চামেলীবাগের ‘খালাম্মা’ : একজন নিভৃতচারী মহিয়সী

চামেলীবাগের ‘খালাম্মা’ : একজন নিভৃতচারী মহিয়সী

সৈয়দ জাহিদ হাসান: (স্মরণ) আগস্ট মাস বাঙালি জাতির জন্য অশ্রুবর্ষণের মাস। বাঙালি জাতি এই আগস্ট মাসে তার অনেক শ্রেষ্ঠসন্তানকে হারিয়েছে। এই শ্রেষ্ঠসন্তানদের মধ্যে আছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নোবেল জয়ী প্রথম বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরো অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। এই আগস্ট মাসের ২৮ তারিখই আমরা হারিয়েছি আরেকজন দেশপ্রেমিক, মানববাদী, দক্ষ সংগঠক, দুঃসময়ের আশ্রয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা রহিমা চৌধুরানীকে। রহিমা চৌধুরানী একজন গৃহবধূ ছিলেন। অত্যন্ত নিভৃতচারী এই মহিয়সী নারী বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে প্রেরণা জুগিয়েছেন তার সঙ্গে কেবল কবি সুফিয়া কামালেরই তুলনা চলে। কেননা এ দুজনেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একই ধরনের।

সুফিয়া কামাল কবি, বুদ্ধিজীবী, সংগঠক ও সমাজনেত্রী ছিলেন। তার এইসব গুণের কারণে তিনি বাংলাদেশে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কবি সুফিয়া কামালের অনেক পরিচয় থাকলেও তার একটি বিশেষ পরিচয় এই যে, তিনি এদেশের সকলের কাছে ‘খালাম্মা’ বলেই পরিচিত ছিলেন। আম্মা যেমন সন্তানকে নিবিড় স্নেহে সুখে-দুঃখে আগলে রাখেন, খালাম্মাও তেমনি করে আদর-মমতায় ভরে দেন বোনের সন্তানকে। সুফিয়া কামাল সমস্ত বাঙালি সন্তানকে তার হৃদয়ের মায়া ও আদরের ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। সুফিয়া খালাম্মার মতোই আরেকজন খালাম্মা ছিলেন ২৩ চামেলীবাগের মিসেস রহিমা চৌধুরানী। পরিণয়সূত্রে তিনি আবদ্ধ হন জমিদারপুত্র আবদুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে। আবদুল হালিম চৌধুরীর মৃত্যুর পরে রহিমা চৌধুরী অঢেল সম্পত্তির মালিক হন। এত বিত্ত-ব্যাসাত থাকতেও তার মনে কোনো অহংকার ছিল না। সম্পদের বিন্দু পরিমাণ গৌরব তার ছিল না। তিনি সারাজীবন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদের সেবা করে গেছেন। শক্তি জুগিয়েছেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে।

রহিমা চৌধুরানী ও ২৩ চামেলীবাগ একাকার হয়ে আছেন অসংখ্য ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডের সূত্রে। ২৩ চামেলীবাগের বাড়িতে যাতায়াত করেননি বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা আঙ্গুলি দ্বারা গণনীয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তিনিও রহিমা চৌধুরানীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন ও জানেন। শুধু তাই নয়, তার হাতের রান্নাও তিনি তৃপ্তি নিয়ে আহার করেছেন। শেখ হাসিনার পরে আরো যাদের কথা বলতে হয় তাদের মধ্যে মতিয়া চৌধুরী, লন্ডন প্রবাসী আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, শওকত ওসমান, প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ, আমিনুল হক বাদশা অগ্রগণ্য। বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃবর্গ, হোক তারা মস্কোপন্থী অথবা পিকিংপন্থী, সবারই অবাধ যাতায়াত ছিল রহিমা চৌধুরানীর বাসায়। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, কাজী জাফর আহমেদ থেকে মণি সিংহ কে-না ভালোবেসেছেন রহিমা চৌধুরানী খালাম্মাকে।

উদীচী নামের যেই সংগঠনটি এখন বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে সেই সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল রহিমা চৌধুরানীর বাসায়। শুধু উদীচী কেন? নারী প্রগতি সংঘের জন্মও হয় রহিমা চৌধুরানীর ২৩ চামেলীবাগের স্বগৃহে। তিনি নারী প্রগতি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক দেশবন্ধুপত্রিকার প্রকাশক ছিলেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণও এই বাড়ি থেকে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।     

ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনের এক পর্যায়ে আমেনা বেগম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমেনা বেগমের সঙ্গেও রহিমা চৌধুরানীর গভীর সখ্য ছিল। আমেনা বেগম রহিমা চৌধুরানীর কাছে আসতেন এবং প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যও গ্রহণ করতেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রহিমা চৌধুরানী অসামান্য অবদান রাখেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে রাজারবাগে বাঙালি সৈনিকেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে রাজারবাগের দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা পালাতে বাধ্য হন। তখন তারা অনেকেই রহিমা চৌধুরানীর বাসার ইঁদারার মধ্যে রাইফেল রেখে নিরাপদ স্থানে চলে যান। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে জাসদের ক্যাডাররা হামলা চালায় তার বাসায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা লুট করে রহিমা চৌধুরানীর বাড়ি। তাতে অনেক টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার খোয়া যায়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তাকে ও তার পুত্র আবদুর রহিম চৌধুরীকে। পরে তাদের সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হয়। রেখে দেওয়া হয় তাদের লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও বন্দুক। পরে অবশ্য রিভলবারও ফেরত দেয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। জীবনে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাকে ও তার পরিবারকে। তবু দেশসেবার ব্রত থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেননি তিনি। বরং তার দেশপ্রেম ও  দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা হৃদয়ে চির বহমান ছিল।

রহিমা চৌধুরানী তার জীবদ্দশায় রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজের উন্নয়নসহ অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর)-কে তার স্মৃতিবিজড়িত ২৩ চামেলীবাগের বাসার ৫০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট স্বেচ্ছায় দান করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন দেশবরেণ্য সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও লেখক-গবেষক-কলামিস্ট মোনায়েম সরকার। এখনো বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন থিংক ট্রাংকহিসেবে নিরলসভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম এবং উন্নয়ন বিষয়ক নানা গবেষণা করে যাচ্ছে।

রহিমা চৌধুরানী দীর্ঘজীবী (৯৬ বছর) হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগের পর্যন্ত তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয় তাকে খুব কাছ থেকে দেখার । তাকে যতটুকু দেখেছি এবং বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে তার অকালপ্রয়াণ বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট ক্ষতির কারণ। তার মৃতদেহ শেষবারের মতো দেখার জন্য এদেশের অনেক গুণীজন ২৮ আগস্ট, ২০১৭ তার বাসভবনে এসেছিলেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে আমি নিজে তার জন্য অঝরে অশ্রু বিসর্জন করতে দেখেছি। তার শবযাত্রার সাথী হয়ে আমি যখন টাঙ্গাইল জেলার, ঘাটাইল উপজেলার দীঘলকান্দি গ্রামে যাই তখন রাত প্রায় আটটা বাজে। বন্যাদুর্গত দীঘলকান্দি গ্রামে রাত আটটা মানে অনেক রাতই বলতে হয়। অত রাতেও তার জানাজায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু এসে শরিক হয়। একজন নারীর জানাজায় এত রাতে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি জানিয়ে দেয় মানুষ হিসেবে মানুষের কাছে তিনি কত প্রিয় ছিলেন। তিনি দয়াময়ী ও পরোপকারী ছিলেন। স্বাধীনতার পরে মণি সিংয়ের স্ত্রী অনিমা সিং একবার তার কাছে এক হাজার টাকা ধার চান। অনিমা সিংয়ের পুত্র মস্কো যাওয়ার জন্য গরম পোশাক কিনবেন বলে ওই টাকার দরকার ছিল। এই কথা শোনার পরে খালাম্মা সঙ্গে সঙ্গে অনিমা সিংকে এক হাজার টাকা বের করে দেন। তবে ধার হিসেবে নয়, একজন সন্তানের মা হিসেবে তিনি এই টাকা সন্তানকে উপহার দেন।

শ্রদ্ধাভাজন মোনায়েম সরকারের কাছে রহিমা চৌধুরানী ছিলেন মাতৃসমা। তার কাছে রহিমা চৌধুরানীর অনেক গল্প শুনেছি। তার একটি হলো বিশিষ্ট কলামিস্ট ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী বিষয়ক। আবদুল গাফফার চৌধুরী রহিমা চৌধুরানীকে নিয়ে মাক্সিম গোর্কির মাউপন্যাসের মতো একটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছেন। তার মতো একজন বিরলপ্রজ কথাশিল্পী যদি রহিমা চৌধুরানীকে উপন্যাসের উপজীব্য করেন, নিঃসন্দেহে তাতে অনেক অজানা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকবে। আমরা আশা করবো আবদুল গাফফার চৌধুরী দ্রুত তার পরিকল্পিত উপন্যাসটি সমাপ্ত করে পাঠকের সামনে তুলে ধরবেন।

একবার রহিমা চৌধুরানী তার এলাকার মানুষদের অনুরোধে একটি রাস্তার আবেদন নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে যান। জিল্লুর রহমান তাকে দেখেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান এবং তিনি বিনীতভাবে জানতে চান খালাম্মা কি জন্য এসেছেন। তখন তিনি রাস্তার দাবি জানালে সঙ্গে সঙ্গে জিল্লুর রহমান যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এমনি আরো অসংখ্য ঘটনা আছে রহিমা চৌধুরানী খালাম্মাকে নিয়ে, যা ছোট খাটো নিবন্ধে ধারণ করা কঠিন।

মৃত্যুর আটদিন পরে রহিমা চৌধুরানী খালাম্মাকে নিয়ে স্মরণসভার আয়োজন করে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ। সেই স্মরণসভায় দেশের অনেক নামি-দামি লোক উপস্থিত হয়ে খালাম্মাকে স্মরণ করেন। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, লতিফ সিদ্দিকী, হাসান ইমাম, এম. সাইদুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম, ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, ওসমান গনি প্রমুখও। স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন এমিরেটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি ঘরোয়াভাবে হলেও শেষ পর্যন্ত তার কলেবর আর ঘরোয়া থাকেনি, সেটা রূপ নিয়েছিল বৃহৎ সভায়। রহিমা চৌধুরানী এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যার নামে সাধারণ অনুষ্ঠান করলেও তা পরিণত হয় জনসভায়।

কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা সামান্য আয়ু দিয়ে এমন সব অসামান্য কাজ করেন যে, এই জন্য পৃথিবীর মানুষ তাদের কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকেন। এরকমের লোকের সংখ্যা কম হলেও সব যুগে, সব দেশেই এ রকম ক্ষণজন্মা, মহৎপ্রাণ মানুষেরা জন্মগ্রহণ করেন। রহিমা চৌধুরানী ছিলেন এমনই একজন ক্ষণজন্মা মহৎপ্রাণ নারী। যার মৃত্যুতে মৃত্যুই হেরে গেছে, মৃতুঞ্জয় হয়েছেন তিনি। এমন এক অনির্বাণ, মহিয়সী নারীকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

-লেখক : কথাসাহিত্যিক

 

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.