মোনায়েম সরকার: গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে সামরিক অভিযান শুরু করেছিলেন, তার শেষ কীভাবে ঘটবে তা এখন আর কারো পক্ষে বলা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেন ছোট রাষ্ট্র। রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বেশি হওয়ায় ধারণা করা হয়েছিল, ইউক্রেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরাভূত হবে, রাশিয়া বিজয়ীর হাসি হাসবে। কিন্তু এক বছর পরে এসে কোন পক্ষ জয়ী হবে তা কোনো সমরবিশারদও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। রাশিয়া সামরিক শক্তিতে যতটা বলীয়ান বলে মনে করা হচ্ছিল, আসলে যে ততটা নয়Ñ সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে। রুশ বাহিনী আধুনিক যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত নয় বলে এখন মনে করা হচ্ছে। আবার ইউক্রেন আমেরিকাসহ ন্যাটোভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে, তা-ও হয়তো আগে সেভাবে ভাবা হয়নি। এক বছরে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে রাশিয়া লড়ছে প্রায় একা, আর ইউক্রেনের পাশে আছে মার্কিন নেতৃত্বে বাকি অনেক দেশ। পুতিনের হিসাবে যে ভুল ছিল তা অস্বীকার করা যাবে না। পশ্চিমা জোটে বিরোধ তৈরি করতে গিয়ে তিনি তাকে আরো ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করতে সাহায্য করলেন।
এক বছরের যুদ্ধে উভয় পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কার ক্ষতি বেশি হয়েছে, কার কম, সে বিতর্কে না গিয়ে এটা বলাই বরং ভালো যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু ওই দুটি দেশের মধ্যেই সীমিত নেই, এটা গোটা বিশ্বের ভোগান্তির কারণ হয়েছে। এই যুদ্ধের কারণে ভূ-রাজনৈতিক গতিধারায়ও জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করছে। ইউরোপে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কার পাশাপাশি পারমাণবিক যুদ্ধের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরেই পুতিন বলেছিলেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে আঞ্চলিক সংঘাতকে বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার অভিযোগ আমেরিকার বিরুদ্ধে তুলেছেন পুতিন। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর বর্ষপূর্তির একদিন আগে পুতিন বলেছেন, পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধিতে রাশিয়ার বর্ধিত মনোযোগ ধরে রাখবেন।
অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো মিত্ররা মিলে ইউক্রেনে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর প্রতিটি ইঞ্চি সুরক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু ন্যাটোর সম্প্রসারণকে মস্কো তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। শিগগিরই রাশিয়ার প্রতিবেশী সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটো জোটে যোগ দিতে পারে বলে প্রচার আছে। মস্কোকে নিশানা করে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঝুঁকি রোধের জন্যই পুতিন এই যুদ্ধে গেছেন বলে ধারণা করা হয়।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, এই যুদ্ধ অনায়াসে এড়ানো যেতো, যদি মার্কিন প্রশাসন এবং ন্যাটো ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার স্বাভাবিক নিরাপত্তা-উদ্বেগকে মেনে নিতো। ন্যাটো ইউক্রেনকে তার সদস্য করতে চাইছে, যার অর্থ রুশ সীমান্তে থাকবে মার্কিন এবং ন্যাটোর বাহিনী, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র! নাকের ডগায় এমন বিপদ নিয়ে রাশিয়া নিরুদ্বেগ থাকে কীভাবে?
২০২১ সালের বর্ষশেষের সাংবাদিক বৈঠকেও পুতিন সরাসরি প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন : ‘আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, পূর্ব দিকে ন্যাটোর আর কোনো অগ্রগতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা কী মার্কিন সীমান্তের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে গিয়েছি? না, আমরা তো যাইনি। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘরে এসেছে, দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দোরগোড়ায়। আমাদের ঘরের কাছে কোনো আঘাত করার ব্যবস্থা রাখা যাবে না, এই দাবি করা কী তাহলে ভুল হবে, খুব অস্বাভাবিক হবে?’
সোভিয়েত পতনের এক বছর আগে, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকার রাশিয়ার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘ন্যাটো পূর্বদিকে এক ইঞ্চি-ও এগোবে না, যদি মস্কো দুই জার্মানির মিলনে সম্মতি দেয়’। পূর্বদিকে এক ইঞ্চি-ও নয় অর্থ : পূর্ব বার্লিনের পূর্বে ‘এক ইঞ্চিও এগোবে না’ ন্যাটো। সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচেভ সেই চুক্তিতে সহমত হয়েছিলেন। কিন্তু ওযাশিংটন তার কথা রাখেনি। আমেরিকার বিশ্বজুড়ে মোড়লপনার আকাক্সক্ষার জন্যই রাশিয়া এই যুদ্ধে জড়িয়েছে মনে করার তাই যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় সবাই আশা করেছিলেন, এবারে ন্যাটোকে গুটিয়ে নেওয়া হবে। কারণ যে উদ্দেশে ন্যাটো তৈরি করা হয়েছিল, সেই সোভিয়েত ইউনিয়নই আর নেই। তাছাড়া, ন্যাটোর মোকাবিলার লক্ষ্যে যে ওয়ারশ চুক্তি হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইওরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিপর্যয়ের পর তারই যখন অবসান হয়েছে, তখন ন্যাটোর প্রাসঙ্গিকতা আর কোথায়? ধাপে ধাপে নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি কমানোর চুক্তিও সই হয়ে গিয়েছে। সেকারণে স্বাভাবিক ভাবনা ছিল ন্যাটোর আর কোনো প্রয়োজন নেই।
ঠা-া যুদ্ধের অবসানের পর পেরিয়ে গিয়েছে তিন দশক। এরপরও ন্যাটোকে কেন সম্প্রসারিত করা হচ্ছে? ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে কেন সে নিজেকে সম্প্রসারিত করে চলেছে? ওয়ারশ নেই, তবে ন্যাটো কেন? আজ সোভিয়েত নেই, তাহলে শত্রু কে?
লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং এস্তোনিয়ার মতো বাল্টিক রাষ্ট্রসহ পোলান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেক সাধারণতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, স্লোভানিয়া, রোমানিয়ার মতো পূর্ব ইওরোপের সাবেক ‘সোভিয়েত’ সাধারণতন্ত্রগুলোর অধিকাংশই এখন ন্যাটোর শৃঙ্খলে। যুগোস্লভিয়ার উপর বর্বর বোমাবর্ষণসহ ন্যাটো একাধিক যুদ্ধ চালিয়েছে বলকান অঞ্চলে। আর এখন রাশিয়া সীমান্তে ইউক্রেন, জর্জিয়াকে তাদের সদস্য করতে চাইছে।
১৯৯০ থেকে ন্যাটো আজ বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সদস্য সংখ্যা ষোল থেকে বেড়ে এখন ৩০। পূর্ব ইউরোপ, বলকান ছাড়িয়ে এমনকি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে আফ্রিকায় এবং মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায়। আফগানিস্তানে ন্যাটোর বর্বরতা দেখেছে গোটা দুনিয়া। ন্যাটো অর্থাৎ নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন। কোথায় উত্তর আটলান্টিক আর কোথায় কাবুল!
কেন লাগাতার যুদ্ধের প্ররোচনা দিয়ে গেল ওয়াশিংটন, লন্ডন?
‘শান্তিপূর্ণ পথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ডনবাস সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত’ বলে দাবি জানিয়েছিলেন ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পেত্রো সিমোনেঙ্কো। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘গত সাত বছর ধরে নিরাপত্তা পরিষদ কেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতিকে একবারের জন্যও আমন্ত্রণ জানালো না, যাতে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য তিনি কী করেছেন, তা নিয়ে রিপোর্ট করতে পারেন? কেন একের পর এক সমরাস্ত্র-বোঝাই মার্কিন ও ব্রিটিশ বিমান কিয়েভে (ইউক্রেনের রাজধানী) নামছে? ওরা কী আদৌ শান্তি চায়?
পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম রাশিয়ার নেতা পুতিনকে এককভাবে ইউক্রেন অভিযানের জন্য দায়ী করে আমেরিকাসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাব আড়াল করতে চায়। কিন্তু এভাবে কি সত্যকে চেপে রাখা যায়? ন্যাটো তথা তার মুরুব্বি আমেরিকা যদি ইউক্রেনকে অঢেল সামরিক ও আর্থিক সহায়তা না দিত, তাহলে কি ইউক্রেন এতদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতো? রাশিয়া অতটা শক্তিশালী না হলেও আবার অতটা দুর্বলও নয়। তাই রাশিয়াকে যারা খারিজ করে দিতে চান, তারা ঠিক পথে হাঁটছে না। এক বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ এখন রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। একবছরে যে সাফল্য আসেনি তা আর কতদিনে আসবে তা অনিশ্চিত হলেও রাশিয়া কৌশল বদল করে ইউক্রেন অভিযানে নতুন গতিবেগ সঞ্চার করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইউক্রেনকে এক বছরে ৫ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলো। অন্যদিকে যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে বহুল আলোচিত লেপার্ড-২ ট্যাংকের প্রথম চালান ইউক্রেনে পৌঁছেছে। এসব আধুনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহ করে ইউক্রেনের সক্ষমতা বাড়িয়ে পশ্চিমারা নিজেদের অস্ত্রের বাজার প্রসারিত করছে আর শান্তির পরিবেশ সংকুচিত করে তুলছে।
আমেরিকা তার দেশের মারণাস্ত্র বিক্রির জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে চায়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলেও তার ক্ষতি নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ভুখ-ে কোনো যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে আমেরিকার ভুখ- নিরাপদ থাকবে না, কারণ ইন্টারকন্টিনেন্টাল বেলাস্টিক মিসাইল এখন প্রায় সব দেশের হাতে আছে
এরমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়ে ১২ দফা শান্তি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দুই পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা ধারাবাহিক প্রশমনের মধ্য দিয়েই শান্তির পথ খুলবে। যুদ্ধ করে কারো লাভ নেই উল্লেখ করে চীনের প্রস্তাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপ করা পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে মানবিক করিডর স্থাপন এবং ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি নিশ্চিতের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন চীনের দেওয়া শান্তি প্রস্তাবকে অন্যায্য বলে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এই প্রস্তাবে শুধু রাশিয়া উপকৃত হবে। রাশিয়াকে চীন অস্ত্র সরবরাহ করলে কঠোর নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হবে বলেও হুশিয়ারি দেন। রুশ-ইউক্রেন ইস্যুতে চীন ও ভারতের কৌশলগত অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যদি নতুন উচ্চতায় ওঠে তাহলে আমেরিকার জন্য তা অবশ্যই মাথা ব্যথার কারণ হবে। রাশিয়ার সঙ্গে চীন ও ভারত এক মত হয়ে চললে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তার নতুন প্রভাব পড়বে।
মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩