দিতে পারে তা ভেবে প্রতিনিয়তই এখন বাংলাদেশের মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। দেশে এখন করোনা মহামারীর বিপদাশঙ্কা না থাকলে এদেশের মানুষ নিশ্চয়ই গণসংবর্ধনার আয়োজন করে শেখ হাসিনাকে কোনো নতুন গণপদবিতে ভূষিত করতেন। আমরা আশা করব, দ্রুতই করোনার প্রভাব কেটে যাবে, সেই সঙ্গে মহাসমারোহে এগিয়ে যাবে জনতার পদ্মা সেতু ওরফে বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ। 

শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব যে সত্যি সত্যিই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে এদেশের মানুষ সেটা টের পেয়েছে। এখন তারা নেত্রীর জন্য যেকোনো বিজয় ছিনিয়ে আনতে প্রস্তুত। জয়তু শেখ হাসিনা।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.