শ্রদ্ধাঞ্জলি: সংগ্রামমুখর রাজনীতিক মোহাম্মদ নাসিম

শ্রদ্ধাঞ্জলি: সংগ্রামমুখর রাজনীতিক মোহাম্মদ নাসিম

মোনায়েম সরকার: মোহাম্মদ নাসিমের চিরপ্রস্থানের সংবাদটি আমাদের জন্য কতটা মর্মবেদনার তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত বেশ কিছুদিন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমরা এও জানি, নিবিড় পরিচর্যায় তিনি আট দিন ছিলেন সংজ্ঞাহীন। আমরা তার আরোগ্য লাভের আশার পাশাপাশি সশঙ্ক চিত্তে তাও ভাবছিলাম- কখন জানি আসে দুঃসংবাদ। শেষ পর্যন্ত দুর্ভাবনাটাই জীবনে সত্য হয়ে এলো। জাগতিক নিয়মে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবেই তার পরিচিতি গণ্ডিবদ্ধ ছিল না। তার ৭২ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের মধ্যে রাজনীতির অঙ্গনে তিনি প্রায় পাঁচ দশক বিচরণ করেছেন সগর্বে। তার আলোকিত অধ্যায় কম বিস্তৃত নয়। দোষেগুণেই মানুষ। তিনিও তাই ছিলেন। এমন একটা দুর্যোগের সময়ে তিনি গত হলেন যখন আমরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে বৃহৎ পরিসরে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারব না, কোনো শোকালোচনা অনুষ্ঠান করতে পারব না। আমার দীর্ঘদিনের সুহৃদ ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিম এখন কেবলই স্মৃতি। স্মৃতির খাতায় নাম লেখানো মোহাম্মদ নাসিমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার পাশাপাশি রাজনীতিতে তার ত্যাগের বিষয়গুলো প্রজন্মের অনুসরণযোগ্য বলে মনে করি।

তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন স্বাধীন বাংলাদেশে। স্মরণযোগ্য যে, তিনি আওয়ামী লীগের হুইপ থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম লীর সদস্য নাসিম দলের মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি ১৪ দলীয় জোট নেতা হিসেবে এই জোটের মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন রাজনৈতিক অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। তার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি সব সময়ই স্পষ্ট কথার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অভিমত ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। এটা তার বিশেষ একটি গুণ বলা যায়।

ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে তার এ পথে চলা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে যুক্ত হন ছাত্রলীগের সঙ্গে। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র নাসিম পরে বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। জাতীয় চার নেতার অন্যতম, যিনি ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও একজন অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ও স্বাধীনতা-পরবর্তী মন্ত্রিসভার আলোকিতজন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ নাসিম বাবার মতোই ছিলেন আপসহীন ও ত্যাগী একজন রাজনীতিক। ‘৭৫-এর আগস্টের মর্মান্তিক অধ্যায়ের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় আরও তিন নেতার সঙ্গে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হত্যা করে বিপথগামী সেনাসদস্যরা। পিতার মর্মন্তুদ চিরবিদায়ের পর মোহাম্মদ নাসিম রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘৭৫-পরবর্তী সময়ে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কিছুদিন পর কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে তিনি কলকাতায় যান। সেখানে আমরা দু’জন একসঙ্গে অনেক কাজে যুক্ত ছিলাম। পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি অন্য আরও বিষয়ে আমরা কাজ করেছি। মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় যুবলীগে যোগ দেওয়ার পর তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হয় ঘনিষ্ঠতা। সিরাজগঞ্জের কৃতী সন্তান মোহাম্মদ নাসিম তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার থেকে কখনও বিচ্যুত হননি।

ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি অধিকতর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। দল ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভুলত্রুটি যে করেননি তা নয়। তবে সেইসব ভুলত্রুটি তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে শুধরেও নেন। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নানা রকম অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পরিশীলিত হয়ে ওঠার এই কর্মধারাটুকুই অনুসরণীয় হয়ে ওঠে প্রজন্মের কাছে। তাই আমি বলব, প্রজন্মের উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিজেদের পুষ্ট করতে পারেন এমন জনদের অনুসরণের সড়ক ধরে।

তার সাহস, দৃঢ়তা, চিন্তার বলিষ্ঠতা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আন্দোলন-প্রক্রিয়ায় আরও বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। আপসহীনতা তার চরিত্রের আলোচিত বৈশিষ্ট্য। বাবার আপসহীন রাজনীতির অনুশীলন তিনি যথার্থভাবেই করতে সক্ষম হন। ব্যক্তিজীবনে অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী নাসিম কতটা জনপ্রিয় ছিলেন এর প্রমাণ মিলেছে জাতীয় নির্বাচনে কয়েক বার জয়লাভের মধ্য দিয়ে। ১/১১ সরকারের সময় তো বটেই গোটা রাজনৈতিক জীবনজুড়েই খণ্ড খণ্ডভাবে তিনি রাষ্ট্রশক্তির জুলুম সহ্য করেছেন, জেল খেটেছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক জীবনের স্তরে স্তরে ধাপে ধাপে তিনি কঠিন পরীক্ষায় কৃতকার্য হন।

রাজনীতিতে পাঁচ দশকের বেশি পথচলায় দৃষ্টান্তযোগ্য অনেক কিছুই তিনি করে গেছেন। মোহাম্মদ নাসিম সারা জীবন সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন- এ নিয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা মোহাম্মদ নাসিম আন্দোলন-সংগ্রামের সম্মুখভাগেই ছিলেন। তার জনসম্পৃক্ততা ও মানুষের ভালোবাসা রাজনীতিতে তাকে অনন্য স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ছাত্রজীবন থেকেই তার কারাগারে যাওয়া শুরু হয়। তার মধ্যে যে সাহসিকতা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বলিষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয়েছে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে তার রাজনৈতিক কার্যধারায়। আজ শারীরিকভাবে তিনি আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তিনি তার কর্মের জন্য আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। মোহাম্মদ নাসিম এক অনন্য গুণাবলির মানুষ, যিনি ৭২ বছরে শত বছরের কাজ করে গেছেন। তিনি প্রজন্মের চেতনায় চিরভাস্বর থাকুন। এরকম রাজনীতিকের উপস্থিতি সব সময়ই দরকার। একটি কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। তার সংগ্রামমুখর জীবন প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় হয়ে থাকুক।

রাজনীতিক ও কলাম লেখক

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.