মোনায়েম সরকারঃ আজ আমি ছিয়াত্তরে পা দিলাম। আমার জন্মের পর ছিয়াত্তর বার সূর্যকে পরিভ্রমণ করেছে পৃথিবী। মহাকালকে যদি প্রশ্ন করা হয় সে হয়তো বলবে এ তেমন কোনো দীর্ঘ সময় নয়, কিন্তু আমি জানি আজ আমার জীবনসূর্য এগিয়ে চলছে পূর্ণতার দিকে। আমার জন্ম হয়েছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধে। সাল তারিখের হিসেবে ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ। দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধের অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ও ভয়াবহতা আমি প্রত্যক্ষ না করলেও আমার শৈশব ও কৈশোরে এর প্রভাব ছিল ভয়াবহ। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, ক্ষমতার দ্বদ্ব, শোষণ-তোষণ, অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা, অনেক কিছুই আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কিছু উপলব্ধি করেছি পরোক্ষভাবে। ছোট্ট এই জীবনে আমি অনেক বাধা পেরিয়েছি। অপরূপ বাংলার সোনাডাঙ্গা মাঠ ছাড়িয়ে, গোমতি পার হয়ে, ময়নামতি সেনানিবাসের পাশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত শত শত সৈনিকের সমাধির পাশ দিয়ে পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আমার জন্ম, বেড়ে উঠেছিলাম পরাধীন পাকিস্তানি শাসনে। তাই যুগের দাবি মেনে নির্ভীক যৌবনে আমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায়। আমার বিশ্বাস ছিল শোষণ ও বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে একমাত্র সমাজতন্ত্রই মানুষকে দিতে পারে সুন্দর ও সুখী জীবনের নিশ্চয়তা। দেশে দেশে তখন ত্বরান্বিত হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, দারুণ এক স্বপ্নময় সময়। বিশেষ করে ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্ল¬ব স্বাপ্নিক মানুষের মধ্যে যে আশাবাদের সূচনা করে, তার মোহনীয় আবেদন ছিল আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য। কিন্তু সমাজতন্ত্র কায়েমের যাত্রাপথে নানা অঘটন অনেকের মতো আমাকেও উদ্বিগ্ন করে তোলে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে রাশিয়ায় দুই কোটি মানুষের জীবন বলিদান। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চীনে, সেখানেও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল তিন কোটি মানুষকে। যে সমাজতন্ত্র মানুষের জন্য সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের মহামন্ত্র নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে অবতীর্ণ হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তার রক্তাক্ত মুখশ্রী দেখে অনেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানে যেমন রুশ বিপ্লবের ভূমিকা ছিল, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্যও দায়ী ছিল তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পার্টি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন প্রসঙ্গে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিএন হাকসার একটি পত্রে আমাকে লিখেছিলেন, The Soviet Union built no institutions except the Communist Party, Central Committee, Polit Bureau and General Secretary. পার্টিই যদি জীবনের সবকিছুকে নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে মানুষের জীবন যান্ত্রিক হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই ঘটনাই ঘটেছিল।
১৯৩০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠিতে আমরা তার আভাস পাই,
রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে। …
এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে, কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না, সজীব মনের তত্তে¡র সঙ্গে বিদ্যার তত্ত¡ যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।
আদিমকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে, সমাজে একদল মানুষ থাকে যারা কোনো দিনই মানুষের অধিকার নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এরা কম খায়, কম পরে, কম শিখে; কিন্তু কাজ করে সবার চেয়ে বেশি। এই অল্পে তুষ্ট মানুষগুলো নিজের গায়ে ধূলি লাগিয়ে, কাদা-জলে জীবন কাটিয়ে সমাজের উঁচুতলার মানুষগুলোকে সেবা দিয়ে যায়, কিন্তু তাদের ভাগ্যে এতটুকু সম্মান বা সমাদর জোটে না। এই ধুলোমাখা মানুষগুলোই সভ্যতার নির্মাতা, এদের বুকে পা ফেলেই পৃথিবীতে আসে নব উত্থান। এই মানুষগুলোর মঙ্গল কামনাই আমার জীবনের ব্রত।
কীভাবে বঞ্চিত মানুষগুলোর এতটুকু কল্যাণ করা যায়, আমার মনের গহিনে কেবল সেই চিন্তাই সারাক্ষণ বিরাজমান। আজ জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে মানুষ সামনের দিকে যতটা না এগোচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে তার কয়েকগুণ বেশি। আমার দৃষ্টি দুই শতাব্দীতে প্রসারিত। বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রগতি আমি প্রত্যক্ষ করেছি, পৃথিবীর ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তা চমকপ্রদ, যা বিগত বহু শতাব্দীতে সম্ভব হয়নি এবং অনাগত কালের জন্যও বিস্ময়কর। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে, যে বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের জন্য শ্রম-মেধা ব্যয় করছে, মানুষকে বিভিন্নভাবে মারার জন্যও তার প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মারণাস্ত্র তৈরিতেও মানুষের বিপথগামিতার ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজ মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, সে কি তার সর্বশক্তি মানবকল্যাণেই ব্যয় করবে, নাকি মারণাস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বাঙালির জীবনে সবচেয়ে আলোচিত দুঃখ-বেদনা এবং গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। দীর্ঘ তেইশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানিরা শুধু আমাদের অর্থনৈতিকভাবেই পঙ্গু করেনি, তারা আমাদের মানসিকতারও অবক্ষয় ঘটিয়েছিল। বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কথা আজ আর কারো অজানা নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, সেই মানসিকতার কিছু মানুষ এখনো বাংলাদেশে আছে, তারা যেন কিছুতেই বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কোনো বিষদাঁত না বসাতে পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকা আমাদের কর্তব্য। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ছিল একরাশ সোনালি স্বপ্ন। সেই স্বপ্নগুলো দাঁড়িয়েছিল চারটি মূলনীতির উপর। যথা: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আজ আমি গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক। কেন আমি সমাজতন্ত্রের বৃত্ত থেকে বাইরে গিয়ে গণতন্ত্রের কাছে প্রণত হলাম তার একটি ঐতিহাসিক কারণ আছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি খুব দুঃখজনক রূপ ধারণ করে। প্রচÐ সরকারবিরোধী ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভ্রান্ত মিলিট্যান্ট অংশ তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও প্রকারান্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তির উত্থানের পথ প্রস্তুত করে। যে-আদর্শ বুকে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সে-আদর্শ আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে পেয়েছি। কালের চিরন্তন ভেলায় তার আদর্শ ও নীতি তাঁকে দিয়েছে অমরত্বের গৌরব। তাই বঙ্গবন্ধুর নামে আজ ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্ববন্ধুতে রূপান্তরিত হয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে নারকীয় হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়, তা শুধু মুজিব পরিবারকেই শেষ করার চক্রান্ত নয়, তা ছিল পুরো বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার, ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত। ’৭৫-পরবর্তী কালপর্বে বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক কায়দায়। বন্দুকের নল আর সামরিক আমলাতন্ত্রের পদতলে নত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের রাজনীতি। দেশ চলে পাকিস্তানি সামরিক আমলাতান্ত্রিক ধারায়। সেই সময়কার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা আজও আমার কাছে রহস্যজনক আর অবোধ্যই রয়ে গেছে। ওই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে যখন মুজিবের নাম উচ্চারণ করা পর্যন্ত অসম্ভব ছিল, তখন ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকাকালে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, পিএন হাকসার, কমরেড আবদুল রাজ্জাক খা, ভুপেশ গুপ্ত, গণেশ ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, প্রফেসর শান্তিময় রায়সহ পৃথিবীর বহু দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মত-বিনিময় করে বুঝতে পারি গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানি ধারায় চলে যায়। দেশশাসন করতে থাকে চিহ্নিত দেশদ্রোহী ও দেশবিরোধীরা। তাই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য আপসকামী বামপন্থীদের সংশ্রব ছিন্ন করে ১৯৭৯ সালে যুক্ত হই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে, যুক্ত হই অসা¤প্রদায়িক গণতন্ত্রের ধারায়। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশকে যদি এগিয়ে নিতে হয় তাহলে গণতান্ত্রিক পথেই এগিয়ে নিতে হবে। আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি এদেশের মানুষ যতটা না বিপ্লবী তারচেয়ে অনেক বেশি গণতন্ত্রমনা। সুতরাং গণতন্ত্র ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করা অবান্তর।
ইতিহাসে মধ্যযুগে আমরা দুই শতাব্দীব্যাপী ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কথা জানি। ক্রুসেডাররা পবিত্র জেরুজালেম নগরী লুণ্ঠন করেছিল, অসংখ্য মসজিদ ও সিনেগগ ধ্বংস করেছিল এবং নির্বিচারে অগণিত মুসলমান এবং ইহুদিকে হত্যা করেছিল। কিন্তু তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো ধর্মীয় পবিত্রতা ছিল না। ১০৯৯ সালে ক্রসেডারা জেরুজালেমে খ্রিস্টান রাজত্ব কায়েম করেছিল।
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ আজও চলছে, তবে অন্যরূপে। আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম আর ধর্ম নিয়ে সংঘাত অনেক সময়ই প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এক অর্থে এটা হয়তো স্বাভাবিক, কেননা এশিয়া থেকেই বেশিরভাগ ধর্মের উৎপত্তি। ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, কনফুসিয়ানবাদ, তাওবাদ, সিন্তোবাদ, এসব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলেই সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ধর্মের নামে যে কি ভয়াবহ রক্তপাত হয়েছে তা আমরা ইতিহাসে দেখেছি। দেখেছি হিন্দু-মুসলমানের সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা। পরে ১৯৭১ সালে দেখেছি মুসলমান-মুসলমানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ধর্মের নামে, সা¤প্রদায়িকতার নামে বর্তমান শতাব্দীতেও কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হচ্ছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতা। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিমানুষকে যে পরিমাণ নির্লোভ আর পরার্থপর হওয়া উচিত তা কি একবিংশ শতাব্দীর অতৃপ্ত, লোভী ও স্বার্থপর মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব? আজ বরং আমার মনে হচ্ছে, যা হয়েছে সমাজপ্রগতির ধারাতেই হয়েছে। যা হবে তাও সমাজপ্রগতির স্বাভাবিক ধারাতেই হবে। সমাজপ্রগতির ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে মানুষ শুধু নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেবে না, সঙ্গে সঙ্গে মানবসভ্যতার পতনও ডেকে আনবে। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা তারই লক্ষণ। আমি আমার জীবনে কত ঘটনা-ই না দেখেছি। আমি দেখেছি জমিদারের জমিদারি গেছে, রাজার রাজত্ব গেছে, সাম্রাজ্যবাদীর সাম্রাজ্য গেছে। সামরিক স্বৈরশাসকদের পতন হয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে। শীতল (Cold War) বা স্নায়ুযুদ্ধের মুহূর্তগুলোও প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এগুলো থেকে আমার এই প্রতীতিই জন্মেছে যে, ক্ষমতা কখনো স্থায়ী হয় না; ফাঁকি দিয়ে, চালাকি করে বৃহৎ ও মহৎ কাজ করা যায় না। জোর করে ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায় না। ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে চলে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে চাকরি ও খাদ্যের অভাবে সংগ্রাম চলছে।
নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন তিনটি কারণকে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্কট বলে উল্লে¬খ করেছেন, (১) সা¤প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ, (২) সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং (৩) জঙ্গি রক্ষণশীলতা। বাংলাদেশে মূলত প্রথম এবং শেষ সংকটটি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হুমকির কারণ। যদি আমরা ধর্মনিরপেক্ষ আচরণে অভ্যস্ত না হই, তাহলে এখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ধর্মীয় উগ্রপন্থী ও জঙ্গিবাদ, যা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কখনোই কাম্য নয়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মের নামে কি নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও হানাহানি চলছে তা বিশ্ববাসী অবলোকন করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের উত্থান দেখে মনে হচ্ছে মানুষ যেন আবার মধ্যযুগের মতো ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান বিশ্ব হিংসা আর স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেছে। তাই দেশে দেশে ও মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত লেগেই আছে। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সেসব করা মানুষের উচিত নয়। তবু মানুষ মোহে অন্ধ হয়ে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে এমন কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, যা সভ্যতার জন্য কলঙ্কতিলক হয়ে থাকে। যুদ্ধ পৃথিবীতে কেউ চায় না, তবু আজ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মানুষ আজ মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির পথে না হেঁটে মানুষ যদি যুদ্ধের পথে হাঁটে ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, তাহলে রক্তস্রোত বন্ধ হবে না। বন্ধ হবে না ঘরে ঘরে অসহায় মানুষের কান্না। দেশে দেশে আজ মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। পৃথিবীর স্বার্থেই আজ মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা বন্ধ করতে হবে।
এক সময় মানুষ বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে বসবাস করত। সেই বনচর মানুষেরা স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করত। তাদের মধ্যে কোনো কলহ ছিল না। শোষণ ছিল না। উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো মানসিকতাও ছিল না। বনচারী মানুষের সেই জীবনকে সমাজতাত্তি¡কেরা নাম দিয়েছেন আদিম সাম্যবাদী সমাজ। সমাজ বিবর্তনের ধারায় আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তৈরি হয় দাসপ্রথা। দাসযুগে ব্যক্তি মানুষের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। দাসদের ছিল না স্বাধীন জীবনযাপন করার অধিকার। দাসবিদ্রোহের পরে আসে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দাসরা কিছুটা মানবিক অধিকার ফিরে পেলেও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন পুরোপুরি হয় না। আবার শুরু হয় শোষিত মানুষের লড়াই। এ লড়াই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। এক সময় ভেঙে পড়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। জন্ম নেয় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এই নব্য পুঁজিবাদী যুগে এসেও মানুষ শোষিত হতে থাকে। যার ফলে রাশিয়া-চীনসহ বেশ কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে হয়, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর এখনো মানুষ পরিপূর্ণভাবে সুখী হতে পারেনি। অর্থ ও ক্ষমতালোভী কিছু মানুষ অধিকাংশ মানুষকে সুখী হতে দেয়নি।
১৯৬০-এর দশক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখি চারদিকে প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের জয়জয়কার। মানুষ দলে দলে দীক্ষিত হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ চর্চিত হচ্ছে সর্বত্র। আমরা তখন ধরে নিয়েছিলাম গোটা পৃথিবী বিংশ শতাব্দীর মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে পরিণত হবে। আমাদের চোখে অন্তত সেই স্বপ্নই খেলা করত। কিন্তু সত্তরের দশক যেতে না যেতেই আমাদের মোহভঙ্গ হয়। এর মধ্যে রাশিয়া ও চীন দেশের ইতিহাস পাঠ করে হয় আরো তিক্ত অভিজ্ঞতা। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের নামে চলেছে একনায়কত্ব ও সীমাহীন ভোগবিলাস। সমাজতান্ত্রিক দুই পরাশক্তি চীন-রাশিয়ার কর্ম মানুষের মনের মধ্যে সন্দেহ বাসা বাঁধে। মানুষ মনে করতে থাকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র বেশি দিন টিকবে না। নব্বইয়ের দশকে এসে আমরা তা-ই প্রত্যক্ষ করলাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সারাবিশ্বে মুখ থুবড়ে পড়ল সমাজতন্ত্র। আজ আমরা চীনকেও সমাজতান্ত্রিক দেশ বলতে পারি না, চীনও এখন পুঁজিবাদের পথেই হাঁটছে।
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।’ বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাস কখনোই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস নয়। পৃথিবীর ইতিহাস মূলত ক্ষমতা দখল ও বদলের ইতিহাস। ক্ষমতাই পৃথিবী পরিবর্তনের কারণ। কেননা মানুষ দেখেছে ক্ষমতা থাকলে অর্থ-বিত্ত-আরাম-ভোগ-বিলাসিতা সবকিছু করতলে থাকে। তাই ক্ষমতার কাছে যাওয়ার জন্য মানুষ চিরদিনই তৎপর থেকেছে। এই তৎপরতা আজও অব্যাহত আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ নানারকম লড়াই-সংগ্রাম করেছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তা মূলত ক্ষমতা কুক্ষিগত করারই সংগ্রাম। একদল সুবিধা বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষ ভেবেছে তাদের ক্ষুধা ও মৃত্যুর কারণ ক্ষমতাশালীদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্যই সুবিধাবঞ্চিতরা নানারকম ফন্দি-ফিকির করেছে এবং সেসব ফন্দি-ফিকিরের কেতাবি নামও প্রয়োগ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, যারাই ক্ষমতার কাছে গিয়েছে তারাই দস্যু, ডাকাত ও দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠেছে। তাই তাদের হটানোর জন্য আবার শুরু হয়েছে নতুন লড়াই, ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন নামে।
পৃথিবী নিজের নিয়মেই পরিবর্তনশীল। মানুষ সেই পরিবর্তন কিছুতেই রোধ করতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ চাঁদ-মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের পাশাপাশি মহাবিশ্বের অনেক কিছুই জয় করেছে। কিন্তু প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি। মানুষ ভ‚মিকম্প, সুনামি ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। মানুষ চেষ্টা করছে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে। কবে এসব তার করতলগত হবে, তা ভবিষ্যতই জানে।
আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হয় বিশ্ব একটি মানবিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। পৃথিবীতে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে, ঘরে ঘরে, দেশে দেশে মানুষের কান্না থামাতে গেলে অবশ্যই মানুষকে মানবিক হতে হবে। মানুষ যদি মানবিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী কখনোই সুন্দর শান্তিময় হবে না। এই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদসহ সকল উগ্রপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখতে হবে। আজ আমরা পৃথিবীর দেশে দেশে কিছু উপদ্রব দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখছি একটি সম্প্রদায় আরেকটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠছে, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীকে দমন-পীড়ন ও হত্যা করছে সংখ্যাগুরুরা। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কর্ম দেখে আজ সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগছে আমরা কি তাহলে আবার পেছনে ফিরে যাচ্ছি?
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মাস্টার দা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা কল্পনা যোশীর (১৯১৩-১৯৯৫) একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কল্পনা যোশী কলকাতার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে আমি আর নাচোলবিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র কল্পনা যোশীকে হাসপাতালে দেখতে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বে ইলাদি বলেন, “কল্পনাদিকে দেখতে গিয়ে কি হবে, তিনি তো কাউকে চিনতে পারেন না।” তবু আমি কল্পনাদির স্নেহের কথা মনে করে তাকে শেষ দেখা দেখতে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তিনি তার বেডে চুপচাপ শুয়ে আছেন। তাকে সেবারত নার্সের অনুমতি নিয়ে আমি আর ইলাদি ভেতরে যাই এবং ডেকে তুলি। আমার পরিচয় দিতেই তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাকে বলি বাংলাদেশ ভালো নেই। এরপর তিনি বললেন, “একদিন আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য লড়াই করেছি। তখন মনে হতো পৃথিবী একদিন সুন্দর হবে। কিন্তু আজ দেখছি পৃথিবীটা যেন কেমন হয়ে গেল।” তিনি আর কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজন বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার মাথায় তখনও কল্পনাদির কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিন তো আমরাও আমাদের যৌবনে সুন্দর পৃথিবীর জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আজ পৃথিবীর এই রক্তাক্ত দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
আজ আমরা প্রাচ্য-প্রতীচ্য যেদিকেই তাকাই না কেন সবখানেই মানুষের হাহাকার দেখছি। দিশেহারা মানুষের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ক্ষমতাশালীদের প্রতাপে ভেঙে পড়ছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও সভ্যতা। মানুষ তার স্বভ‚মি থেকে হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দেশে আগুন জ্বলে ওঠছে। শান্তির পরিবর্তে মানুষ ভোগ করছে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক শাস্তি। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হচ্ছে। আমরা কি পারি না সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর দিন আনতে? মানুষের প্রয়োজনেই মানুষকে সুন্দর ও শান্তির পথ বেছে নিতে হবে। কল্যাণের দায়িত্ব নিতে হবে মানুষকেই। বিগত শতাব্দীতে আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। সেই দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কথা নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে। আজ যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ সেই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুতেই আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি মানবিক বোধ জাগ্রত করতে মানুষকে আরো সচেষ্ট হতে হবে। অশুভ-শক্তির পতন ঘটিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারে আজ আমাদের সকলকেই আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই মুক্তি মিলবে মানুষের।
বর্তমান পৃথিবী এখন একটা নতুন আর্থসামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক (Unipolar) বিশ্বব্যবস্থা কখনো সফল হবে না। সি.আই.এ, পেন্টাগন, ন্যাটোর সব প্রচেষ্টা আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সৃষ্ট তালেবান, আল-কায়দা, আই এস-এর সঙ্গে আবার তাদেরই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা (Humane World Order) কামনা করছে। বাংলাদেশও এখন তাই আকাঙ্ক্ষা করে। বর্তমানে বাংলাদেশ সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। কোনো ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে একটি দেশ বা জাতিকে টেনে তোলা সম্ভব নয়, যদি না গোটা জাতি উত্তরণের পথ খোঁজে। আমরা অনেক দূরে যেতে চাই, আমাদের সেই যাত্রার অনুপ্রেরণা হোক গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন-
‘বাংলার মাটি নিত্য উর্বর। এই মাটিতে নিত্য সোনা ফলে। এত ধান আর কোনো দেশে ফলে না। এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ, আল্লাহ, ভগবানের উপাসনা, উপবাস-উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও নেই।’
জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। বঙ্গবন্ধুর আমলে যেমন বাংলাদেশ অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের ও প্রতিষ্ঠানের বিষ দৃষ্টিতে ছিল এখনও তাই আছে। তবে আশার কথা এই যে, জনবান্ধবনেত্রী শেখ হাসিনার কটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে বিরুদ্ধবাদী সেই শক্তিমান রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, আমেরিকা, চীন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ওআইসি, এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য গড়তে তৎপর হয়ে উঠছে। এটা বর্তমানের বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সুখবর।
নিন্দুকের দৃষ্টি কখনোই ভালো কিছু দেখে না। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সকল দুঃসাধ্য কাজ সাধন করেছেন তা কারো পক্ষে সম্ভব হতো কিনা জানি না। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন (যেমন হিজবুত তাহরীর, জেএমবি, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ)-এর মূলোৎপাটন করেছেন, এগুলোকে যারা ছোট করে দেখতে চায়, তারা প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অস্বীকার করতে চায়। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এটা যতদিন বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে না পারবে ততদিন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই, কোনো পরিকল্পনাই টেকসই হবে না, আর সেইখানেই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার ফল এখন আমরা হাতে-নাতে পাচ্ছি।
শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আজ বঙ্গবন্ধুর নাম আকাশে-বাতাসে সসম্মানে উচ্চারিত হচ্ছে। ২০২০-’২১ সালে (মুজিব বর্ষে) নানামুখী মাধ্যমে উদ্যাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সূচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনাকেই ভমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বসভায় সুনাম অর্জন করছে। অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন কাক্সিক্ষত স্তরে উপনীত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ পরিহার করতে হবে। দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং জনমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাংগঠনিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে। সজাগ থাকতে হবে দলের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগের কাছেই বাংলাদেশ আশা করে, কেননা আশার স্বপ্ন আওয়ামী লীগই বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য রাখে, বহতা নদীর মতো আওয়ামী লীগ চলমান।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছে। এখন মানুষের মনে অনেক আশা জন্ম নিচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এখন সবদিক সামাল দিয়ে ঠাÐা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশের এখন বড় বাধা দুর্নীতি। সব সেক্টরে দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন শেখ হাসিনার চোখের দিকে তাকিয়েই স্বপ্ন দেখছে। শেখ হাসিনার স্বপ্ন আর সাধারণ মানুষের স্বপ্ন মিশে একাকার হয়ে গেছে। যে অনন্য উচ্চতায় শেখ হাসিনা নিজেকে এবং বাংলাদেশকে স্থাপন করেছেন সঙ্গত কারণেই তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন। বাংলার নিরন্ন-দুঃখী মানুষের প্রত্যাশা তিনি পূরণ করবেন এমনটাই আশা করে এদেশের জনগণ। সূর্য নিজে জ্বলে যেমন করে পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখে, শেখ হাসিনাও তেমনি করে আলোকিত করছেন বাংলাদেশ।
পরিশেষে বলতে চাই- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য, সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষা করার ব্রত আমরা যেন ভুলে না যাই। আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই, মায়ের অশ্রু, ভাইয়ের রক্ত, বিধবা বোনের দীর্ঘশ্বাসের আরেক নাম বাংলাদেশ। আসুন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। জয় বাংলা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।