সাফাত জামিল শুভ: রবীন্দ্রনাথ আকুল হয়ে বলেছিলেন: “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” অথচ এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে চলে যেতে অনেকেই করেন না-হক তাড়াহুড়া, করেন আত্মহত্যা।কিন্তু কেন করেন?আত্মহত্যা বা আত্মহনন ( ইংরেজি:Suicide) হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া। ল্যাটিন ভাষায় “সুই সেইডেয়ার” থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে।চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর প্রচলিত সব ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রিভেনটিং সুইসাইড: অ্যা সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭’-এ বলা হয়, প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এই সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছুবে। একই প্রকাশনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা আরও বলছে, গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা।
বাংলাদেশে গত চার বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু গত বছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজার ১২৯ জন। এ তথ্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দপ্তরের। যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন বা চেষ্টা করেছেন, তাঁদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
আশংকার বিষয় হচ্ছে বর্তমান সময়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা নানা কারণে আত্নহননের এ পথ বেছে নিচ্ছেন।বাদ যাচ্ছেনা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীও।বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রটিকে নিয়ে এক রাশ আশা থাকে তার পরিবারের এবং আশেপাশের মানুষগুলোর।অথচ সব কিছু পেছনে ফেলে কিছু দিন পর পর আত্নহত্যা করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।প্রসঙ্গত চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত আটজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সর্বশেষ গত ১৬ নভেম্বর মেহের নিগার দানি নামে ইংরেজি বিভাগের সাবেক এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। এর আগে ১৪ নভেম্বর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী লাইলা আঞ্জুমান ইভা আত্মহত্যা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের একজন ছাত্র মুশফিক মাহবুব আগষ্টে দিবাগত রাতের কোনো একসময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটি বাসার ছাদ হতে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ১০তলা এমবিএ ভবনের ৯তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তানভীর রহমান (২৭) নামে এক শিক্ষার্থী।১৫ অক্টোবর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাকির হোসেন নিজ ঘরে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ১২ নভেম্বর রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হোস্টেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ফাহমিদা রেজা সিলভির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৪ ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ২০০৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সূর্যসেন হলের ছাত্র হুমায়ুন কবির হলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। একই বছরের ২০ অক্টোবর রোকেয়া হলের ছাত্রী উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিল্পী রানী সরকার বিষপানে আত্মহত্যা করেন। ২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র আক্তার হোসেন চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। একই বছরের ২৮ জুলাই রোকেয়া হলের ছাত্রী সাজিদা আক্তার আত্মহত্যা করেন। ২০০৭ সালের ২৫ জুন গলায় রশি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেন আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী জোহরা খাতুন প্রজ্ঞা। ওই বছরেই চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেরা খাতুন পাপড়ি নামে এক শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে মারা যান। আবার ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিার্থী ও ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান ইকবাল সজীব চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২০১৪ সালে একই ভাবে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাহবুব শাহিন। মৃত্যুর আগে তিনি ফেসবুকে ব্যক্তিজীবন নিয়ে হতাশার কথা উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দেন। এরপর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাবি ছাত্র ও উদীয়মান সংগীতশিল্পী নাঈম ইবনে পিয়াস রেজা আত্মহত্যা করেন। রাজধানীর ভাষানটেকে নিজ ঘরে প্রেমিকার ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। তারপর ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থী তারেক আজিজ চাকরি না পেয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করেন। ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে অপু সরকার নামে এক ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অল্পদিনের ব্যবধানে এতগুলো শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা আমাদের সকলকে নাড়া দিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কোন একটা জায়গা ঠিকঠাক নেই। কিন্তু কী সেই জায়গা? কী সেই একক কারণ? কী সেই অনেকগুলো কারণ? এই প্রবণতা কি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেই? অতীতে এরকম আত্মহত্যা প্রবণতা ছিল কি?
ইটালির কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস এ-প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে: “আত্মহত্যা করবার জন্য কারুর কারণের অভাব হয় না।”
আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। আত্মহত্যার মাধ্যমে একটি জীবনই শুধু নষ্ট হয় না, প্রতিটি আত্মহত্যার বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবারের ওপর, আত্মহত্যাকারীর বন্ধু-বান্ধবদের ওপর। আমি দেখেছি, একটি মাত্র আত্মহত্যার ঘটনা কীভাবে একটি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমাকে প্রচন্ডভাবে ভাবায় বিষয়গুলো। কিন্তু গত বছরের একটি আত্নহত্যার ঘটনা বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, আত্নহত্যা কি শুধুই নিজেকে হত্যা? নাকি চলমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা? যে ঘটনাটি ভীষণভাবে আমাকে আলোড়িত করে সেটি ছিল, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী অর্ঘ্য বিশ্বাস এর ‘আত্মহত্যা’। নিজেকে হত্যার আগে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তাতে তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। ‘প্রিয় বাংলাদেশ’ সম্বোধন করে চিঠি আকারে লেখা ওই স্ট্যাটাসের শেষে নিজেকে তিনি ‘যুক্তিবাদী বেয়াদব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো।
প্রিয় বাংলাদেশ,
আশা করি ভালো আছো। তোমার মেরুদণ্ডহীন সিস্টেমের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলাম। বোকার মতো শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে জীবনটা পার করার যে জেদ ছিল সেটা তোমার মেরুদণ্ডহীনতার তন্ত্রে হার মেনে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি থেকে এবং সিজিপিএ’র জন্য পড়াশোনা করে মেধাবী তকমা পাওয়া কিংবা দুর্ঘটনায় বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর পর মিডিয়ার প্রচারের স্বার্থে মেধাবী খেতাব নেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। শুধু শুধু গাধার মতো কোনো ইস্যু পেলে চ্যাঁচিয়ে বার বার তোমার মেরুদণ্ডহীনতা বোঝানো ছাড়া বোধ হয় আমি আর কিছু পারতাম না।
তোমার মেধাবী সূর্য সন্তানদের দেখে আমার বড় আফসোস হয়। দেখ, কীভাবে তারা তাদের মেধাগত যোগ্যতা বলে তোমার সিস্টেমের সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।তারা আমাদের কী বলে জানো? ”যুক্তিবাদী বেয়াদব”। আমরা ডিপার্মেন্ট-এর বদনাম করি, দল করে সুন্দর সাজানো একটা ডিপার্মেন্টকে নষ্ট করি। সিনিয়র ভাইদের সাথে ঘুরে ঘুরে স্যারদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করি।
কাল সারা রাত অনেক ভাবলাম বুঝলে। সত্যি বলতে কী, আমার এখন মনে হচ্ছে আমরা এই “যুক্তিবাদী বেয়াদবেরা” আসলেই তোমার ক্ষতি করছি। পদ্মা ব্রিজ হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে, আধুনিকায়ন হচ্ছে। সুশাসন এবং আইন ব্যবস্থায় গুম, হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পরও মন্ত্রী মহোদয় সেটা হাতের ময়লার মতো উড়িয়ে দেন। প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। দলীয় এবং নিয়োগ বাণিজ্যের কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বিশাল সংখ্যক ডিপ্রেসড শিক্ষার্থী তৈরি করছেন। গর্ব করার জন্য বহির্বিশ্বে তোমার বংশদ্ভূত সন্তানেরা রয়েছেন যারা নিজেদের উন্নতির স্বার্থে তোমাকে ত্যাগ করে অন্য দেশকে আপন করে নিয়েছেন।
তোমার মেরুদণ্ডহীন বিদ্বান সূর্য-সন্তানেরা তোমার এত উন্নতি করছে সেখানে আমি তোমার কি উপকার করছি বলো? তোমার টাকায় পড়ে-খেয়ে তোমার সিস্টেমের বিরোধিতা করছি, তোমার সাথে বেঈমানি করছি। দেখে নিও, আর করব না। সেদিন ভিসি স্যার এবং চেয়ারম্যান স্যারের কাছে মাফ চাইনি। আজ তোমার কাছে মাফ চাইছি।তোমার আর কোনো ক্ষতি করব না। আর তোমার বিরোধিতা করব না। সোজা হওয়া এই মেরুদণ্ড ভেঙে নোয়াতে পারব না। সেটা আমার দাঁড়া হবে না। সেজন্য অন্য পথটা বেছে নিলাম।
ভয় পেয়ো না। ধর্মান্ধতায় অন্ধ, ক্ষমতাবলে ভীত, অর্থ মোহে ঘুমন্ত এই বালির নিচে মাথা ঢুকিয়ে থাকা উঠপাখি সদৃশ জাতি কোনোদিনও তোমার ভেঙে পড়ে থাকা মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করে তোমাকে যন্ত্রণা দিবে না। আমার মতো যেসব “বেয়াদবেরা” তোমার সিস্টেম বাগের কারণে ভুল করে জন্মেছে, তারাও আস্তে আস্তে তোমার সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। আশা করি পৃথিবীতে তুমি তোমার উন্নতির ধারা বজায়ে রাখবে।
ভাল থেকো।
-সাফাত জামিল শুভ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়









