সাক্ষাৎকারে দাবাড়ু শারমীন সুলতানা শিরিন

সাক্ষাৎকারে দাবাড়ু শারমীন সুলতানা শিরিন

‘একা থাকি, গম্ভীর থাকি, আগের রাতে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকার চেষ্টা করি’

 

দাবা-২বাংলাদেশের মহিলা দাবা মানেই রানী হামিদ। এ কিংবদন্তি দাবাড়ুর পর অমিত সম্ভাবনা নিয়ে আর্বিভূত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু সময়ের আবর্তে হারিয়ে গেছেন এদের বেশিরভাগই। যারা হারিয়ে যেতে চান না, তাদের মধ্যে শারমীন সুলতানা শিরিন একজন। ২৪ বছর বয়সী এ তরুণী দাবাড়ু নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উঠে এসেছেন একটা পর্যায় পর্যন্ত। কদিন আগে দেশের ষষ্ঠ মহিলা ফিদেমাস্টার হিসেবে ঘোষিত হয় তাঁর নাম (আগের পাঁচজন হলেন, সৈয়দা শাবানা পারভীন নিপা, আফরোজা খানম বাবলী, তনিমা পারভীন, জাকিয়া সুলতানা এবং নাজরানা খান ইভা)। শিরিন এগিয়ে যেতে চান অনেকদূর। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রতিকূলতা অনেক। দাবার সমস্যা, প্রতিকার, সম্ভাবনা, নিজের লক্ষ্য, উপদেশ, পরামর্শ, ব্যাখ্যা, ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়, ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন রুমেল খান

 

 

পৈ ত্রিক নিবাস বাগেরহাটে। বর্তমান নিবাস নারায়ণগঞ্জে। এখানেই শিরিনের জন্ম ১৯৮৯ সালের ২৬ জানুয়ারি। বাবা মরহুম শাহ আলম। ২০০২ সালে তিনি মারা যান। মা মর্জিনা আলম, গৃহিণী। শিরিনরা দুই বোন। তিনি ছোট। বড় বোন আফরোজা সুলতানা। দু’বোনই বিবাহিতা। শিরিন বিয়ে করেছেন এ বছরের মার্চে। স্বামী মাসুম খান, হেলথ কেয়ার কর্মকর্তা। ডিগ্রী পাস করে শিরিন এখন মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায়।

যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন, তখন মহিলা ক্রীড়া সংস্থা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার যৌথ উদ্যোগে দাবা কর্মশালার কার্যক্রমে শিরিন অংশ নেন অনেকটা শখের বশেই। এভাবেই দাবার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। দাবাড়ু না হলে ইঞ্জিনিয়ার হতেন (অবশ্য কি ধরনের ইঞ্জিনিয়ার, সেটা বলতে পারেননি!)।

২০০০ সালে ‘টেলিগ্রাফ স্কুল দাবা দিয়ে’ ক্যারিয়ার শুরু করেন শিরিন (এটা আবার তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টও)। হয়েছিলেন রানার্সআপ। ২০০২ সালে স্কুল দাবা দিয়ে শুরু করেছিলেন জাতীয় পর্যায়ে খেলা। এখানে অবশ্য রেজাল্ট ভাল ছিল না। পেয়েছিলেন মাত্র আধা পয়েন্ট!

এ পর্যন্ত দাবা ক্যারিয়ারে শিরিনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো,  ২০০১ সালে স্কুল দাবায় ও মহিলা উন্মুক্ত দাবায় রানার্সআপ, ২০০৭ ও ২০১০ সালে জাতীয় দাবায় রানার্সআপ এবং ২০০৯ ও ২০১৩ সালে জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া।

দাবা খেলার ব্যাপারে নিজ পরিবার থেকে সমর্থন, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, যাই বলা হোক না কেন, সবই পেয়েছিলেন শিরিন, ‘বিশেষ করে আমার প্রয়াত বাবাই আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। নইলে তো দাবাই খেলতে পারতাম না।’

রানী হামিদের পর এদেশে মহিলা দাবাড়ুরা সেভাবে উঠে আসতে পারছে না কেন? শিরিনের ব্যাখ্যা, ‘রানী আন্টির বিষয়টি আলাদা। তিনি আপাদমস্তক স্পোর্টস ফ্যামিলির মেয়ে। কিন্তু অন্যদের অবস্থা তো তাঁর মতো নয়। সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক… তাদের অনেক সমস্যা। তারা আসলে সেভাবে কোন সাপোর্ট পাচ্ছে না। এগিয়ে আসছে না স্পন্সররা। তাছাড়া মেয়েরাও দাবা খেলার প্রতি সেভাবে সংকল্পবদ্ধ নয়। যারা খেলছে, তারা নিজের আগ্রহেই খেলছে। তবে তাদের সংখ্যা অল্প।’

এখনকার মেয়েদের মধ্যে তানজিদা আক্তার তানিকে সম্ভাবনাময় দাবাড়ু বলে মনে করেন শিরিন।

খেলায় নিমগ্ন শিরিন

খেলায় নিমগ্ন শিরিন

দাবা ফেডারেশন থেকে সাহায্য-সহযোগিতা-সুবিধা পাওয়া প্রসঙ্গে শিরিন বলেন, ‘আমরা আসলে নিজেদের উদ্যোগেই এ পর্যন্ত এসেছি। ফেডারেশন থেকে তেমন সাহায্য পাচ্ছি না। তেমন কোন ট্রেনিং পাই না। উল্লেখযোগ্য হারে টুর্নামেন্ট হয় না। দাবাড়ুদের খেলার মান উন্নয়নে দরকার দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ। এর কোন বিকল্প নেই। আমরা তো বিদেশী কোচ চাচ্ছি না। দেশে যারা গ্র্যান্ডমাস্টার আছেন (নিয়াজ মোরশেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আব্দুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব), তাঁরাই যদি আমাদের কোচিং করান, তাহলে সবাই অনেক উপকৃত হতো।’

নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে শিরিনের লক্ষ্য, ‘আমার পরবর্তী টার্গেট প্রথমে মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়া ও পরে মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। সেই পর্যন্ত খেলাটা চালিয়ে যেতে চাই (এখন শিরিনের বর্তমান রেটিং ২০০৫)।’

বাংলাদেশের মহিলা দাবার ভবিষ্যত সম্পর্কে শিরিনের ভাষ্য, ‘আমরা যখন শুরু করি, তখন এ খেলায় তেমন সুযোগ-সুবিধা পেতাম না। এখন কিছুটা হলেও পাচ্ছি। ভবিষ্যতে সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়বে বলে আমি আশাবাদী। যদিও এ খেলাকে এখনও পেশা হিসেবে নিতে পারিনি আমরা।’

‘একা থাকি, গম্ভীর থাকি, আগের রাতে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকার চেষ্টা করি।’ খেলার আগে এভাবেই মনোসংযোগ করার বর্ণনা দিলেন শিরিন। তাঁর পরামর্শ, ‘দাবা খেলাকে এদেশে জনপ্রিয় করতে দাবা ফেডারেশনের উচিত প্রচার বাড়ানো, জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোকে সক্রিয় হওয়া, দেশব্যাপী বেশি বেশি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা এবং স্পন্সরদের এগিয়ে আসা।’ দাবাড়ু হিসেবে কাকে কঠিন প্রতিপক্ষ মনে হয়? ‘সেটা নির্ভর করে টুর্নামেন্টের ধরন অনুযায়ী। তবে শামীমা আক্তার লিজার নাম বলতে পারি (রানী হামিদের পর দেশের দ্বিতীয় মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার)।’

দাবা খেলার সুবাদে এ পর্যন্ত ছয়টি দেশে গিয়েছেন শিরিন। এগুলো হলো, ভারত, তুরস্ক, ফিলিপিন্স, রাশিয়া, চীন ও শ্রীলঙ্কা। শিরিনের আদর্শ দাবাড়ু অনেক, ভ্লাদিমির ক্রামনিক, আলেক্সান্ডার গ্রিস্চুক, ভাসিলি ইভানচুক এবং জুডিথ পোলগার (এদের সবাইকে সামনাসামনি দেখলেও ব্যস্ততার কারণে তাঁদের কাছ থেকে কোন টিপস নেয়া হয়নি শিরিনের)।

ভাল দাবাড়ু হতে গেলে কি কি গুণ থাকা উচিত? ‘ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস আর প্রচুর প্র্যাকটিস। পাজল সল্ভ করার অভ্যাস থাকলে ভাল হয়।’ দাবা কি পুরোটাই বুদ্ধির ও মানসিক খেলা? ‘দাবা খেলাটা বেশিরভাগই মানসিক। তবে শরীরটাও সুস্থ রাখা জরুরী।’ শিরিনের উত্তর। যেসব মেয়ে দাবায় আসতে চায়, তাদের প্রতি শিরিনের উপদেশ, ‘প্রচুর টুর্নামেন্ট খেলতে হবে। নইলে নিজের অবস্থান সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যাবে না।’ শিরিনের পরবর্তী দাবা আসর এ মাসের ১২ তারিখে ‘রেটিং দাবা’ এবং ২৮ তারিখে ‘এশিয়াড ইনডোর গেমস দাবা প্রতিযোগিতা।’

অবসরে গল্পের বই পড়ে আর টিভি দেখেই সময় কাটে শিরিনের। হাসতে হাসতে আরও জানালেন, রান্না বা কান্না কোনটাই এক্সপার্ট নন তিনি! তাঁর প্রিয় বিষয়গুলো হচ্ছে, বন্ধু, বড় বোন আফরোজা, লেখক-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ফুল-বেলী, ফল-পেয়ারা, মাছ, ইলিশ, রং-সাদা, খাবার-বিরিয়ানি, বেড়ানোর প্রিয় স্থান-কক্সবাজার, পোশাক-প্যান্ট ও টি-শার্ট, অন্য প্রিয় খেলা-ক্রিকেট, খেলোয়াড়-শাকিব আল হাসান, অভিনয়শিল্পী-রাজ্জাক ও শাবানা, কণ্ঠশিল্পী-সামিনা চৌধুরী, সুবীর নন্দী, সৈয়দ আব্দুল হাদী ও বাপ্পা মজুমদার। কুম্ভ রাশির জাতিকা শিরিন তেলাপোকা দেখলে বেজায় ভয় পান! কাউকে ভুল করতে দেখলে মেজাজ খারাপ হয় তাঁর। প্রিয় ব্যক্তিত্ব? তিনি নিজেই!

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.