আমাদের আশেপাশের অনেক মানুষই থাকেন আমাদের অধরা, আমাদের আত্মামিলের ধরাছোয়ার বাইরে। এই মানুষটিও এমন, অনেকের কাছেই ছিলেন খুবই গতানুগতিক, সাধারণ একজন মানুষ, তবু অসাধারনত্ব কতদিনই আর চাপিয়ে রাখা যায়!
গত সোমবার ভারতের রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সম্মানিত করল তাকে ভারতরাষ্ট্র, তাও যে সে সম্মানে নয় ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “পদ্মশ্রী” সম্মানে ভূষিত হলেন তিনি। অবাক হচ্ছেন? গ্রামের এই ছাপোষা সাধারণ মানুষটি কি করে এই সম্মানের অধিকারী হলেন ?
৩১ শে মার্চ ১৯৫০ সালে উড়িষ্যার ‘বরগড়’ জেলার ‘ঘেস’ গ্রামে একটি হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই মানুষটি। মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় ক্লাস থ্রি পাস করেই পড়া ছেড়ে দিতে হয় তাকে। পরিবারের মুখে ভাত তুলে দিতে সেই ঘেস গ্রামেই হাই স্কুলের হোস্টেলে রাঁধুনি হিসেবে তার জীবনসংগ্রাম শুরু করেন।
এই কাজের সময়ই তার সঙ্গে পরিচয় হয় মালতি নামে একটি মেয়ের, যে সেই হোস্টেলেই তাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে আসত। ধীরে ধীরে মালতিকে ভাল লেগে যায় তার। মালতি বেশ সুন্দরী হওয়ায় মুখে ভালবাসার কথা বলতে না পারলেও রান্নাঘরের দেয়ালে কয়লা দিয়ে কবিতা লিখে মালতিকে ভালবাসার কথা বোঝাতে চাইতেন তিনি। রান্না ঘরের দেয়াল ভরে উঠত শত শত কবিতায়। শেষে এই লাজুক প্রেমিকটির মনের গভীরতা ভাল লেগে যায় মালতির, বিয়েও করেন। সংসার বড় হয়, আসে তাদের ভালবাসার প্রাপ্তি মেয়ে নন্দিনী।
স্কুলের শিক্ষকদের পরামর্শে স্কুল গেটের পাশে একটি ছোট বইখাতার দোকান খোলেন তিনি, ছেড়ে দেন রান্নার কাজ। এই প্রথম কলম হাতে ওঠে তার, আর সাদা পৃষ্ঠার তো কোন অভাব ছিল না দোকানে; শুরু হয় পুরোদমে কবিতা লেখা। “কোশলি” ভাষায় কবিতা লিখতেন তিনি। সেই শুরু তার প্রথম কবিতা “ধোদো বড়গাছ” (বুড়ো বটগাছ) প্রকাশ পায় ১৯৯০ সালে।
এরপর “ভাব”, “সুরুত” একে একে শত শত কবিতা প্রকাশ পায় তার। লিখে ফেলেন কোশলি ভাষায় ‘আচিয়া’, ‘বাছার’, ‘মহাসতী উর্মিলা’, ‘তারা মন্দোদরী’, ‘শিরি সামালাই’, ‘প্রেম পইচান’, ‘বীর সুরেন্দ্র সাই’, ‘শান্ত কবি বিমাভাই’, ‘রুশি কবি গঙ্গাধর’ ইত্যাদি ২০ টি মহাকাব্য। ভারতের ইতিহাসের ১৬ জনপদের একটি “কোশল রাজ্যে”র ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন উৎকৃষ্ট মহাকাব্য আর কেউ লেখেননি কোনদিন।
এই মানুষটির লেখা হাজার হাজার কবিতাগুলি কোশলি কাব্যসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। কোশল প্রদেশের মানুষ তথা উড়িষ্যার মানুষ “কোশল কুইলি”, “যাদব কুলগৌরব”, “যাদবজ্যোতি” “কোশলরত্ন” ইত্যাদি নামে ভূষিত করেছেন তাকে। তার লেখাগুলি নিয়ে দেশে বিদেশে এখনও পর্যন্ত ৫ জন মানুষ “পিএইচডি” করেছেন, এবং ১৪ জন স্কলার এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালে তিনি “উড়িষ্যা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার” পেয়েছেন। তার সেই বইখাতার স্টলটি এখন তার গুণমুগ্ধ স্কলারদের কাছে মন্দির স্বরূপ। উড়িষ্যা সরকার সংরক্ষণ করেছে সেটিকে।
এই অতি সাধারণ মানুষটির নাম “হলধর নাগ”।
সম্বলপুরী-কোশলি ভাষায় সাধারণ গ্রাম জীবনের মানুষের দুঃখবেদনার কথা, ভালবাসার কথা, প্রতিবাদের কথা, অতীত গৌরবের কথা, ধর্মের কথা- এতো সুন্দর আঙ্গিকে এর আগে কেউ তুলে ধরতে পারে নি। তার লেখার কৌশল একটি নতুন কাব্য ধারা তৈরি করেছে যেটি তার নাম অনুযায়ী “হলধর ধারা” হিসেবে পরিচিত। তার কাব্যগুলি সঙ্কলিত করে প্রকাশিত হয়েছে “হলধর গ্রন্থাবলী” এবং “হলধর গ্রন্থাবলি-২”। এই বইগুলি সম্বলপুর ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স সিলেবাসের পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে।
“লোক কবিরত্ন হলধর নাগ” আপনাকে এমন সম্মান দিতে পেরে ভারতরাষ্ট্র গর্বিত। ফেসবুক আড্ডা থেকে পূর্নলিখিত।