বড় লোকের ঢাক তৈরি গরিব লোকের চামড়ায়

বড় লোকের ঢাক তৈরি গরিব লোকের চামড়ায়

সৈয়দ জাহিদ হাসান: সুন্দর পৃথিবী মানুষের জন্য ক্রমে ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। মানুষের সীমাহীন লোভ ও লাভের চিন্তা-প্রকৃতির মর্মমূলে ব্যাপকভাবে আঘাত হেনেছে। এর ফলে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে বিশ্বপ্রকৃতি। মাটি, পানি, বায়ুসহ প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের বিবেকহীন আচরণে নড়েচড়ে উঠছে প্রকৃতি। মানুষের অপরাধে আজ শুধু মানুষেরাই শাস্তি পাচ্ছে এমন নয়, অন্যান্য প্রাণীরাও মানুষের পাপে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করলেও দুর্ভোগ যেন কিছুতেই মানুষের পিছু ছাড়ছে না। একের পর এক সমস্যা এসে রুদ্ধ করছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। খাদ্য শস্যের অভাব নেই, অথচ মানুষ খাবারের জন্য দেশে দেশে হাহাকার করছে। রাজনৈতিক ম্যারপাঁচে মল্যবান গ্যাস পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ মানুষের প্রয়োজনে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। বিজ্ঞান মানুষের শান্তি আনয়নে ব্যর্থ হচ্ছে এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে একটি কথা না বললেই নয়, একবিংশ শতকের বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রা ধনীরা উপভোগ করলেও গরিবের জন্য তা তেমন কোনো কাজে এসেছে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞানীরা অধিকাংশই ধনীদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় ধনীরা এমন কিছুই আবিষ্কার করে না, যা দিয়ে তাদের পুঁজির আয়তন বৃদ্ধি না পায়। ধনীরা টাকা বিনিয়োগ করে আরো বেশি টাকা উপার্জনের জন্য। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে নতুন নতুন আবিষ্কারে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে, তাদের কাছে জনকল্যাণের চেয়ে ধন উপার্জনই বড় কথা। ধনীদের বিজ্ঞানে গরিবের কোনো অধিকার আছে বলে মনে হয় না। তাই যদি হতো, তাহলে নির্বিচারে মানুষ মারার জন্য আজকে যেসব মারণাস্ত্র দেখছি, তা দেখতে হতো না।

পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষগুলো যুদ্ধাস্ত্র যে-হারে উৎপাদন করেছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এত এত অস্ত্র উৎপাদন কার স্বার্থে, কীসের স্বার্থে? ধনীদের দানবীয় উল্লাস দেখে দুনিয়ার গরিব মানুষের মাথার মধ্যে আজ একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কখন তাদের মেরে ফেলা হবে। কিছু কিছু ধনীদেশ মানসিকভাবে এতটাই বিগড়ে গেছে যে, মানবতা তাদের কাছে হাস্যকর বলে মনে হচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে, চালকবিহীন ড্রোন দিয়ে বোমা ফেলে নারী-শিশু-বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। টাকা কামানোর উগ্র বাসনায় প্রত্যেকটি মানুষের মতো প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই আজ তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ব্যক্তি মানুষের মাতলামি হয়তো কিছুটা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু রাষ্ট্র যদি মাতাল হয়ে উঠে তাহলে তার মাতলামি প্রশমন করবে কে? আজ বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ব্যক্তির পূজায় মুখর হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি ‘রাষ্ট্রের সেবক’ এ কথা ভুলে গিয়ে রাষ্ট্রই আজ ব্যক্তির সেবায় নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

মানুষকে জিম্মি করে মানুষ আজ পশুত্বের যে মহড়া দিচ্ছে এসব বন্ধ করার জন্য কিছু সাহসী মানুষকে বুক ফুঁলিয়ে দাঁড়াতে হবে। রাজপথে আজ আবার মানুষের পক্ষে মিছিল দেওয়ার আয়োজন করতে হবে। মানবতাবিরোধীর সঙ্গে লড়াই করতে হবে নতুন দিনের চে গুয়েভারাকে। যারা এখনো মানুষের কল্যাণ চিন্তায় নিমগ্রÑ তাদেরকেই আজ নেতৃত্ব নিতে হবে। আজ ঘাতকেরা ক্ষমতার মসনদে বসে মানুষ হত্যার মিশনে নেমেছে। মানুষগুলো প্রাণ ভয়ে এদিক-সেদিক ছুটেও কিছুতেই প্রাণ রক্ষা করতে পারছে না। মরতে যেহেতু হবেই তাহলে কি আমরা শান্তির সপক্ষে লড়াই করে মরব না?

যারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায় তারা পলাতকের মতো বেঁচে থাকুক। আমরা যারা লড়াই করতে ভালোবাসি, যারা পৃথিবীর সৌন্দর্যের সঙ্গে আরও একটু সৌন্দর্য যোগ করতে চাই, তারা লড়াই করার জন্য তৈরি হবো। ভীরুর মতো না মরে বীরের মতো মরাই হোক আমাদের একমাত্র অভিলাষ। আমরা মরতে শিখলেই বাঁচতে পারব, কেননা, যে মরতে প্রস্তুত তাকে কেউ মারতে পারে না।

আজকের পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে সুখে আছে যারা দুর্নীতিবাজ ও যুদ্ধবাজ। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দুনিয়া থেকে লোভ পেলেও ঔপনিবেশিক শোষণ এখনো বন্ধ হয়নি। দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ লুণ্ঠন করছে। যুদ্ধবাজরা দেশ দখলের মধ্য দিয়ে লুণ্ঠন করছে পরাজিত রাষ্ট্রের খনিজ সম্পদ। আধুনিক বিশ্বে যা কিছু নিন্দিত হওয়ার কথা ছিলÑ তাই আজ নন্দিত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, মৌলবাদ, পরের সম্পদ হরণ ঘৃণিত কাজ হলেও অমানুষেরা তা অবলীলায় করে যাচ্ছে।

সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও আজ বেঁচে থাকতে পারছে না। অশান্তি, কলহ, আত্মহনন সর্বত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বের সবখানে আজ একই চিত্র। মানুষ মারার পরিকল্পনা থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষকে কিভাবে আরো দীর্ঘজীবী করা যায় সে পথে হাঁটাই হোক বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ও রাষ্ট্রনায়কদের প্রধান কর্তব্য। দুঃখ নয়, সুখ হোক মানুষের সাধনা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.