মোনায়েম সরকার: বর্তমান বিশ্ব হিংসা আর স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাই দেশে দেশে ও মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত লেগেই আছে। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সেসব করা মানুষের উচিত নয়। তবু মানুষ মোহে অন্ধ হয়ে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে এমন কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, যা সভ্যতার জন্য কলঙ্কতিলক হয়ে থাকে। যুদ্ধ পৃথিবীতে কেউ চায় না, তবু আজ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মানুষ আজ মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির পথে না হেঁটে মানুষ যদি যুদ্ধের পথে হাঁটে ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, তাহলে রক্ত¯্রােত বন্ধ হবে না। বন্ধ হবে না ঘরে ঘরে অসহায় মানুষের কান্না।
এক সময় মানুষ বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে বসবাস করত। সেই বনচর মানুষেরা স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করত। তাদের মধ্যে কোনো কলহ ছিল না। শোষণ ছিল না। উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো মানসিকতাও ছিল না। বনচারী মানুষের সেই জীবনকে সমাজতাত্ত্বিকেরা নাম দিয়েছেন আদিম সাম্যবাদী সমাজ। সমাজ বিবর্তনের ধারায় আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তৈরি হয় দাসপ্রথা। দাসযুগে ব্যক্তি মানুষের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। দাসদের ছিল না স্বাধীন জীবনযাপন করার অধিকার। দাসবিদ্রোহের পরে আসে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দাসরা কিছুটা মানবিক অধিকার ফিরে পেলেও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন পুরোপুরি হয় না। আবার শুরু হয় শোষিত মানুষের লড়াই। এ লড়াই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। এক সময় ভেঙে পড়ে সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজ। জন্ম নেয় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এই নব্য পুঁজিবাদী যুগে এসেও মানুষ শোষিত হতে থাকে। যার ফলে রাশিয়া-চীনসহ বেশ কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে হয়, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর এখনো মানুষ পরিপূর্ণভাবে সুখী হতে পারেনি। অর্থ ও ক্ষমতালোভী কিছু মানুষ অধিকাংশ মানুষকে সুখী হতে দেয়নি।
১৯৬০-এর দশক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখি চারদিকে প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের জয়জয়কার। মানুষ দলে দলে দীক্ষিত হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ চর্চিত হচ্ছে সর্বত্র। আমরা তখন ধরে নিয়েছিলাম গোটা পৃথিবী বিংশ শতাব্দীর মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে পরিণত হবে। আমাদের চোখে অন্তত সেই স্বপ্নই খেলা করত। কিন্তু সত্তরের দশক যেতে না যেতেই আমাদের মোহভঙ্গ হয়। এর মধ্যে রাশিয়া ও চীন দেশের ইতিহাস পাঠ করে হয় আরো তিক্ত অভিজ্ঞতা। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের নামে চলেছে একনায়কত্ব ও সীমাহীন ভোগবিলাস। স্টালিন সেখানে নির্বিচারে দুই কোটি মানুষ হত্যা করেছিলেন। চীনেও একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন মাও-সে-তুঙ। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে তিনিও চীনে তিন কোটি মানুষকে হত্যা করেন। মানুষকে হত্যা করে মানুষের জন্য শান্তি এনে লাভ কি, যদি এই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, তাহলে কিন্তু সাম্যবাদীরা জবাব দিতে পারবে না। সমাজতান্ত্রিক দুই পরাশক্তি চীন-রাশিয়ার কর্মকা-ে মানুষের মনের মধ্যে সন্দেহ বাসা বাঁধে। মানুষ মনে করতে থাকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র বেশিদিন টিকবে না। নব্বইয়ে এসে আমরা তা-ই প্রত্যক্ষ করলাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সারাবিশ্বে মুখ থুবড়ে পড়ল সমাজতন্ত্র। আজ আমরা চীনকেও সমাজতান্ত্রিক দেশ বলতে পারি না, চীনও এখন পুঁজিবাদের পথেই হাঁটছে।
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।’ বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাস কখনোই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস নয়। পৃথিবীর ইতিহাস মূলত ক্ষমতা দখল ও বদলের ইতিহাস। ক্ষমতাই পৃথিবী পরিবর্তনের কারণ। কেননা মানুষ দেখেছে ক্ষমতা থাকলে অর্থ-বিত্ত-আরাম-ভোগ-বিলাসিতা সবকিছু করতলে থাকে। তাই ক্ষমতার কাছে যাওয়ার জন্য মানুষ চিরদিনই তৎপর থেকেছে। এই তৎপরতা আজও অব্যাহত আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ নানারকম লড়াই-সংগ্রাম করেছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তা মূলত ক্ষমতা কুক্ষিগত করারই সংগ্রাম। একদল সুবিধা বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষ ভেবেছে তাদের ক্ষুধা ও মৃত্যুর কারণ ক্ষমতাশালীদের সীমাহীন দৌরাত্ম। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্যই সুবিধাবঞ্চিতরা নানারকম ফন্দি-ফিকির করেছে এবং সেসব ফন্দি-ফিকিরের কেতাবি নামও প্রয়োগ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, যারাই ক্ষমতার কাছে গিয়েছে তারাই দস্যু, ডাকাত ও দুর্বৃত্ত হয়ে উঠেছে। তাই তাদের হটানোর জন্য আবার শুরু হয়েছে নতুন লড়াই, ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন নামে।
পৃথিবী নিজের নিয়মেই পরিবর্তনশীল। মানুষ সেই পরিবর্তন কিছুতেই রোধ করতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ চাঁদ-মঙ্গল অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের পাশাপাশি মহাবিশ্বের অনেক কিছুই জয় করেছে। কিন্তু প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি। মানুষ ভূমিকম্প, সুনামি, জলোচ্ছ্বাস ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। মানুষ চেষ্টা করছে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে। কবে এসব তার করতলগত হবে, তা ভবিষ্যতই জানে।
আজ বিশ্বের দিকে তাকালে মনে হয় বিশ্ব একটি মানবিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। পৃথিবীতে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে, ঘরে ঘরে, দেশে দেশে মানুষের কান্না থামাতে গেলে অবশ্যই মানুষকে মানবিক হতে হবে। মানুষ যদি মানবিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী কখনো সুন্দর শান্তিময় হবে না। এই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদসহ সকল উগ্রপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখতে হবে। আজ আমরা পৃথিবীর দেশে দেশে কিছু উপদ্রব দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখছি একটি সম্প্রদায় আরেকটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তৎপর হয়ে উঠছে, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীকে দমন-পীড়ন ও হত্যা করছে সংখ্যাগুরুরা। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কর্মকা- দেখে আজ সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগছে আমরা কি তাহলে আবার ক্রসেডের যুগে ফিরে যাচ্ছি?
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মাস্টার দা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা কল্পনা যোশীর (১৯১৩-১৯৯৫) একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কল্পনা যোশী কলকাতার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে আমি আর নাচোলবিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র কল্পনা যোশীকে হাসপাতালে দেখতে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বে ইলাদি বলেন, “কল্পনাদিকে দেখতে গিয়ে কি হবে, তিনি তো কাউকে চিনতে পারেন না।” তবু আমি কল্পনাদির কথা মনে করে তাকে শেষ দেখা দেখতে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তিনি তার বেড়ে চুপচাপ শুয়ে আছেন। তাকে সেবারত নার্সের অনুমতি নিয়ে আমি আর ইলাদি ভেতরে যাই এবং ডেকে তুলি। আমার পরিচয় দিতেই তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাকে বলি বাংলাদেশ ভালো নেই। এরপর তিনি বললেন, “একদিন আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য লড়াই করেছি। তখন মনে হতো পৃথিবী একদিন সুন্দর হবে। কিন্তু আমি দেখছি পৃথিবীটা যেন কেমন হয়ে গেল।” তিনি আর কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজন বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার মাথায় তখনও কল্পনাদির কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিন তো আমরাও আমাদের যৌবনে সুন্দর পৃথিবীর জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আজ পৃথিবীর এই রক্তাক্ত দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। মানুষের উচিত হবে‘কেমন হয়ে যাওয়া পৃথিবীটাকে’ সুস্থ, সুন্দর করে গড়ে তোলা।
আজ আমরা প্রাচ্য-প্রতীচ্য যেদিকেই তাকাই না কেন সবখানেই মানুষের হাহাকার দেখছি। দিশেহারা মানুষের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ক্ষমতাশালীদের প্রতাপে ভেঙে পড়ছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও সভ্যতা। মানুষ তার স্বভূমি থেকে হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দেশে আগুন জ্বলে উঠছে। শান্তির পরিবর্তে মানুষ ভোগ করছে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক শাস্তি। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হচ্ছে। আমরা কি পারি না সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর দিন আনতে? মানুষের প্রয়োজনেই মানুষকে সুন্দর ও শান্তির পথ বেছে নিতে হবে। কল্যাণের দায়িত্ব নিতে হবে মানুষকেই। বিগত শতাব্দীতে আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। সেই দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কথা নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে। আজ যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশ সেই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুতেই আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি মানবিক বোধ জাগ্রত করতে মানুষকে আরো সচেষ্ট হতে হবে। অশুভ-শক্তির পতন ঘটিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারে আজ আমাদের সকলকেই আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই মুক্তি মিলবে মানুষের।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট